বিশেষ প্রতিবেদক:
বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক বৈপ্লবিক দিন আজ। ১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্যারিস শহরে প্রথমবারের মতো সেলুলয়েডের পর্দায় প্রদর্শিত হয় সিনেমা। প্যারিসের দুই ভাই লুই লুমিয়ের ও অগাস্ত লুমিয়ের প্রথম এই প্রদর্শনী করে বিশ্বে তাক লাগিয়ে দেয়। এর আগে চলচ্চিত্র নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে। মুভিং ক্যামেরা নিয়ে গবেষণা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফলতা এসেছে লুমিয়ের ভাইদের হাত ধরে। সে সময় লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় ছোট ছোট দশটি ১ মিনিটের ছবি নিয়ে বাণিজ্যিক প্রদর্শনী করেন।
প্যারিসের গ্র্যান্ড ক্যাফেতে অনুষ্ঠিত এ প্রদর্শনীতে এতে অনেক মানুষের সমাগম ঘটে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে সে সময় চলচ্চিত্র দেখেন প্যারিসের মানুষ। এরপরই পুরো বিশ্বে রব উঠে যায়। শুরু হয় প্যারিসের বাইরে প্রদর্শনী। নানা বিবর্তন ও উৎকর্ষতার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আজ চলচ্চিত্র একটি নবীন শিল্পমাধ্যম ও বিনোদন মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। সেদিনের এ বিপ্লবকে স্মরণ করে দেশে বিদেশের অসংখ্য চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষ। যদিও এ উপলক্ষে স্বীকৃত কোন দিবস বিশ্বে পালিত হয় না। তবে বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে এ দিবসটি পালন করছে বিভিন্ন চলচ্চিত্র সংসদ, চলচ্চিত্রকর্মী ও চলচ্চিত্রপ্রেমীরা।

বিশ্ব চলচ্চিত্র দিবস
চলচ্চিত্র নির্মাণ যখন শুরু হয় তখন তা ছিলো সাদাকালো কয়েক সেকেন্ডের এক শটের কিছু নির্বাক চিত্র। এ সব ছবিগুলো তখন লুই লুমিয়ের ব্রাদার্সরা বিভিন্ন দেশে প্রদর্শন করে থাকে। এই ভারতীয় উপমহাদেশেও তখন লুমিয়ের ব্রাদার্সদের প্রতিনিধিরা ছবি প্রদর্শন করেন। সে সময়ই আমাদের মানিকগঞ্জের ছেলে হীরালাল সেন চলচ্চিত্র শিক্ষা নিয়ে ছবি প্রদর্শন ও বানাতে শুরু করেন।
লুই লুমিয়ের থেকে মেলিয়ের এর হাত ধরে চলচ্চিত্র এগিয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯০০ সালের দিকে চলচ্চিত্রে আরেকটি বিপ্লব সাধন করেন ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ। তিনি প্রথম একাধিক শটকে জোড়া দিয়ে প্রথম সম্পাদনা কৌশলের মাধ্যমে ছবি বানাতে থাকেন। ডি ডব্লিউ গ্রিফিথই মার্কিন চলচ্চিত্র শিল্পের গোড়াপত্তন করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস এঞ্জেলেস শহরের প্রান্তে তার প্রচেষ্টাই হলিউড গড়ে উঠে। যা পরবর্তীতে বিশ্ব চলচ্চিত্রের মূল বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র কেন্দ্র হয়ে উঠে।
লুই লুমিয়ের নির্মিত ও প্রদর্শিত প্রথম ছবি ছিলো ‘ওয়ার্কার্স লিভিং দ্য লুমিয়ের ফ্যাক্টরি’। ৩৫ এমএম ফরম্যাটে নির্মিত ১৭ মিটার দৈর্ঘ্যের এই চলচ্চিত্রটির ব্যাপ্তি ছিলো মাত্র ৪৬ সেকেন্ড। এক মিনিটেরও কম সময়ের এই সিনেমাতে দেখা যায়, লুমিয়েরের কারখানা থেকে শ্রমিকরা বের হচ্ছেন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন নারী।
লুমিয়েরদের চলচ্চিত্র ছিলো একবারে বাস্তব জীবনের টুকিটাকি চিত্র। সে সময় ছবিতে ফ্রান্সের জীবনযাত্রার চিত্রই তুলে ধরা হতো।
বিশ্ব চলচ্চিত্র দিবসের আরও খবর
⇒ চলচ্চিত্র যাত্রার দিন
লুমিয়েরদের নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে: জাম্পিং অন টু দ্য ব্লাংকেট, কার্ডিয়ার্স স্কোয়ার ইন লিয়ঁ, বাথিং ইন দ্য সি, হর্স ট্রিক রাইডার, ফিশিং ফর গোল্ডফিশ, দ্য ডিজএমবার্কমেন্ট অফ দ্য কংগ্রেস অফ ফটোগ্রাফার্স ইন লিয়ঁ, ব্লাকস্মিথস্, দ্য গার্ডেনার, বেবি’স ব্রেকফাস্ট, কার্ড গেম, অ্যারাইভাল অফ অ্যা ট্রেন।
এই চলচ্চিত্রযাত্রার স্বপ্ন বোনা মূলত শুরু করেছিলেন লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের পিতা আন্তোনি লুমিয়ের। ১৮৯০ সালে মার্কিন উদ্ভাবক টমাস আলভা এডিসন ও তাঁর সহযোগী উইলিয়াম ডিকসন প্রথম চলচ্চিত্র ধারণ করার মতো ক্যামেরা তৈরি করেন। তারা যার নাম দেন কিনেটোগ্রাফ। পরের বছর তাঁরা তৈরি করেন কিনেটোস্কোপ। ১৮৯৪ সালে ফরাসি নাগরিক আন্তোনি লুমিয়ের এডিসনের কিনেটোস্কোপের একটি প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন। কিনেটোস্কোপ দেখে মুগ্ধ হয়ে তিনি ফটোগ্রাফিক প্লেটের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত দুই ছেলেকে এমন একটি যন্ত্র তৈরির বুদ্ধি দেন, যা দিয়ে একসঙ্গে অনেকে মিলে চলচ্চিত্র দেখতে পারে। বাবার উৎসাহে ফ্রান্সের লিঁও নিবাসী দুই ভাই লেগে পড়েন এমন এক যন্ত্র তৈরির কাজে।
১৮৯৫ সালের মার্চ মাসে তারা একটি ক্যামেরা প্রজেক্টর তৈরি করে ফেলেন। তারা এর নাম দেন সিনেমাটোগ্রাফ। আবিষ্কারের পর তারা প্রায় নয় মাস যন্ত্রটি দিয়ে প্রথম পরীক্ষা চালান। এরপর প্রথম নিজেদের কারখানার শ্রমিকদের ছবি তুলে তৈরি করেন সিনেমা। এভাবেই চলচ্চিত্র শিল্পের বুনিয়াদ তৈরি হয়। তাদের সিনেমা জীবনের কথা বলতো। পারিপার্শ্বিক মানুষের জীবনের চিত্র তুলে আনত। মাত্র একশ বছরের এই শিল্প সত্যিই সত্যিই এখন শিল্পের এক শক্তিশালী মাধ্যম। বিনোদন ও গণমাধ্যম হিসেবেও শীর্ষে এর অবস্থান।
বিশ্ব চলচ্চিত্র দিবসের কোন স্বীকৃতি নেই। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিজেদের মতো করে বিশ্ব চলচ্চিত্র দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশেও বেশ কয়েক বছর ধরে এই দিবস পালন করা হচ্ছে। এই দিবসকে আন্তর্জাতিকভাবে জাতিসংঘের স্বীকৃতির জন্যও দাবি তোলা হয়েছিলো।