কালচারাল ইয়ার্ড ডেস্ক:
সেই সেপ্টেম্বরের সকালটা আজও ভুলতে পারছে না আসাম। ১৯ সেপ্টেম্বর, সিঙ্গাপুরের এক হাসপাতাল থেকে এলো এক মর্মান্তিক খবর—জীবনের মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন জুবিন গার্গ। মাত্র ৫২ বছর বয়সে থেমে গেল অসমের সেই জাদুকরী কণ্ঠ, যিনি শুধু গায়ক নন, ছিলেন এক সংস্কৃতির প্রতীক, এক যুগের অনুভূতি।
আজ, ঠিক সেই দিনে—৩১ অক্টোবর—মুক্তি পেল তাঁর স্বপ্নের অসমিয়া চলচ্চিত্র ‘রই রই বিনালে’। এ যেন মৃত্যুর পরও জীবনের প্রতি তাঁর ভালোবাসার চূড়ান্ত প্রকাশ। প্রেক্ষাগৃহে আজ অদ্ভুত এক দৃশ্য—ভক্তদের চোখে জল, মুখে নীরব হাসি। কেউ পর্দায় তাকিয়ে বলছেন, “জুবিনদা বেঁচে আছেন। এই গানে, এই কণ্ঠে, এই আলোয়।”
অসম্পূর্ণ স্বপ্নের পূর্ণতা
পরিচালক রাজেশ ভূঞা বললেন,
“এই ছবিটা জুবিনদার একান্ত প্রিয় ছিল। গল্প, সুর, গানের কথা—সব কিছুতেই তাঁর আত্মার ছোঁয়া।”
তিন বছরের পরিশ্রমে তৈরি এই ছবিতে জুবিন গার্গের হাতের ছাপ রয়ে গেছে প্রতিটি ফ্রেমে। মৃত্যুর আগে তিনি ছবির সমস্ত গান ও সংলাপ নিজের গলায় রেকর্ড করেছিলেন—ল্যাপেল মাইকে, পরম যত্নে। তাই প্রেক্ষাগৃহে দর্শকরা পাচ্ছেন তাঁর আসল কণ্ঠ, সেই জীবন্ত কম্পন, সেই উষ্ণতা।
“আমরা কোনও ডাবিং করিনি,” বলেন ভূঞা,
“চেয়েছি দর্শক যেন জুবিনদার নিজের কণ্ঠেই তাঁকে অনুভব করতে পারেন।”
এ যেন এক অনন্ত প্রত্যাবর্তন—জীবনের পর্দা থেকে মৃত্যুর পর্দায়।
ভক্তদের উচ্ছ্বাসে আবেগ, কিছু ক্ষোভও
মুক্তির দিন সকাল থেকেই আসামজুড়ে উৎসবের আমেজ। প্রেক্ষাগৃহে লাইন, পোস্টারে ফুল, হাতে মোমবাতি।
ভক্তদের মুখে একটাই কথা—“শেষবারের মতো তাঁকে দেখতে এসেছি।” তবে উচ্ছ্বাসের ভেতরও উঠেছে কিছু ক্ষোভ। মুক্তির আগেই অনেক প্রেক্ষাগৃহে টিকিটের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়।
এক ভক্ত সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন,
“জুবিনদা বেঁচে থাকলে এমনটা হতে দিতেন না। তিনি ছিলেন মানুষের শিল্পী, ব্যবসার নয়।”
আয়োজকেরা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, দর্শকের বিপুল আগ্রহ সামলাতে অতিরিক্ত প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা খরচ বেড়েছে।
কিন্তু সাধারণ দর্শকের কাছে এই যুক্তি সান্ত্বনার চেয়ে ক্ষোভই বাড়িয়েছে।
গান, সিনেমা, ভালোবাসা—সব সীমানা পেরিয়ে
জুবিন গার্গ ছিলেন শুধু একজন গায়ক নন, একটা সময়ের আবেগ। হিন্দি-বাংলা-অসমিয়া, হিন্দু-মুসলিম—সব ভেদরেখা পেরিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন “সবার শিল্পী”। ‘গ্যাংস্টার’-এর “ইয়া আলী” গান তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল সারা ভারতের শ্রোতার হৃদয়ে।
চল্লিশেরও বেশি ভাষায় গান গেয়েছেন তিনি—হিন্দি, বাংলা, তামিল, তেলেগু, মারাঠি, নেপালি, এমনকি বিভিন্ন আঞ্চলিক উপভাষায়ও।
জাতীয় পুরস্কার পাওয়া চলচ্চিত্র ‘ইকোজ অব সাইলেন্স’-এর জন্য তিনি পেয়েছিলেন সেরা সংগীত পরিচালকের সম্মান।
তবু তাঁর আসল পুরস্কার ছিল মানুষের ভালোবাসা—যা আজও প্রতিধ্বনিত হয় অসমের আকাশে, রেডিওর তরঙ্গে, প্রেক্ষাগৃহের চোখের জলে।
শেষ সুরে জীবনের ছোঁয়া
আজ যখন প্রেক্ষাগৃহে জ্বলে ওঠে পর্দা, বাজে সেই কণ্ঠ—
“রই রই বিনালে…”
তখন বোঝা যায়, কিছু মানুষ কখনোই মরে না।
জুবিন গার্গ চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর সুর, তাঁর ভাষা, তাঁর হাসি—সব রয়ে গেছে মানুষের হৃদয়ে,
এক চিরন্তন প্রার্থনার মতো।