বিশেষ প্রতিনিধি:
বাংলাদেশ ও ভারতের চলচ্চিত্রের একজন মোহনীয় অভিনয়শিল্পী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। তথাকথিত বাণিজ্যিক ধারা ও শৈল্পিক সিনেমায় সমানতালে অভিনয় করে গেছেন গত তিন দশক। জীবনমুখী চলচ্চিত্রের মোহনীয় ও মুগ্ধতা ছড়ানো অভিনয়ে তিনি সৌরভ ছড়িয়েছেন। আবেদন তৈরি করেছেন চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষদের মনে।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের শুরুটা হয়েছিলো প্রভাত রায়ের শৈল্পিক সিনেমা ‘শ্বেতপাথরের থালা’ দিয়ে। যা ১৯৯২ সালে মুক্তি পায়। এ ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। এরপর করেছেন উপমহাদেশের গুণী নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি ‘দহন’, যা ১৯৯৭ সালে মুক্তি পায়। এর জন্যও তাঁর ঝুলিতে জমা হয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমা ‘উৎসব’ ও অপর্ণা সেনের ‘পারমিতার একদিন’ শিল্পী হিসেবে তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। শৈল্পিক অভিনয়ে মুগ্ধতা ছড়ানো এ অভিনেত্রী ভারত ও বাংলার অসংখ্য মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমায় অভিনয় করে নায়িকা হিসেবেও নিজের আবেদন ছড়িয়ে গেছেন।
১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন এই অভিনয়শিল্পী। আজকে তাঁর জন্মদিন। এই দিনে কালচারাল ইয়ার্ড পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। এ দিনে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের কিছু বাংলা শৈল্পিক সিনেমা ও হিট সিনেমায় তাঁর মুগ্ধতা ছড়ানো অভিনয়ের কিছু দিক নিয়ে আলাপের প্রয়াস নেবো।
গুণী চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষের নির্মিত সিনেমা ‘দহন’। যে সিনেমার পোস্টারেই চোখে পড়ে বড় করে এক মধ্যবিত্ত দু:খীনি নারীর অভিব্যাক্তি। জগত সংসারের সকল যন্ত্রনা ও অপমানের ভার সহ্য না রতে পেরে সেই নারীর অভিব্যাক্তি মনে এনে দেয় এক অন্যরকম দ্যেতোনা।
ছবিটিতে শ্লীলতাহানীর শিকার এক নববিবাহিতা নারীর চরিত্রে অভিনয় করেন ঋতুপর্ণা। চরিত্রে নাম রোমিতা। রোমিতা এক মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত হিন্দু একান্নবর্তী পরিবারের গৃহবধূ। সেই পরিবারে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, ভাসুর-জা ও তাদের সন্তান এবং স্বামীকে নিয়ে রোমিতার সংসার জীবন। স্বামীর অফিসে আসা-যাওয়া, সংসার, রোববারে ছুটির দিনে ঘুরতে যাওয়া, শপিং মলে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে সংসারের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলাপ। স্বামী সংসারের গল্প করে বড় বোনকে চিঠি লেখা। এ ব্যপারগুলোর মধ্যে একজন আদর্শ গৃহবধূর চিত্রায়ন নিজের মধ্যে ধারণ করেন ঋতুপর্ণা। এর মধ্যেই ঘটে এক রোহমর্ষক ঘটনা। স্বামীর সঙ্গে শপিং শেষে মেট্রো স্টেশনে এক দল যুবকের শ্লীলতাহানির শিকার হন। সে ঘটনায় বেঁচে গেলেও এ ঘটনার পর থেকেই স্বামীর সঙ্গে একধরণের দূরত্ব তৈরি হয়। ইতিবাচক দিকের থেকে স্বামীর নেতিবাচক দিকগুলোই ফুটে উঠতে থাকে। কথা কথায় স্বামীর কথার খোঁচা সইতে হয় তাকে। একসময় পারিবারিক ও সামাজিক যাতনায় দগদগে ক্ষত নিয়ে স্বামীর সঙ্গে বচসা হয়। সেখানে ঘরের মধ্যে মেকাপহীন রাতের পোশাকে মধ্যবিত্ত ঋতুপর্ণের অভিব্যাক্তি মুগ্ধতা সীমা যেন ছাড়িয়ে যেতে চায়। ছবিটিতে ঋতুপর্ণ শুধু একজন রোমিতার চরিত্রই নয়, সে চরিত্রটি মধ্যবিত্ত হাজার হাজার বাঙালি নারীর প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠে সত্যিকার অর্থেই। ছবিটির জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের আরও খবর
