নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলার নাট্যাঙ্গনের মেধাবী নির্দেশক ও অভিনেতা আলী যাকের। মঞ্চে ‘গ্যালিলিও’ চরিত্রে অভিনয় করা অনবদ্য অভিনেতা মারা গেলেন ২৭ নভেম্বর শুক্রবার সকাল সাড়ে ৬টায়। চিরবিদায় ‘গ্যালিলিও’ আলী যাকের। মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র অভিনেতা, বিজ্ঞাপন প্রযোজক আলী যাকেরের মৃত্যুতে শোকাহত বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গন।
কালচারাল ইয়ার্ড পরিবার কিংবদন্তিতুল্য সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব আলী যাকেরের মুত্যুতে শোকাহত।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে কোভিড-১৯ সতর্কতায় তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোয় কোন সমাবেশ করা হচ্ছেনা। তবে তাঁকে তাঁর প্রিয় প্রাঙ্গন মুক্তিযযুদ্ধ জাদুঘরে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি একজনন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের একজন ট্রাস্টি। সেখানে প্রবেশ খুবই সীমিত। কারণ তিনি করোনা পজেটিভ ছিলেন।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে গণমাধ্যমে সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিরা আলী যাকেরের প্রয়াণে শোক প্রকাশ করছেন।
আলী যাকেরের বিখ্যাত মঞ্চনাটক ‘গ্যালিলিও’কে স্মরণ করে অভিনেত্রী অপি করিম স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘গুডবাই মাই গ্যালিলিও।’ মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করছি।
এ সময় অভিনেতার সঙ্গে তোলা একটি ছবি শেয়ার করেন তিনি।
চলচ্চিত্র ও নাট্যনির্মাতা মাসুদ হাসান উজ্জ্বল তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘২০২০ সালটা ভয়ানক! আমাদের চারপাশ আস্তে আস্তে খালি হয়ে যাচ্ছে! একজন আলী যাকের এমন একটি প্রজন্মের অভিনেতা এমন একটি প্রজন্মের প্রতিনিধি, যাদের কারণে অভিনয় শিল্প বা পেশাকে খুব উঁচুমানের বা সম্মানজনক মনে হতো, এখন যেই সম্মান সম্ভবত জাদুঘরে থাকে! ওপারে ভালো থাকুন প্রিয় শিল্পী।’
অভিনেত্রী জয়া আহসান তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘আলী যাকের চলে গেলেন, কিন্তু বাংলাদেশের মঞ্চকে রেখে গেলেন আরও অনেক উঁচু করে-অভিনয়ে, সংগঠনে, প্রবর্তনে। দীর্ঘাঙ্গ ছিলেন। শুধু শারীরিক অর্থে নয়, শিল্পের উচ্চতায়ও। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তার অনুপ্রেরণা মঞ্চে এনেছেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় দিয়েছেন তার পূর্ণতা। অভিবাদন, শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা।’
হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত টেলিভিশন নাটক ‘আজ রবিবার’র বড় চাচা হয়ে অভিনয় করেছিলেন আলী যাকের। নাটকে শীলা আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওন ছিলেন তাঁর ভাতিজি। তিনজনের একটি ছবি শেয়ার করে অভিনেত্রী শাওন লেখেন, ‘বড়চাচা…।’
অভিনেতা ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘বাংলা নাটকের বিস্ময়কর অভিনেতা এবং নির্দেশক আলী যাকের আজ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। আমিন।’
বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন আলী যাকের। এরপরও তিনি মঞ্চে ফিরে এসেছিলেন ‘গ্যালিলিও’ হয়ে। আবারও মঞ্চ কাঁপিয়েছিলেন ‘বিদ্রোহী নূরলদীন।’
১৯৭২ সালে আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকের মাধ্যমে অভিনয়জীবন শুরু করেন। এরপর যোগ দেন নাট্য সম্প্রদায়ে। যেখানে আতাউর রহমানের নির্দেশনায় ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকে অভিনয় করেন তিনি।
বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকে প্রথম নির্দেশনা দেন তিনি। এটি ছিল বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনী।
তাঁর মঞ্চে অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে : ‘এই নিষিদ্ধ পল্লীতে আলী’, ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’, ‘গ্যালিলিও’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘টেমপেস্ট’, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘অচলায়তন’, ‘বিদগ্ধ রমণী কুল’, ‘তৈল সংকট’, ‘কোপেনিকের ক্যাপ্টেন’ প্রভৃতি।
টেলিভিশনের পর্দায় হুমায়ূন আহমেদের ‘বহুব্রীহি’ ও ‘আজ রবিবার’ নাটকে অভিনয় করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করেন তিনি। এছাড়া তাঁর অভিনীত একক নাটক ‘নীতু তোমাকে ভালোবাসি’, ‘অচিনবৃক্ষ’, ‘আইসক্রিম’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘পাথর সময়’, ‘গণি মিয়ার পাথর’ ইত্যাদি।
চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও খ্যাতির চূড়ায় ছিলেন তিনি। তাঁর অনবদ্য অভিনয় ছিলো ‘আগামী’, ‘নদীর নাম মধুমতী’, ‘লালসালু’ ও ‘রাবেয়া’ চলচ্চিত্রে।
১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর রতনপুর গ্রামে জন্ম। বাবা আবু তাহের ও মা রিজিয়া তাহের। স্ত্রী নাট্যজন সারা যাকের, ছেলে অভিনেতা ইরেশ যাকের ও কন্যা শ্রিয়া সর্বজয়া।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি আলী যাকের। ১৯৯৯ সালে শিল্পকলায় অবদানের জন্য দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন এই বিদগ্ধজন।
এছাড়া আলী যাকের অর্জেন করেছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদক এবং মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার।