কালচারাল ইয়ার্ড ডেস্ক:
ঢাকাই সিনেমার কিংবদন্তি চিত্রনায়ক সালমান শাহ। জনপ্রিয় এই নায়কের রহস্যময় মৃত্যু আজও বয়ে চলেছে প্রশ্নের ভার। ২৯ বছর পেরিয়ে গেছে, তবে স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে সিনেমাপ্রেমী ঢাকাবাসীর মননে। আতনহত্যা নাকি হত্যা এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আবারও নতু মোড় নিলো এর তদন্ত।
২০ অক্টোবর সোমবার ঢাকার ষষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ জান্নাতুল ফেরদৌস ইবনে হক এক আদেশে জানিয়েছেন সালমান শাহের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করতে হবে। এই নির্দেশের মাধ্যমে, প্রায় তিন দশক পর আবার নতুন করে খোলা হচ্ছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত মৃত্যু-রহস্যের দরজা।
আদালতের নির্দেশে বলা হয়, সালমান শাহের মা নীলা চৌধুরীর করা রিভিশন আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছে। একই সঙ্গে এই মৃত্যুকে “হত্যা মামলা হিসেবে” পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রমনা থানাকে। নীলা চৌধুরীর আইনজীবী ফারুক আহমেদ জানিয়েছেন, ২০২১ সালে পিবিআইয়ের দেওয়া ৬০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে আত্মহত্যা উল্লেখ থাকলেও সেটিকে “নিরপেক্ষ তদন্ত নয়” বলে আদালতে আপত্তি জানান সালমানের মা। আজ সেই আপত্তিই আদালত মঞ্জুর করল।
“সালমান শাহ আত্মহত্যা করেননি, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে”— আদালত প্রাঙ্গণে আবেগভরা কণ্ঠে বলেন সালমানের মামা, চিত্রপরিচালক আলমগীর কুমকুম। “এই রায়ের মাধ্যমে আমরা ন্যায়বিচারের নতুন আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।”-যোগ করেন তিনি।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, রাজধানীর নিউ ইস্কাটন গার্ডেনের ভাড়া বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় সালমান শাহের লাশ। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৫। স্ত্রী সামিরা হক জানান, সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি সালমানকে ড্রেসিংরুমে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় পান। পুলিশ পরে ঘটনাটিকে “অপমৃত্যু” হিসেবে লিপিবদ্ধ করে। তবে শুরু থেকেই এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে বিতর্ক ওঠে। পরিবার ও ভক্তদের দাবি ছিল, এটি আত্মহত্যা নয়— নিপুণভাবে সাজানো হত্যা।
১৯৯৬ রমনা থানা অপমৃত্যুর মামলা দায়ের হয়। ১৯৯৭ সিআইডি আত্মহত্যা বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। ২০০৩ সালে আদালত বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ২০১৪ সালে বিচার বিভাগীয় তদন্ত পুনরায় “অপমৃত্যু” হিসেবে উল্লেখ করেন। ২০১৬ আদালতের নির্দেশ পিবিআইকে নতুন তদন্তে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২১ সালে পিবিআই ৬০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে আত্মহত্যা হিসেবে উল্লেখ করেন। ২০২৫ সাল আদালত হত্যা মামলা দায়েরের নির্দেশ দিয়েছেন।
সালমান শাহের মৃত্যু শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়; এটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। যে সময় তিনি মারা যান, বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি ছিলেন আধুনিক নায়কত্বের প্রতীক— স্টাইল, সংলাপ, ও অভিনয়ে এক নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন। তবে মৃত্যুর পর থেকে চলা বিতর্কে প্রকাশ পায়— দেশের তদন্ত কাঠামো, প্রমাণ বিশ্লেষণ ও ন্যায়বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা কতটা প্রভাব ফেলেছে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরিতে। প্রতিটি তদন্তই যেন নতুন করে জাগিয়েছে পুরোনো প্রশ্ন— “সালমান শাহ কি সত্যিই আত্মহত্যা করেছিলেন?”
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিবেদন ও সাক্ষ্য এসেছে বিপরীতমুখী ফল নিয়ে। বিশেষ করে ১৯৯৭ সালে রিজভি আহমেদ নামে এক আসামির আদালতে দেওয়া জবানবন্দি, যেখানে তিনি সালমানকে “হত্যা করার পর আত্মহত্যার নাটক সাজানো হয়েছে” বলে স্বীকার করেছিলেন।
সালমান শাহ ছিলেন ১৯৯০-এর দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের পুনর্জাগরণের মুখ। ‘কে তোমার হৃদয়ে, আনন্দ অশ্রু, সুজন সখী, বিক্ষোভ’— প্রতিটি সিনেমায় তিনি দর্শকদের হৃদয়ে এক অনন্য ছাপ রেখে যান। তাঁর মৃত্যু যেন পুরো প্রজন্মের কাছে ছিল একটা ব্যক্তিগত ক্ষতি। প্রতিবছর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে হাজারো ভক্ত সামাজিক মাধ্যমে ও সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা জানায়।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, আদালতের এই নির্দেশের মাধ্যমে মামলা এখন নতুনভাবে হত্যা মামলার ধারা অনুযায়ী তদন্ত হবে।
এর মানে হলো, পূর্ববর্তী তদন্ত প্রতিবেদনগুলো পুনর্মূল্যায়ন করা হবে, সাক্ষীদের পুনরায় ডাকা হতে পারে এবং ফরেনসিক প্রমাণ নতুন করে যাচাই করা সম্ভব।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়— প্রায় তিন দশক পর কতটা প্রমাণ এখন উদ্ধারযোগ্য? কীভাবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব?বাংলা সিনেমার ইতিহাসে সালমান শাহ শুধু একজন তারকা নন— তিনি এক প্রজন্মের আবেগ, এক অপূর্ণ প্রতিশ্রুতির প্রতীক। এই মামলার পুনরুজ্জীবন শুধু তাঁর পরিবারের ন্যায়বিচারের আশা নয়, বরং একটি দেশের সাংস্কৃতিক বিবেকের দাবি। “সালমান শাহ হয়তো চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যু এখনো এক জীবন্ত প্রশ্নচিহ্ন।”