
শোবিজ অঙ্গনের পরিচিত মুখ কাজী নওশাবা আহমেদ। তিনি একজন অভিনেত্রী ও মডেল। চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও বিজ্ঞাপনে অভিনয় করে যিনি গত এক যুগে নিজের একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে ড্রইং ও পেইন্টিং বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। মঞ্চ, টেলিভিশন নাটক, টেলিফিল্মের পাশাপাশি আন্ডার কন্সট্রাকশন, ভুবন মাঝি, ঢাকা অ্যাটাক, চন্দ্রাবতী কথাসহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এছাড়াও তিনি সামাজিক অনেক কাজের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড-সিআরপি’র সাথে। দীর্ঘদিন সিসিমপুরের সঙ্গে কাজ করেছেন। গঠন করেছেন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ‘টুগেদার উই ক্যান’। করোনাকালীন সময়ে তার ভিন্নধর্মী আয়োজন ‘আর্ট ফর টুগেদারনেস’ খুবই প্রশংসা পাচ্ছে। সম্প্রতি তিনি কালচারাল ইয়ার্ডের মুখোমুখি হয়েছিলেন। করোনাকালীন সময়ে শিল্প-সংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন এই অভিনেত্রী।
কালচারাল ইয়ার্ড: এই গৃহবন্দী সময় কীভাবে কাটছে? এ সময়ে আপনার পরিবর্তিত জীবনাচরণ ও জীবনবোধ সম্পর্কে জানতে চাই।
কাজী নওশাবা: বড় বড় মনীষীরা বলেন, সহজ থাকতে। (আমার বাবাও বলতেন) আমি সেটাই চেষ্টা করি। আমার বাবা-মা, দু’জন খুবই সহজ মানুষ। আমি ছোটবেলা থেকেই খুব বেশি চাকচিক্যতে অভ্যস্ত হই নি, সেটা মিডিয়ায় আসার পরেও। বাবা বলতেন, মাটির কাছাকাছি থেকো। করোনা আসার পরে সবাই ভাবছে, দুর্ভিক্ষ হবে। কিন্তু পুরো সিচুয়েশনকে আমার আয়ত্বে আনতে খুব বেশি কষ্ট হলো না। কারণ আমার সারাজীবনই অনেকটাই এরকমই!
আমার বাবা খুব বেশি টাকা খরচ করেছেন বই কিনে, অথবা গাছ লাগিয়ে। এখন যে জীবনে সবাই ফিরে যেতে বলছেন, এ জীবনে আমার বাবাকে আমি সবসময়ই দেখতাম। আমি এখন রিয়েলাইজ করি। তখন আশেপাশে দেখতাম, (স্কুল কলেজে যেটা হয়) বন্ধুরা পিজ্জা খেতে যাচ্ছে, বড় বড় রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। মিডিয়ায় কাজ করলে এটা খুব সাধারণ বিষয়, হ্যাংআউট বলে একটা শব্দ আছে। শুটিংয়ের পরে এই জায়গায় যাওয়া, ওই জায়গায় যাওয়া। এটা আমি কখনও-ই করি নাই। ব্যাপারটা এমন না যে, ইচ্ছা করে করি নি। আমি আসলে পারি নি। বলে না যে, শিকড়টা একবার তৈরি হয়ে গেলে, আপনি ওখান থেকে সরতে পারবেন না।
করোনাকালীন সময়ে তারকাদের ভাবনা
⇒ এই সময়টা নিজেদেরকে গড়ে তোলার : পায়েল মুখার্জি
আমি এখন বুঝি যে, আসলেই পৃথিবীতে সবার জন্য ভাবা উচিত। আমার বাবা একটা কথা বলতো যে, তুমি একা সব কিছু করে ফেলো না, পাশের মানুষের কথাও ভাবতে হবে। ওখান থেকে এবং লকডাউনে আমার মনে হয়েছে, যেভাবে ছোটবেলায় দিন কাটাতাম, আমি যদি আমার মেয়েকেও ওই জীবনে অভ্যস্ত করে ফেলতে পারি, তাহলে মনে হয় না যে, তাকে খুব বেশির মধ্যে চলতে হবে। সেটা তো গেলো জীবনের বৈষয়িক দিক, কীভাবে জীবনের উপর এর প্রভাব ফেলবে এটা।
আবার ধরেন জীবনবোধের ক্ষেত্রেও তাই, কত কমে খুশি থাকা যায়। জীবনে খুশি হতে আসলে তেমন কিছুই কিন্তু লাগে না। আমারও অনেক আফসোস আছে, অনেক অসচ্ছলতা আছে জীবনে। তবে অন্যের সঙ্গে নিজেকে কম্পেয়ার না করলেই হলো, তখন বোঝা যাবে আপনার আসলে অনেক আছে। তখন দেখবেন যে আপনার জীবনটা সহজ হয়ে যায়।
এটাই আমার জীবনবোধ যে, যতটুকু সহজ জীবনযাপন করা যায়। যতখানি মাটির কাছাকাছি থাকা যায়। আমাদের বোঝা উচিত, আসলে দিন শেষে আমরা মাটির আবার মাটিতেই মিশে যাবো।
কালচারাল ইয়ার্ড: করোনা ভাইরাস মহামারি বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত। এই সময়ে শিল্প-সংস্কৃতি কি ধরণের ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন?
কাজী নওশাবা: শিল্প-সংস্কৃতি অবশ্যই অনেক প্রভাব রাখতে পারে। কিন্তু মৌলিক চাহিদাকে মেটানোর পরে। যেমন আমি একটা কনটেস্ট করছি ‘আর্ট ফর টুগেদারনেস’। আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন আপনি এ ধরণের কনটেস্ট কেন করছেন। আমি একটা জিনিসে বিশ্বাসী, ছোটবেলায় যখন টাইটানিক দেখছিলাম। সেখানে যখন টাইটানিক ডুবছিলো তখন সেখানে যে ভায়োলিন বাজাচ্ছিল। ওই একটা দৃশ্য আমাকে অনেক প্রভাবিত করেছিলো। যেখানে একজন শিল্পী মরে যাচ্ছে, এরপরও শেষ পর্যন্ত সে ভায়োলিন বাজিয়ে যাচ্ছে। ওটাই শিল্পের সৌন্দর্য ও ওটাই শিল্পীর দায়িত্ব; যে তুমি যেই পজিশনেই যাও না কেন, যে অবস্থানেই থাক না কেন। যেমন আমি তো একজন ডাক্তার নই, যে আমি একজনকে চিকিৎসা দেবো। কিন্তু আমি মানুষকে একটু শান্তি তো দিতে পারি, একটা কবিতা বলে বা একটা গান শুনিয়ে, অথবা একটা সুন্দর কথা বলে। এটাই আমার দায়িত্ব।
অভিনেত্রী কাজী নওশাবার আরও খবর
⇒ সাত তারকাকে নিয়ে ঈদে নওশাবার বিশেষ আড্ডা
অনেক ক্রান্তিকালে অনেক অসাধারণ সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের জীবদ্দশায় তো এটাই সবচেয়ে বড় ক্রান্তিকাল। এ সময়ে একজন করোনা রোগী বা যে কেউ আমরা ভয়ে ভয়ে মরছি, এ সময়ে যদি ৫ মিনিটের জন্য একজনকে আমরা একটি গান শুনিয়ে ভয় থেকে দূরে রাখতে পারি সেটাই কম কিসে। একটা সুন্দর পারফরমেন্স দেখিয়ে তাকে উজ্জীবিত করতে পারি তুমি একা নও, আমরা সবাই আছি তোমার সঙ্গে। সেটাই কম কিসে।
আমরা হয়েতো বা সম্মুখ যুদ্ধ করছি না বা তাদেরে জন্য জীবন বাজি রাখছি না, কিন্তু তাদেরকে একটু শান্তি দেওয়া, একটু আনন্দ দেয়া, অন্ধকারের মধ্যে একটু আলোর ছটা দেওয়া; এটাই তো একজন শিল্পীর দায়িত্ব হওয়া উচিত। এখন শিল্পী যদি বলে, ভাই তুমি বাসা থেকে বের হবে না। তাহলে এটা কিন্তু মানুষ শুনবে, কিন্তু একজন ব্যাংকার যদি এ কথা বলে, সেটা কিন্তু মানুষ শুনবে না। এটাই শিল্পের শক্তি।
কালচারাল ইয়ার্ড: ‘আর্ট ফর টুগেদারনেস ২০২০’ নিয়ে যদি কিছু বলেন।
কাজী নওশাবা: ‘দূরে থেকেও জুড়ে থাকি, শিল্পের শক্তিতে’- এটা হচ্ছে আমাদের স্লোগান। আমরা চেষ্টা করেছি বাঙালি যত শিল্পী আছে বিভিন্ন জায়গায়, কেউ নিউইয়র্কে আছেন, কেউ লন্ডনে আছেন, কেউ ইন্ডিয়ায় আছেন। পশ্চিম বাংলার ও এই বাংলার শিল্পীরা মিলে আমরা চেষ্টা করছি কিছু করার। এখানে আমাদের ৭টি ডিপার্টমেন্ট আছে। যেমন সঙ্গীত, কবিতা, ছোটগল্প, ছোটদের কর্ণার, পেইন্টিং, ফটোগ্রাফি, শর্টফিল্ম।
কাজটা হচ্ছে, মানুষ তাদের তৈরি করা শিল্পকর্ম আমাদের এখানে জমা দিবে। আমরা একটা প্লাটফর্মে এটা জড়ো করছি, যেটা আমাদের দিচ্ছে প্রথম আলো। যেমন, এই কাজগুলোর থেকে বেস্ট ৫/৬টা গল্প প্রথম আলোতে ছাপা হবে। আবার বাচ্চাদের কাজগুলো ছাপা হবে কিশোর আলোতে। আবার যে ভালো মিউজিকগুলো আছে, সেগুলো দিয়ে আমাদের কিউরেটরে যে সঙ্গীতে আছেন, তারা সকলে মিলে কিছু একটা করবেন।
শোবিজ অঙ্গনের আরও খবর :
⇒ এবিএম সুমনই হচ্ছেন জাজের ‘মাসুদ রানা’
এখানে শুধু শিল্পীরাই কাজ জমা দিচ্ছে না। অনেক সাধারণ ছেলে মেয়েও কাজ জমা দিচ্ছে। বান্দরবানের উপজাতীয়রাও কাজ জমা দিচ্ছে। আমাদের অনেক ভলান্টিয়ার আছে, যারা বিভিন্ন জায়গা থেকে কাজ সংগ্রহ করছেন। আমাদের প্লান হচ্ছে, এখান থেকে যে বেস্ট কাজগুলো যেমন ফটোগ্রাফি, কবিতা, ছড়া, পেইন্টিং যাই হোক, পরবর্তী বইমেলায় ক্যাটালগ ও বই বের করবো। যেগুলো শিল্পের দলিল হিসেবে থেকে যাবে।
কেন আমরা শুধু যারা শিল্পী হয়ে গেছে শুধুমাত্র তাদের কাজই দেখবো? কেন যারা শিল্পী হওয়ার পথে আছে তাদের কাজ দেখবো না? সে জায়গা থেকে এই আর্ট ফর টুগেদারনেস।
আমাদের ‘আর্ট ফর টুগেদারনেস’র মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে একজন সাধারণ মানুষও যেন শিল্পচর্চা করে। যেহেতু তারা এখন বাসায় আছে। একটি মানুষও যদি আজকে চন্দ্রবিন্দুর রুপম দা’র কথা শুনে একটি গান লিখে ফেলে, তাতে অসুবিধা কি! সচেতনতা, আনন্দ, শান্তি দেওয়া, সেটাই তো একজন শিল্পীর দায়িত্ব হওয়া উচিত।
করোনা পরবর্তী পৃথিবী সাংস্কৃতিক মানুষের জন্য কেমন হবে বলে মনে করেন?
