বিশেষ প্রতিবেদক:
বাংলাদেশে আশির দশকে পপ গান জনপ্রিয় হতে শুরু করে। এ ধারায় বাংলাদেশে প্রথম গান গাওয়া শুরু করেন আযম খান। তাঁকে ধারার দেশীয় পপ সঙ্গীতের গুরু হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ তিনিই প্রথম পপ সঙ্গীতের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটান। সত্তরের দশকে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এদেশে পপ সঙ্গীতের সূচনা করেন। সে সময় তার সঙ্গে দেশের সঙ্গীতের এ নতুন ধারায় যুক্ত হন শিল্পী ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, নাজমা জামানসহ প্রয়াত পিলু মমতাজের মতো সময়ের একঝাঁক তরুণ প্রতিভা। পপ গানের এই রাজাকে কেউ কেউ পপ গুরু বলে সম্বোধন করতেও পছন্দ করতেন।
১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি ১০ নম্বর সরকারি কোয়ার্টার, আজিমপুর কলোনিতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৫ সালে প্রথমে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে বেবিতে ভর্তি হন। এরপর ১৯৫৬ সালে কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলে প্রাইমারিতে ভর্তি হন। তারপর ১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭০ সালে টি অ্যান্ড টি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মুক্তিযুদ্ধের পর পড়ালেখায় আর অগ্রসর হতে পারেন নি। বাবা মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান ও মা জোবেদা বেগম। বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী ও মা ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী। মায়ের মুখেই গান শুনতে শুনতেই গড়ে ওঠে গানের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক। উঠতি বয়সে বড় ভাইদের গানের চর্চা দেখে তীব্রভাবে ঝুঁকে পড়েন সঙ্গীতের মায়াজালে। বিভিন্ন এলাকার বন্ধুদের বাড়ির ছাদে বসে জমে উঠতো গানের আসর। হেমন্ত, শ্যামল মিত্র, মুকেশ, মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমারসহ দেশ-বিদেশের নানান শিল্পীর গানে মাতিয়ে রাখতেন আসর।
১৯৮১ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি সাহেদা বেগমকে বিয়ে করেন। ১৯৭২ সালে নটরডেম কলেজের একটি অনুষ্ঠানে প্রথম মঞ্চে গান শোনান আজম খান। তখনও দেশে কনসার্টের প্রচলন হয়নি। ১৯৭৩ সালের ১ এপ্রিল প্রথম কনার্ট হয় ওয়াপদা মিলনায়তনে। সেখানে এক মঞ্চে গান গেয়েছিলেন আজম খান, ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফকির আলমগির ও পিলু মমতাজ। ১৯৮২ সালে বের হয় তাঁর প্রথম ক্যাসেট ‘এক যুগ’। সব মিলিয়ে তাঁর অডিও ক্যাসেট ও সিডির সংখ্যা ১৭টি।
পপ গুরু আজম খান সম্পর্কিত আরও খবর :
⇒ স্মরণে পপ গুরু আজম খান
সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকে বৈচিত্র্যময় কথার নানা পপগান গেয়ে তারুণ্যের হৃদয়ে উন্মাতাল আনন্দের ঝড় তুলেছেন আজম খান। তাঁর অগণিত জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, আলাল ও দুলাল, ওরে সালেকা ওরে মালেকা, অভিমানী, আমি যারে চাইরে, হাইকোর্টের মাজারে, এত সুন্দর দুনিয়ায়, জীবনে কিছু পাব নারে, পাঁপড়ি কেন বুঝে না, চার কলেমা সাক্ষী দিবে এবং ও চাঁদ সুন্দর রূপ তোমার ইত্যাদি। আমাদের আলোকিত দেশ গড়ার জন্য, স্বাধীনতার জন্য যে যুদ্ধ; সেই মুক্তিযুদ্ধেও বীরোচিত ভূমিকা রেখেছেন তিনি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জীবনকে বাজি রেখে অংশ নিয়েছেন অসংখ্য গেরিলা যুদ্ধে। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার মেলাঘরে। প্রশিক্ষণ শেষে দেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন দখলদার পাকিস্তাানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। অস্ত্র হাতে প্রথম লড়াই করেন কুমিল্লার সালদাহে। এরপর ঢাকার ডেমরা, যাত্রাবাড়ী হয়ে লক্ষানদী, বালুনদী, গুলশান, ইসাপুর ও ক্যন্টনমেন্টের পাশ পর্যন্ত নানা স্থানে অংশ নিয়েছেন গেরিলা অপারেশনে। যুদ্ধকালীন সময় ডেমরার তিতাস মিশন শেষ করে ফেরার পথে নৌকাডুবিতে বিপর্যয়ে পড়েন তিনি। নদীর তলদেশের লতায় পা আটকে যাবার ফলে সাঁতার কাটা দুরহ হয়ে পরে। অস্ত্র টানার নৌকা জড়িয়ে ধরে আত্মরক্ষা করেন তিনি। সেই সাহস মানুষ গানে গানে তানে তানে মুক্তিযুদ্ধ শেষে আবার মগ্ন হয়েছিলেন গানের ভূবনে। এখানে তিনি তাঁর পুরো জীবনই ব্যয় করেছেন। যার বিনিময়ে সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ পেয়েছে আজম খানের রঙধনুময় অসংখ্য গান। যে গানে বাংলাদেশ, ভালোবাসা উঠে এসেছে নিমগ্ন শ্রদ্ধায়।
খেয়ালি মানুষ ছিলেন আজম খান। গানের বাইরে বিভিন্ন জনের অনুরোধে অভিনয়ও করেছিলেন। ১৯৮৬ সালে হীরামনে কালা বাউলের চরিত্রে অভিনয় করেন। ২০০৩ সালে ‘গডফাদার’ সিনেমায় ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এছাড়া বেশ কিছু বিজ্ঞাপনচিত্রেও মডেল হয়েছেন তিনি।
করোনাকালে সঙ্গীতশিল্পীদের ভাবনা
⇒ এখন অনেকেই সংস্কৃতিচর্চার নামে ভাঁড়ামি করছে : ফাহিম ফয়সাল
⇒ ‘করোনা পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিল্পীরা’
২০১০ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা নামক মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন আজম খান। প্রথমে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৪ জুলাই তিনি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে ইএনটি হেড-নেক সার্জন বিভাগের প্রধান অ্যান্ড্রু লয় হেং চেংয়ের তত্ত্বাবধানে আজম খানের মুখে সফল অস্ত্রোপচার করা হয়।
৭ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় তাকে পুনরায় সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে মোট ৩০টি রেডিওথেরাপি ও ৫টি কেমোথেরাপি দেয়ার কথা থাকলেও আজম খান ২১টি রেডিওথেরাপি ও ১টি কেমোথেরাপি নিয়ে ২৭ ডিসেম্বর দেশে ফিরেন আসেন। সম্পূর্ণ কোর্সটি সম্পন্ন করা সমর্থন করে নি তাঁর শরীর। ২০১১ সালের ২২ মে হঠাৎ বাম হাতে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলে তাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৭ মে গুরুতর অসুস্থ হলে তাঁকে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়। এরপর স্কয়ার থেকে ১ জুন সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয় তাঁকে। ৫ জুন রবিবার সকাল ১০.২০ মিনিটে ঢাকা সেনানিবাসের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তি এ শিল্পী।