
অয়ন আমান :
বঙ্গপোসাগরের তীরবর্তী ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যময় এই ভূমিতে জালের মতো জড়িয়ে আছে নদ-নদী; পাখ-পাখালীর কিচিরমিচির আর নদীর স্রোতের কলতান নিত্যসঙ্গী এই জনপদের মানুষের। গ্রীষ্ম গত হয় তার উত্তাপ ও প্রবঞ্চন আহুতি নিয়ে। বর্ষার মেঘকাজল দিবসের দীর্ঘ ছায়া নামে যমুনার কালো জলে। বর্ষণ মুখর রাত্রির বিদ্যুৎ চমকে উৎফুল ভবন শিখারী নৃত্য করে প্রাসাদের কালো মর্মর অলিন্দে। শরতের আলো ছায়া বিজড়িত প্রভাতে নদী তীরে কাশ বনে লাগে দোলা। হেমন্তে আনে কুহেলী, শীত দেয় উদাসীনতা। বসন্তে ফুলের মঞ্জুরী আন্দোলিত হয় শিরীষের শাখা-প্রশাখায়।
ঘন গাছ-গাছালি ঘেরা নদীমাতৃক এই অঞ্চলে প্রধান আবাস ছিলো কুঁড়েঘর। কৃষি, পশু পালন, মাছ শিকারে জীবিকা নির্বাহকারী নির্জীব মানুষের আবাসভূমি এই বাংলার প্রথম রাজনৈতিক অস্তিত্ব পাওয়া যায় তের শতকে। ফরাসী দার্শনিক জাঁ জ্যাক রুশো রচিত ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’ গ্রন্থের ভাষায়- ‘মানুষকে আগে জাতিতে পরিণত হতে হয়। সমাজের এটাই হচ্ছে যথার্থ ভিত্তি। সমগ্র সমাজটা এই ভিত্তির উপরই তার অস্তিত্বকে ধারণ করে।’ সাদাসিধে জীবন-যাপনের এই মানুষগুলোর মনের ভাব প্রকাশে বাংলাই ছিলো একমাত্র বাহন।
পলি বিধৌত এই বাংলার মানুষের সরলতার সুযোগে হাজার বছর ধরে শোষণ করেছে শাসকগোষ্ঠি। পাল, সেন, তুর্কী, আফগান, আরবী, মুঘল, ইংরেজ এবং সবশেষে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এতদ অঞ্চল শাসন করেছে ১১’শ বছর। ফলে আদিবাসী, আর্য, মধ্যএশীয়, মোঙ্গলীয় ধাঁচের মানুষ মিলেমিশেই আজকের বাঙালি জাতি। পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির পরিচয় বহন করে সে জাতির ভাষা-সংস্কৃতি। বাংলা ভাষাও বাঙালি জাতির পরিচয় বহন করে আসছে প্রাচীন যুগ থেকে। সুলতানি শাসনামলে সর্বপ্রথম বাংলাকে রাজকীয় ভাষার মর্যাদা প্রদান করা হয়। এই স্বীকৃতির হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে কুঁড়ে ঘর ছেড়ে বাংলা স্থান করে নেয় সাহিত্যের সড়কে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠির মুখের বোল ধীরে ধীরে স্থান করে নেয় বহিরাগত রাজাদের রাজকীয় কাজে। তবুও রাহুর গ্রাস পেছন ছাড়েনি এই বাংলার। বহিরাগতদের ব্যবহারে গড়ে ওঠে এক অভিজাত সংস্করণ, সাধারণ বাঙালীর কথ্য শব্দ শিকার হয় অবহেলার।
সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাঙলার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং কৃষি নির্ভর অর্থনীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলা বর্ষ প্রবর্তন করা হয়। বাঙালির জীবন-জীবিকার সংগ্রামের সঙ্গে উন্মেষ ঘটে তাঁর সংস্কৃতি বোধের। চতুর্দশ শতাব্দীতে শ্রী চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব সংস্কার আন্দোলন ও হিন্দু ধর্মের জাত-পাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং মুসলিম কবি ও লোকজ সংস্কৃতি এক নতুন জাগরণের আবির্ভাব ঘটায়। এটিই ছিলো বাঙালির প্রথম জাগরণ। ভাষাকে কেন্দ্র করে বাঙালির পারস্পারিক সম্পর্কের হৃদ্যতার চিত্রই পাওয়া যায় সে সময়ের গ্রামীণ মানুষের জীবন-যাত্রায়। বাংলার অভিজাতদের মাঝে আচার-আচরণে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হলেও অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রধান প্রধান দুই সম্প্রদায়ের অভিজাতদের জীবন যাত্রার কিছু কিছু দিক বিনিময়ের দৃষ্টান্তও পাওয়া যায়।