কাজী নওশাবা: আমার মনে হয়, আমরা এখন অনেকটা শুদ্ধতা লাভ করছি। বলেনা যে, শেষ বয়সে মৃত্যুভয় আসলে সবাই শুদ্ধ হযে যায়। তখন মানুষ হজ্ব করে, তখন মানুষ কাশিতে যায়। তখন মৃত্যুভয়ে প্রতিটি মানুষের মধ্যে ছোট করে একটা বোধ জাগ্রত হয়। এ সময়ও এরকম একটা ছোট বোধ জাগ্রত হচ্ছে। যে আগে ধরেন যতটুকু মিথ্যা কথা বলতো, সে ধরেন তার চেয়ে ১০ ভাগ মিথ্যে কথা কম বলবে। যে ঘুষ খেতো, মিনিমাম সে ১০ ভাগ ঘুষ কম খাবে। এটা আমার ব্যাক্তিগত বিশ্বাস। আমি আগে যেমন অস্থিরতায় ছিলাম। সেখান থেকে মিনিমাম আমার ১০ ভাগ অস্থিরতা কমে গেছে।
কোন ফর্মে সেটা প্রকাশ পাবে সেটা আমি জানি না। কিন্তু আমার মনে হয় কাজের মান, শিল্পের মান অনেকখানি বেড়ে যাবে। করোনা চলে গেলে মানুষ সিনেমা দেখতে আসবে কিনা, প্রডিউসাররা প্রডিউস করবে কিনা, সেটা অনেক দূরের কথা, আমি বলতে চাইছি বেসিক।
কোভিড ১৯ নিয়ে নির্মাতাদের ভাবনা :
⇒ ‘শুটিং না করে ঘরে থাকার নীতিতে অটল থাকার কোনো বিকল্প নেই’
যেমন আগে আমাদের কারো মধ্যে খুঁজে খুঁজে ১০টা ভালো স্ক্রিপ্ট পাবেন না। আমার বিশ্বাস করোনার মধ্যে মানুষ প্রচুর বই পড়েছে। মানুষের মধ্যে আরও আবেগ হয়েছে, মানুষ আরও সংযত হয়েছে, আরও সেনসিটিভ হয়েছে, তাদের লেখায় সেটা প্রকাশ পাবেই। যখন মানুষ আবেগী হয়ে যে কোন শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা করবে না কেন, সেটা অবশ্যই আগের তুলনায় পরিপক্ক হবে, আরও ভালো হবে- এটাই স্বাভাবিক।
কালচারাল ইয়ার্ড: অবসর সময় আপনার অতীত স্মৃতিতে কি কি ভেসে আসে। কোন সময়টা ধরা দেয় স্মৃতিতে?
কাজী নওশাবা: আমার বাবা মায়ের সঙ্গে কাটানো সময়গুলো, আমার মেয়েকে প্রথম কোলে নেয়া, আমার প্রথম আত্নপ্রকাশ একজন শিল্পী হিসেবে সেটি। আর আমি সচেতনভাবে আনতে চেষ্টা করি, একজন শিল্পী হিসেবে যা আমাকে ‘আজকের আমি’ বানিয়েছে, সেই স্মৃতিগুলো আমার মানসপটে আনতে। যাতে আমি আমার পেছনটা ভুলে না যাই। আর পেছনে যে ভুল হয়েছে, তা কাটিয়ে আরও সামনে যেতে পারি।
কালচারাল ইয়ার্ড: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ
কাজী নওশাবা: কালচারাল ইয়ার্ড পরিবার ও এর দর্শকদেরও অসংখ্য ধন্যবাদ।