⇒ শুটিং করতে ঢাকায় আসছেন কলকাতার ঋতুপর্ণা
⇒ ফেরদৌস-পূর্ণিমা, শুভ-ঋতুপর্ণাকে নিয়ে ‘জ্যাম’
ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উৎসব’ সিনেমায় একজন ছন্নছাড়া চিত্রশিল্পী টলিউডের বুম্বাদা প্রসেনজিৎ চট্রোপাধ্যায়ের স্ত্রীর চরিত্রে ছিলেন তিনি। ছবিটিতে একান্নবর্তী পরিবারের ছোট মেয়ে কেয়ার চরিত্রে অভিনয় করেন। ছবিটিতে প্রেম করে বিয়ে করা স্বামীর সঙ্গে পরবর্তীতে টানাপোড়েন ও এ থেকে পরিত্রাণের জন্য নিজের মনের সাথে লড়াই চালিয়ে যাওয়া এক আধুনিক নারীর প্রতিরুপ তিনি।
তাঁর অভিনীত আরেকটি সিনেমা অপর্ণা সেন পরিচালিত ‘পারমিতার একদিন’। এটিও একটি একান্নবর্তী পরিবারের গল্প। যে ছবিটিতে একজন আধুনিক নারীর প্রতিকৃতি ধরা পড়ে ঋতুপর্ণার মধ্যে। নারীর প্রতি সংসার জীবন ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি উঠে আসে। এ দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে নিজের যে লড়াই তা বোধের একটা জায়গা করে দেয় সবার মধ্যে।
সত্যজিতের চারুলতার অনুকরণে অগ্নিদেব চট্টোপাধ্যায় নির্মিত ‘চারুলতা’ (২০১১) সিনেমায় চারুলতার ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় দেখার মতো। এ যুগের আধুনিক চারুলতার রুপান্তর ঘটেছে যেন। এক যুগ পেরিয়ে বুম্বাদার সঙ্গে প্রাক্তন সিনেমায় রুচিশীল ভদ্র আধুনিক নারীর চরিত্রে ও বেলাশেষের মধ্যবিত্ত শহুরে আধুনিক নারীর চরিত্র কিংবা ‘রাজকাহিনী’ ও ‘রাতের রজনী গন্ধা’ সিনেমার অন্ধকার জগতের পতিতা চরিত্র স্থান, পাত্র অনুযায়ী নিজেকে সাজিয়ে নেয়া ঋতুপর্ণা অনন্য। এছাড়া বাংলাদেশে অভিনীত ‘সাগরিকা’ ও ‘রাঙা ভাবী’ কিংবা এ যুগের ‘একটি সিনেমার গল্প’ ছবিগুলোতে নায়িকার গ্লামার, মোহনীয়তা ও আবেদনময়ী হিসেবে সেরার স্থান ঋতুপর্ণাকে দেওয়াই যায়।
বাংলা ধারাবাহিক সাদা পায়রা (১৯৮৯) দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু করেন। মুম্বাইতে হেমা মালিনীর সঙ্গে মোহিনী নামের একটি টেলিফিল্মেও অভিনয় করেন। বলিউডের সিনেমা তিসরা কৌন সিনেমায় নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করে পরিচিতি পান হিন্দি সিনেমায়ও। এরপর বেশকিছু হিন্দি সিনেমা করেছেন। বাংলায় সুজন সখী, নাগপঞ্চমী, মনের মানুষ ও সংসার সংগ্রাম’র মতো হিট সব সিনেমায় অভিনয় করেছেন। বাংলাদেশে সাগরিকা নামে একটি ছবিত অভিনয় করেন। সেই ছবিতে কিছু বোল্ড দৃশ্যে অভিনয়ের কারণে সমালোচিতও হতে হয় তাকে। আরেকটি সমালোচিত বাংলাদেশী সিনেমা রাঙাভাবী-তে অভিনয় করেন হুমায়ূন ফরিদীর সঙ্গে। সেই ছবিটিও বাংলাদেশী সিনেমার প্রথম অশ্লীলতার খেতাব পায়। তবে তার এই সমালোচনা ছাপিয়ে তিনি ভারত ও বাংলাদেশী একজন গুণী অভিনেত্রী ও আবেদনময়ী নায়িকা হিসেবে প্রসিদ্ধ।
তিনি বেশকিছু পুরস্কার অর্জন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে, ভারত নির্মাণ পুরস্কার (১৯৯৫), কলাকার পুরস্কার (১৯৯৬), কাজী নজরুল ইসলাম জন্মশতবার্ষিকী পুরস্কার (১৯৯৬), ৪২তম ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অন্যতম।
তাঁর জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে আছে, শ্বেতপাথরের থালা, দহন, পারমিতার একদিন, উৎসব, মন্দ মেয়ের উপাখ্যান, দিল তো বাচ্চা হ্যায় জি, নেকলেস, আগুন পাখি, চারুলতা, তিন কন্যা, বেলা শেষে, রাজকাহিনী, তদন্ত, প্রাক্তন, রাতের রজনী গন্ধা, সিঁদুর খেলা, আমি সেই মেয়ে, মধুমালতী, স্বামী কেন আসামী, রাঙা বউ, তিসরা কৌন।