অনুপম হায়াৎ:
লেখক, গবেষক, সাংবাদিক ও শিক্ষক অনুপম হায়াৎ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন। চলচ্চিত্র বিষয়েও ডিগ্রি নিয়েছেন। ছিলেন টিসিবির সাবেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্য ও চলচ্চিত্রের জুরি বোর্ডের সদস্যও হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে চলচ্চিত্র বিষয়ে শিক্ষকতা করেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রীন বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, ঢাকা ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে। তিনি বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের ফেলো। তাঁর লেখা ‘ঈদ উৎসবের ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থে প্রকাশিত ‘ঈদের প্রথম নাটক’ শিরোনামের এই লেখাটি ‘কালচারাল ইয়ার্ড’ এর পাঠকদের জন্য হুবাহু দেয়া হলো।
কাজী নজরুল ইসলাম যেমন ঈদ নিয়ে প্রথম গান লিখেছেন, তেমনি তিনি ঈদ নিয়ে লিখেছেন প্রথম নাটকও। এই নাটকটির নাম ‘ঈদুল ফেতর’। ঘটনাটি সম্ভবত: মুসলিম বিশ্বের মধ্যেও প্রথম। এটি প্রথম রেকর্ড-নাট্যও।
‘ঈদুল ফেতর’ রেকর্ড-নাট্য ১৯৩৬ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত হয় রেকর্ড নং এন ৯৮২৩-৯৮২৪)। নাটিকার কুশীল হচ্ছে ফকির জমিদার, ইমতাজ, বদনার মা ও পথচারী : এতে তিনটি গান রয়েছে।
১. ফুরিয়ে এল রমজানেরই মোবারক মাস (ফকির)
২, ঈদের খুশীর তুফানে আজ (সমবেত)
৩. প্রাণের প্রিয়তম (ফকির)
রেকর্ড নাট্যে অংশ নেন ধীরেন দাস (ফকির), আশ্চর্যময়ী (বদনার মা)।
নজরুল এই নাটিকায় একজন তথাকথিত নামাজী ও রোজাদারের কৃপণতা, ফকিরের প্রতি দুর্ব্যবহার, পরিণামে একমাত্র পুত্রের নিখোঁজ হওয়া এবং পরে ফকিরের কল্যাণে ঈদুল ফেতরের দিন সকালে হারানো পুত্রের প্রত্যাবর্তনের কাহিনী তুলে ধরেছেন।
শুধু রোজা-নামাজ পালন করলেই হয়না, গরীবদের জন্যে জাকাত-ফেতরা সদকাও দিতে হয়। এটাই ইসলামের নিয়ম। কিন্তু কাঠমোল্লা জমিদার তা মানতে নারাজ। সে শুধু নামাজ-রোজাকেই ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করে। দান-খয়রাত করলে নাকি সে নিজেই গরীব হয়ে যাবে। এ কারণে সে ফকিরকেও তাড়িয়ে দেয় বাড়ি হতে। এই ফকিরের কল্যাণেই ঈদের দিন তার হারানো পুত্র ফিরে আসে। জমিদার ফকিরের কথা ও কেরামতিতে নিজের ভুল বুঝতে পারে। ঈদুল ফেতরের দিন তার জীবন ও মনোজগতে পরিবর্তন আসে হারোনো পুত্রকে ফিরে পাওয়ার মাধ্যমে।
নজরুল অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে ইসলামের মূল মর্মটি তুলে ধরেছেন এই নাটিকায়। নাটিকায় জমিদার চরিত্রটির মাধ্যমে তিনি ধর্মীয় ও সামাজিক দিকটি শিক্ষণীয়ভাবে তুলে ধরেছেন। নাটকে ফকিরের চরিত্রটি রূপক। সে জমিদারের কাছে ভিক্ষার ছলে এলেও পরবর্তীকালে জমিদারের পুত্র হারানো ও পুত্র ফিরে পাওয়া এবং ধর্ম সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান থেকে তা স্পষ্ট হয়।
ঈদ নিয়ে নজরুলের আরেকটি নাটক রয়েছে। নাটকটির নামও ‘ঈদ’ এটি ১৯৪১ সালে রচিত। ‘ঈদ’ শ্রুতিনাটক কলকাতা বেতার কেন্দ্র হতে প্রচারিত হয় ১৯৪১ খৃষ্টাব্দের ২৩ অক্টোবর পবিত্র ঈদুল ফেতরের দিন (১ শাওয়াল, ১৩৬০ হিজরী, ৫ কার্তিক, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) ভোরবেলায়। নাটিকায় অংশ নেন কাজী নজরুল ইসলাম, চিত্তরঞ্জন রায়, মুহম্মদ হোসেন খসরু, কামাল চৌধুরী, রেহানা বেগম ও আফরোজা আখতার। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ৭ বৈশাখ ঈদসংখ্যা দৈনিক ঈত্তেফাক পত্রিকায়।