বাঙালির কথ্য ভাষা গ্রন্থভুক্তি হওয়ার ইতিহাস পাওয়া যায় আঠারো শতাব্দীর প্রথম দিকে। বহিরাগত আদর্শ-দর্শন আরোপ করার উদ্দেশ্যে রচিত গ্রন্থে প্রাথমিক পর্যায়ে বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত শব্দ স্থান পেলেও পরবর্তীতে তার ধারাবাহিকতা পাওয়া যায়নি। সতেরশো শতকের মাঝামাঝি সময়ে বেনিয়াদের আগমণের পর থেকেই ফাটল ধরতে শুরু করে বাঙালির এই জাতীয়তাবোধের সম্পর্কে। শাসন আর লুটের স্বার্থে ধীরে ধীরে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং ভাষাগতভাবে বিভেদের দেয়াল নির্মাণ করতে থাকে বহিরাগত বণিকেরা; যার প্রভাব দৃশ্যমান হতে থাকে মধ্যবিত্ত সমাজে-সংস্কৃতিতে।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার এবং ইউরোপীয় দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভাবে দ্বিতীয়বারের মতো জাগরণ আসে। বিদেশী শাসকদের সাহিত্য, দর্শন, জ্ঞান-বিজ্ঞান এর মাধ্যমে যে মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে তার সাথে দেশজ সংস্কৃতি একীভূত হয়ে জাগরণের সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু তা বাঙালির জীবনে স্থায়ীত্ব লাভ করেনি। কারণ সেই সময়ে বাঙালির জীবনে সকল স্তরে আর্থ-সামাজিক কোনো পরিবর্তন আসেনি। আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধশালী সমাজ বণিকে হলেই এই জাগরণ বাঙালির জীবনে স্থায়ী রূপ লাভ করতো।
বার বার শাসক ও সংস্কৃতি বদলের মধ্য দিযে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা নিজেদেরকে মানিয়ে নিচ্ছিলো। সে যুগেও বাঙালির প্রাণ শক্তি ছিলো প্রচুর, প্রতিভা ছিলো প্রখর। নতুন সাহিত্য, বিজ্ঞান ও সভ্যতাকে তারা গলদ গ্রহণ করলো না করলো গ্রহণ। অপরের চিন্তাধারাকে সে ধার করলো না, ধারণ করলো। সাহিত্য, শিল্পে, ললিতকলায় বাঙালি সূচনা করলো সমৃদ্ধিযুক্ত নব যুগের আনলো দেশাত্ববোধের অভূতপূর্ব প্রেরণা। যৌবনকে দিলো অভয় মন্ত্র, নারীকে দিলো আত্মচেতনা। সে দিন সর্ব ভারতের অধিনায়িকার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন বঙ্গজননী।
প্রবাসী বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘প্রাকৃতিকভাবে বাংলা ভারতের অংশ হলেও ভাষা এবং সংস্কৃতির দিক দিয়ে বাংলা স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে অবস্থান করে।’ ১৩৪৫ বঙ্গাব্দের শ্রাবণে নদী ভাঙনের মতো (১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দ) দেশ ভাগের পর বাঙালি জাতির ভাষা-সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় পাকিস্তান-ভারতের মাঝে বিলীন হয়ে যায়; বিশ্বের বহু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ ধারণা করেছিলেন যে এক সময় বাঙালির স্বাতস্ত্রতা বলে কিছু থাকবে না। বাঙালির পরিচয় হবে পাকিস্তানি ও ভারতীয়। কিন্তু বাঙালিরা থেমে থাকেনি, বিলুপ্ত হয়ে যায়নি তাদের আত্মমর্যাদাবোধ। ১৩৫৮ বঙ্গাব্দে (১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দ) ভাষার রাষ্ট্রীয় অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালির স্বকীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে পুনরায়। শুরু হয় আরেকটি পর্যায়। বাঙালির নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতির উপর চেপে বসে