রোমান কবির:
নব্বই দশকের শেষে ও বিংশ শতকের শুরুতে আমাদের ছিলো এক ফ্যান্টাসির শৈশব। আমাদের এ শৈশবের রোমাঞ্চের সঙ্গী ছিলো হুমায়ূন আহমেদ। হ্যাঁ, তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাস আর তাঁর সৃষ্টি হিমু এবং শুভ্র আমাদের প্রশান্তি দেয়। বিশেষ করে তাঁর নির্মিত টেলিভিশন নাটক ও চলচ্চিত্রের মোহনীয়তা আবিষ্ট করে রাখে আমাদের শৈশবকে। যমুনার জল দেখতে ভালো স্নান করিতে লাগে ভালো- লেখা গানটি যখন আমাদের উচ্ছাস যোগায় তেমনি যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো অথবা চান্নি পসর রাইতে আমাদের মন কাঁদায়। উদাস মনে চোখের জল যেন গড়িয়ে পড়ে অজান্তেই।
আমাদের কৈশোরের সেই আবেগমাখা দিনগুলোর নিত্য সঙ্গী যৌবনের উদ্দামতার প্রেরণা, হিমু, মিসির আলী আর শুভ্র চরিত্রের স্রষ্টা তিনিই। নন্দিত নরকে আর শ্রাবণ মেঘের দিনেসহ অসংখ্য নান্দনিক চলচ্চিত্রের নির্মাতা জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। কালচারাল ইয়ার্ডের পক্ষ থেকে এই মহান সাহিত্য স্রষ্টা আর নির্মাণের কারিগরের প্রতি শ্রদ্ধা।
গাজীপুরে নিজের হাতে বানানো নুহাশ পল্লীর গাছপালা ঘেরা ফুল পাখিদের মাঝে থাকতে পছন্দ করতেন তিনি। জোৎস্নায় অবগাহন করতেন, সবাইকে নিয়ে গানে নাচে মেতে থাকতেন। ভুতের সাথে কাটাতেন রজনী। বিধাতার কাছে চেয়েছিলেন চান্নি পসর রাইতে যেন জীবনাবসান ঘটে। কিন্তু নিউইয়র্কের আকাশে সেদিন কোন চান্নি পসর ঘটেনি। ঝলমলে রোদের সুন্দর সকালে তাঁর সৃষ্টিদের বুকের মধ্যে সযতনে রেখে চিরবিদায় নেন তিনি। তবে বাংলার আকাশে সেদিন রাতের বিষন্নতা ও তাঁর ভক্তকুল ও হাজার হাজার হিমু-শুভ্রার চোখের জলে মিশে যায় চান্নি পসর রাইত।
তাঁর প্রিয় আঙিনা নুহাশপল্লীর লিচুতলায় নন্দিত এই নির্মাতাকে শুইয়ে দেয়া হয়।
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনায় জন্মগ্রহন করেন হুমায়ুন আহমেদ। বাবা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়শা ফয়েজ।
পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। রসায়ন শাস্ত্রের শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কালজয়ী উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ ও ‘শঙ্খনীল কারাগারের’ মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে আগমন। তিনি প্রায় তিন শতাধিক গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। রচনা করেছেন নাটক, নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্র। জনপ্রিয়তায় উঠেছেন সবার শীর্ষে।
তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন, বানিয়েছেন চলচ্চিত্র। তিনি লিখেছেন জোৎস্না ও জননীর গল্প, ১৯৭১, সূর্যের দিনের মতো উপন্যাস। বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বেসরকারি টেলিভিশনগুলোতে নির্মাণ করেন নাটক এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই।
আগুনের পরশমনি, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, শ্যামলছায়ার মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তিনি। তাঁর পরিচালিত সর্বশেষ সিনেমা ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ জনপ্রিয়তায় ছাড়িয়ে যায়।
হুমায়ূন আহমেদকে স্মরণ করছে বাঙালি জাতি। শত শত হিমু হলুদ পাঞ্জাবিতে অশ্রুসিক্ত বদনে হুমায়ূন স্মরণে। নুহাশপল্লীতে আয়োজন করা হয়েছে কোরআন খানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের। মাদরাসা ও এতিমখানার ছাত্রদের খাওয়ানো হবে। এ আয়োজনে তাঁর পরিবার, স্বজন আর বন্ধু বান্ধবরা থাকছে।
এদিকে তাঁর জন্মস্থান নেত্রকোনায় নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপিটের আয়োজনে মিলাদ, দোয়া মাহফিল, শোভাযাত্রা ও আলোচনা-সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দেয়া হচ্ছে কোরান খতম।
হুমায়ূন আহমেদ আমাদের মন কাঁদছে। যদি তোমার মন কাঁদে তবে চলে এসো এক বরষায়।
লেখক: সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা