রোমান কবির :
পঁচাত্তরের পনের আগস্ট। বাঙালি জাতির জীবনে একটি কালো অধ্যায়। এদিন সকালে সংঘঠিত হয় ইতিহাসের সবেচেয়ে নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। ঘাতকের বুট ও বন্দুকের গুলির আওয়াজে প্রকম্পিত হয় জাতির জনকের বাড়ি। সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রত্যুষের আলো বাংলার মাটি ছোঁয়ার আগেই মহাবিজয়ের মহানায়কের রক্তে সিক্ত হয় চরাচর। চাকরিচ্যুত মেজর ডালিমের কণ্ঠে বাংলাদেশ বেতারে ঘোষিত হয়, স্বৈরাচারী মুজিব সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে, খন্দকার মোশতাক আহমেদ প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। একটি অনাকাঙ্খিত ঘোষণা, স্তম্ভিত বাংলাদেশ। জয় বাংলা স্লোগান পাল্টে হয়ে গেলো বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। পনের আগস্ট ও ষোলো আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা ও দাফন প্রক্রিয়ার জটিলতার প্রেক্ষাপটে মাসুম রেজার রচনা ও নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় ইতিহাসের এক বেদনাবিধুর আখ্যান।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে গেলো ৪ ও ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রযোজনায় প্রদর্শিত হয় নাটক ‘জনকের অনন্তযাত্রা’। নাটকটির প্রযোজনা উপদেষ্টা হিসেবে এই নাটকের উদ্বোধন করেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।
নাটকের আখ্যান গড়ে ওঠে পঁচাত্তরের পনের আগস্টের প্রেক্ষাপটে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর পনেরই আগস্টের পুরোটা দিন, পুরোটা রাত পার হয়। পরদিন প্রত্যুষে পরিবারের সকলের সমাধি হয় বনানীর কবরস্থানে। কেবল বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ কফিনে করে সামরিক সামরিক হেলিকপ্টার বয়ে নিয়ে গেলো টৃঙ্গিপাড়ায়। খন্দকার মোশতাকের নির্দেশ, শেখ মুজিবকে ঢাকার বাইরে যেকোনো জায়গায় কবর দেওয়া যাবে কিন্তু কোনোভাবেই ঢাকায় নয়। মধ্য দুপুরে জাতির জনকের মরদেহবাহী হেলিকপ্টার অবতরণ করে টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে। দুইজন সামরিক কর্ম কর্তা বেশ কিছু সেনা সদস্য সহযোগে দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন যত দ্রুত সম্ভব অন্তিমক্রিয়া শেষ করে ফিরে যাবেন।
সত্যাশ্রয়ী গল্প, গল্পাশ্রয়ী সত্য
মেজর হায়দার ও ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিনকে দেওয়া হয়েছে এই কাজের ভার। মেজর হায়দার সময়ক্ষেপণ করতে পারবেন না, তাই নির্দেশ দিলেন কফিনটা সরাসরি কবরে নামিয়ে মাটি চাপা দেওয়ার জন্য। বাধ সাধলেন বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে গড়া মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল হালিম।
তিনি বললেন, একজন মুসলমানকে এভাবে সমাধিস্থ করা যাবেনা। তাঁর গোসল হবে, কাফন হবে, জানাযা হবে, তারপর তাঁকে কবরে শায়িত করা যাবে। তার এই কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন সামরিক কর্মকর্তারা। তারা চান, দ্রুত কাজটা শেষ করে ফিরে যেতে। ভয় তাড়া করছে তাদের, দেরি হলে লাশ দাফনের কথা আশপাশে ছড়িয়ে পড়বে। চারদিক থেকে ছুটে আসবে মানুষ। তাদেরকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ভেবে তাদের উপর চড়াও হবে। মেজয় হায়দার আবারও চিৎকার করে উঠলেন, ‘গোসল, কাফন, জানাযা কিচ্ছু দরকার নেই। কফিনটা সোজা কবরে নামিয়ে দাও।’
আরও পড়ুন : ‘জনকের অনন্তযাত্রা’ নিয়ে আসছেন মাসুম রেজা
এবার আরও কঠিন যুক্তি উপস্থাপন করলেন মাওলানা আব্দুল হাকিম। উচ্চকণ্ঠেই বললেন ‘একজন মুসলমানকে এভাবে দাফন করা হলে, তাঁকে শহীদ ঘোষণা করতে হবে।’ এই খবর পৌঁছে গেলো ঢাকার সেনাসদরে। মোশতাক শুনে বললেন, দেশে ইসলামি শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য হত্যা করা হয়েছে, তাকে শহীদ ঘোষণা করলে হিতে বিপরীত হবে। ফলে মেজর হায়দারের আর কোনো উপায় থাকল না। ইসলামি শরিয়া মোতাবেক বঙ্গবন্ধুর দাফন কাফনের অনুমতি দিতে বাধ্য হলেন তিনি।
গোসলের জন্য সুগন্ধি সাবান পাওয়া গেল না। তাঁর অন্তিম স্নান হলো ৫৭০ কাপড়কাচা সাবানে, কাফন হলো রেডক্রস হাসপাতাল থেকে আনা বিধবাদের জন্য বঙ্গবন্ধুরই দেওয়া রিলিফের শাড়িতে। ১৪৪ ধারা জারি থাকা স্বত্বেও আশপাশের বেশকিছু মানুষ জড়ো হলেন। তাদের ভেতর কেউ কেউ অংশ নিলেন জানাজায়।
এভাবেই শেষ হয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতার অন্তিমযাত্রা। সেদিন যারা তাঁর অন্তিমযাত্রায় শামিল হয়েছিলেন তাদের কাছ থেকে শোনা ও পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে রচিত নাটক ‘জনকের অনন্তযাত্রা’।
নির্দেশকের জবানীতে
‘জনকের অনন্তযাত্রা’ রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন মাসুম রেজা। তিনি এই নাটকের আখ্যান তৈরিতে নিজের রচনার অভিপ্রায় ও নির্দেশক হিসেবে তাঁর দায় ব্যক্ত করলেন। নির্দেশক মাসুম রেজা নাটকটি সম্পর্কে জানান, জনকের অনন্তযাত্রা রচনার অভিপ্রায় ইতিহা্স সংরক্ষণ নয়। এ রচনার প্রকৃত অভিপ্রায় ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্টের ঘটনাবলিকে গল্পের আশ্রয়ে উপস্থাপন করা।
তিনি জানান, বঙ্গবন্ধুকে সমাধিস্থ করার পূর্বাপর ঘটনাসমূহ আমাদের অনেকের কাছেই অস্পষ্ট বা অজানা। নানান তথ্য, তত্ত্ব ও গবেষণার মাধ্যমে ১৬ আগস্টের সারাদিনের খণ্ড খণ্ড চিত্র জোড়া দিয়ে সাজানো হয়েছে জনকের অনন্তযাত্রা নাটকের গল্প। তাতে হয়তবা সময়ের কিছুটা এদিক ওদিক হয়েছে। এ নাট্যে সেদিনের ইতিহাস হয়ে উঠেছে গল্প নির্ভর, আর গল্পটা হয়েছে ইতিহাস নির্ভর। জনকের অনন্তযাত্রা ইতিহাসের নিংড়ানো নিযাস, এক নির্মম বেদনাগাঁথা।
মুজিব শতবর্ষ পালন উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে দেশের ৬৪ জেলায় ৬৪টি নাটক প্রদর্শিত হয়েছে। এই নাটকটি এই আয়োজনেরই অংশ। নাটকটিতে আজিজুল হাকিম, মুনিরা বেগম মেমী, সাজ্জাদ আহমেদ, মাঈন হাসান, কামাল বায়েজীদ, রমিজ রাজুসহ আরও অনেকে অভিনয় করেছেন। নাটকটির সঙ্গীত পরিকল্পনা করেছেন সঙ্গীতজ্ঞ ফোয়াদ নাসের বাবু। আলোক পরিকল্পনায় ছিলেন নাসিরুল হক খোকন ও পোশাক পরিকল্পনা করেছেন ওয়াহিদা মল্লিক জলি।