পাকিস্তানী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। ১৩৬৯ বঙ্গাব্দের ১ আশ্বিন (১৯৬২ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর) শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আত্মহুতি, ১৩৭২ বঙ্গাব্দের মাঘে (১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি) মুক্তির সনদ ৬ দফা উত্থাপন, তার ভিত্তিতে বাংলার ছাত্র-যুব সমাজের ১১ দফা ভিত্তিক স্বাধিকার সংগ্রাম, ১৩৭৫ বঙ্গাব্দের (১৯৬৯ খ্রীষ্টাব্দ) গণঅভ্যূত্থান, ১৩৭৭ বঙ্গাব্দের আশি^নের নির্বাচন (১৯৭০ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর), ১৩৭৮ বঙ্গাব্দের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত হয় বাঙালিরা। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র।
দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পরিক্রমায় শহীদের রক্তের সঙ্গে জনগণের সম্পাদিত চুক্তি ‘সাম্য’, ‘মানবিক মর্যাদা’ ও ‘সামাজিক সুবিচারে’র শপথ রচিত হয়। নব গঠিত রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয় ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘সমাজতন্ত্র’, ‘গণতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। অথচ বাংলাদেশ বাহ্যিক দৃষ্টিতে স্বাধীন দেখা গেলেও তার অভ্যন্তরীণ চিত্র রয়ে গেল সেই পরাধীনতায় আবদ্ধ। গণমানুষের আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে উত্থিত নির্যাস রাষ্ট্রীয়-কাঠামো ও শাসনব্যবস্থায় উপেক্ষিত হয়ে পড়ে। দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে বাঙালীত্বকে পাশ কাটিয়ে অনুকরণ করা হয় বেনিয়াদের পরিত্যক্ত রীতি-নীতি।
এ বিষয়ে ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে ১ বৈশাখে প্রকাশিত ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উক্তি প্রাসঙ্গিক বলেই প্রতিয়মান হয়। তিনি লিখেছিলেন, ‘ভারতবাসী যে বুদ্ধিসামর্থ্যে কোনো অংশে জাপানের চেয়ে ন্যূন, এ কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এই দুই প্রাচ্যদেশের সর্বপ্রধান প্রভেদ এই, ইংরেজ শাসনের দ্বারা সর্বতোভাবে অধিকৃত ও অভিভূত ভারত, আর জাপান এইরূপ কোনো পাশ্চাত্য জাতির পক্ষছায়ার আবরণ থেকে মুক্ত। এই বিদেশীয় সভ্যতা, যদি একে সভ্যতা বলো, আমাদের কী অপহরণ করেছে তা জানি; সে তার পরিবর্তে দ- হাতে স্থাপন করেছে যাকে নাম দিয়েছে (খধি ধহফ ঙৎফবৎ) বিধি এবং ব্যবস্থা, যা সম্পূর্ণ বাইরের জিনিস, যা দারোয়ানি মাত্র।’
এই বিধি ও ব্যবস্থা বজায় রেখে রাতারাতি কিছু স্থান থেকে উর্দু সাইনবোর্ড সরে গেলেও সে স্থানগুলো দখল করে নেয় ইংরেজি সাইনবোর্ড। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ইংরেজিতে সাইনবোর্ড লেখার মতো অন্যের অধিনস্ত থাকার প্রবণতা লক্ষণীয়। এমন কী সরকারী অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নামও ইংরেজিতে লেখা হয়। জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে উচ্চ আদালতের রায় লেখা হয় ইংরেজিতে। যা রাষ্ট্র-ভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মাহুতি দানকারী শহীদদের প্রতি অবমাননাকর।