কাজী নজরুল ইসলামের ‘ঈদ’ নাটকটি সমগ্র বাংলা মুসলিম সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। এই নাটিকায় নজরুলের ইসলামী ঐতিহ্য চেতনার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছে। নাটিকায় তিনজন পুরুষ ও দু’জন মেয়ে চরিত্র রয়েছে। এরা হচ্ছে মাহবুব, শমসের, মাহতাব, গুলশান ও বেদৌরা। এতে গান রয়েছে:
১, বিদায় বেলায় সালাম লহ মাহে রমজান রোজ (মাহতাব)
২. নাই হল মা বসন ভূষণ এই ঈদে আমার (গুলশান)
৩. এল ঈদুল-ফেতর এর ঈদ ঈদ ঈদ (বেদৌরা)
নাটিকার শুরুতে রয়েছে ঈদের ভোরে মাহতাবের কণ্ঠে গান। তাদের বাড়িতে আসে বন্ধু মাহবুব ও শমসের। মাহতাবের কোন বেদৌরা সবার জন্য খোরমা, সেমাই, আতরদানির ব্যবস্থা করে। এক সময় তাদের সঙ্গে যোগ দেয় গুলশানও। সবাইকে নিয়ে পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন তৈরি হয় একটি অনাবিল খুশীর রোমান্টিক পরিবেশ। এদের মধ্যে আলোচনা হয় রোজার মহাত্ন্য, ঈদের আনন্দ, মহান আল্লাহর কুদরত ইত্যাদি নিয়ে। নাটিকার একটি চরিত্র শমসের যখন জিজ্ঞেস করে ‘একমাস উপোস করে কী লাভ হয়’? তখন মাহতাবের কণ্ঠে উচ্চারণ:
‘শমসের! আমরা যে ক্ষীর-সন্দেশ বা পোলাও কোর্মা মসজিদে পাঠাই, তা কি আল্লাহ খান? ঐ ক্ষীর সন্দেশই, ফিরনীই শিরণী হয়ে ফিরে আসে আমাদের কাছে। আমাদের অশুদ্ধ দেহ-মনের দান আল্লাহর নামে নিবেদিত হয়ে স্তব্ধ হয়ে ফিরে আসে। এ আল্লাহর পরীক্ষা। তার রহম ও রহমত, কৃপা ও কল্যাণ পেতে হলে আমাদের দেহ-মনকে মাঝে মধ্যে উপবাসী রাখতে হয়। এই উপবাসে দেহ-মনের ভোগের তৃষ্ণা যখন চলে যায়, তখনি ঈদের অর্থাৎ নিত্য-আনন্দের চাঁদ, পরমোৎসবের চাঁদ উঠে।’
তখন শমসের স্বীকার করে: সত্যি, একমাস রোজা রেখে ঈদের অপূর্ব আনন্দ পাই-তা বৎসরের আর কোনদিন পাত্তা পাওয়া যাবে না। মাহতাবও তখন আবার বলে: হ্যাঁ, এতে দেহের রোজা, মনের রোজা রাখলে তাকে ভোগের থেকে ফিরিয়ে রাখলে দুর্ভোগ কমে যায়-শান্তি আনন্দ আল্লাহর কাছে থেকে নেমে আসে।
এই নাটিকায় কেন্দ্রীয় চরিত্র হচ্ছে মাহতাব। এই চরিত্রের মুখ দিয়ে আল্লাহ, রোজা, ঈদ, আধ্যাত্নিকতা সম্পর্কে যে সব কথাবার্তা বলা হয়েছে তাতে ইসলামী আদর্শ ও চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। মনে হয় কবি কাজী নজরুল ইসলামই যেন এই মাহতাব চরিত্রের ভেতর লুকিয়ে আছেন্।
মাহতাবের কণ্ঠে উচ্চারিত শেষ সংলাপ ‘বিরহের রোজা না রাখলে কি প্রেমের চাঁদ দেখতে? এর মধ্যে যে নিগুঢ় অর্থ রয়েছে তাতে ‘ঈদ’ নামটি সার্থক হয়ে উঠেছে। মোবাশ্বের আলী লিখেছেন:
তিনি (নজরুল) হিন্দুজীবন থেকে যেমন নাটকের উপাদান গ্রহণ করেছেন, তেমনি ইসলামী জীবন থেকেও নাটকের উপাদান উপজীব্য আহরণ করেছেন। ‘ঈদ’ নাটিকায় মাহতাবের উক্তির মাধ্যমে ঈদের যথার্থ তাৎপর্য উদঘাটিত হয়েছে। এই ঈদগাহের সর্ব জাতিধর্ম, হানাহানি, ঈর্ষা ভেদ ভুলে সর্ব ধর্মের পূর্ণ সমন্বয়-সেই পরম নিত্য পরম সনাতন আল্লাহকে একসাথে সিজদা কবর-নামাজের শেষে অশ্রুসিক্ত চোখে পরস্পরকে আলিঙ্গন করব।