শুধু রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডেই নয় ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবনে স্বাধীন দেশের নাগরিকরা কোন কাজেই বাংলা সন তারিখ অনুযায়ী সম্পাদন করার পরিবেশ-পরিস্থিতি পাচ্ছে না। ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের বর্ণনায় তৎকালীন সময়ে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন- ‘লেখাপড়ার কথা দূরে থাক, এখন নব্য সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো কাজই বাংলায় সম্পাদিত হয় না… ইহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই। ইংরেজি এক রাজকীয় ভাষা তাহাতে অর্থ উপার্জনের সুযোগ রয়েছে।’ বঙ্কিমচন্দ্রের লেখার প্রায় দেড়শ বছর পর আজ ইংরেজ রাজা নেই, কিন্তু ঔপনিবেশিক দাসত্ববোধের মানসিকতা রয়ে গেছে। এ বিষয়ে আহমদ ছফা লিখেছিলেন- ‘ইংরেজি এই দেশে এখনও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত এই কারণে যে ইংরেজরা যে সমাজব্যবস্থা সৃষ্টি করে গিয়েছিলো তার কোনো অদল-বদল হয়নি।’
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপিত হলেও পহেলা বৈশাখের মতো বাঙালীর আদি উৎসবটি উপেক্ষিত রয়ে গেছে।
শুধু তাই নয় সর্বোপরি জাতীয় অর্থবছরের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ‘পরাধীন’ চিন্তা-চেতনায় আক্রান্ত। স্বাধীনতার এত বছরে এ বিষয়ে শুধু ‘শব্দ বোমা’ই ফেটেছে; কার্যত জাতীয়তাবাদ ফাঁকাবুলিতে পরিণত হয়েছে। দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করার পাশাপাশি দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশ, বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে মুক্তি ও কথিত উগ্রবাদী চিন্তা মোকাবেলায় জাতীয় জীবনে নিজস্বতা চর্চার কোন বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় কুটির শিল্প, ছোট-মাঝারি দেশীয় শিল্পের পাশাপাশি আধুনিক যুগের চাহিদায় কৃষি পণ্য ভিত্তিক শিল্প গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মৌসুমী ফসল চাষে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ‘মৌসুমী কৃষি ঋণ’ ব্যবস্থা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃষি পণ্য রফতানীসহ অর্থনীতির নানা দিক উন্মোচিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার সংগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে নতুন নতুন সমাজ শক্তি। আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন, সাংস্কৃতিক কর্মকা- ও রাজনৈতিক কর্মকা-র মধ্য দিয়ে বাঙালীর বিকাশমান চিন্তাকে রাষ্ট্র পরিচালনার ‘খোরাক’ না করায় জাতীয় জীবনের গতি মন্থর হয়েছে একাধিকবার।
আজকের বাঙালীরা পৃথিবীর যে যেখানেই দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে তার পেশাগত যোগ্যতা নিয়েই অবস্থান করছে। একদিকে পঞ্চম বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালীর সমগ্র বিশ্বব্যাপী সুদৃঢ় অবস্থান, অন্যদিকে বাঙালী জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ পৃথিবীর সকল ‘বাঙালীর কেন্দ্র’ হিসেবে বিবেচিত হবে। বঙ্গ-বাংলা-বাঙালীর জীবনের লড়াই-সংগ্রামকে পাশ কাটিয়ে অনুকরণ প্রিয় ও গতানুগতিক সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পথচলা এক অনিশ্চিত ও পরিচয়হীনতার দিকে পর্যবসিত করছে।
ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার ভারতবর্ষের ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। আবার এই দু’টির প্রভা পড়েছে সামাজিক সম্পর্কের ওপর।…একটা নতুন ভাষা ও সাহিত্য তখনই গড়ে উঠতে পারে যখন তা সমাজের মানুষের কোনো গভীর প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করে, কারণ সাহিত্য ও সমাজের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
ইংরেজি রাজ ভাষা থেকে বহুজাতিক কোম্পানির ভাষা হয়েছে। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য হয়তো এখনো ইংরেজির প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু বাংলা বিসর্জন দিয়ে কিংবা বিকৃত করে নয়। দেশে থেকে মাতৃভাষার পরিবর্তে যারা অকারণে অপ্রয়োজনে ইংরেজির প্রয়োগ করে তাদের সে মিশ্রভাষা শুধু লোক দেখানোই নয়, বরং তাদের দূর্বল ভাষা ও চৈতন্যবোধ। বর্তমান বাংলা ভাষায় অকারণ ইংরেজির প্রভাব সমাজে শুধুমাত্র শ্রেণি বৈষম্যই বাড়াচ্ছে।
ইন্দিরা দেবিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশের লোক এত যে ইংরাজি সাহিত্য পড়েছে, কিন্তু তাদের অস্থিমজ্জার মধ্যে ভাবের প্রভাব প্রবেশ করতে পারে নি- তাদের ভাবের ক্ষুধাই জন্মায় নি, তাদের জড় শরীরের মধ্যে একটা মানস শরীর এখনো গঠিত হয়ে ওঠে নি, সেই জন্যে তাদের মানসিক আবশ্যক বলে একটা আবশ্যক বোধ নিতান্তই কম-অথচ মুখের কথায় সেটা বোঝবার জো নেই, কেননা বোলচাল সমস্তই ইংরাজী থেকে শিখে নিয়েছে। এরা খুব অল্প অনুভব করে, অল্প চিন্তা করে এবং অল্পই কাজ করে- সেই জন্যে এদের সংসর্গে মনের কোনো সুখ নেই।’
হাজার বছর ধরে শাসকগোষ্ঠি বাঙালির মানসপটে যে চিহ্ন একেঁছিলো, ক্ষতের মতো আজো সেই দাগ বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। বাঙালিরা বুঝতে শিখেছে পশ্চিমা ভাব ও পশ্চিমা চোখ দিয়ে দেখা রাজনৈতিক সংস্কৃতি বাঙালির প্রকৃত পরিচয় বহন করে না। বাঙালির স্বাধীন সত্তার মধ্যে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে লালন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মতো হাজারো প্রতিভাদীপ্ত দিক-নির্দেশনা। আজকের এই সময়ে বাঙালি মানস গঠনে ভাষা-সংস্কৃতিই হতে পারে বড় উপাদান।
পৃথিবীর সব দেশে সব কালেই ভাষা পরিবর্তনশীল এবং গতিময়। ভাষা বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে, সকল ভাষাই স্থান কালের পরিবর্তনে বদলায়। সময়, সভ্যতা, সংস্কৃতি, যুগের এমনকি রাজনৈতিক কারণেও ভাষার পরিবর্তন ঘটে। ১৮-১৯ শতকে ভাষা বদলেছিলো খুবই ধীরে, কিন্তু একুশ শতকে প্রযুক্তি আর বিশ্বায়নের অনিবার্য প্রভাবে ভাষা বদলে যাচ্ছে খুব দ্রুত।
বিশ্বায়নের গতির বেগে আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে। ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণা নির্ভর রীতি-নীতি, বিধি-ব্যবস্থাই অগ্রসরমান বাঙালি প্রধান বাধা। অতীতের মতো এই বাধাকে অতিক্রম করে ফাগুনের রক্তজবা, শিমুলের মতো ফুটে উঠবে তারুণ্য। জরাজীর্ণ এই দশা থেকে মুক্ত করে দেশজ চিন্তা-চেতনায় নতুন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করবে। ভাষা-সংস্কৃতির সমৃদ্ধির মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীর বাঙালির মৌলিক সৃষ্টি করবে, নতুন প্রজন্ম সেই পরিচয় দানের অহংকারে গর্বিত হবে। সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার একবিংশ শতাব্দিতে বিশ্ব মানচিত্রের বুকে একটি আত্মগৌরব সম্পন্ন জাতি হিসেবে চ্যালেঞ্জে জয়ী হবে।
লেখক : শব্দ সৈনিক।
1 Comment
Leave a Reply
Cancel Reply
Leave a Reply
This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.
সমৃদ্ধশালী একটি লেখা…………ভাল লাগলো……………