রোমান কবির:
চলচ্চিত্রের সঙ্গে রাজনীতি ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সেই শুরু থেকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শুরু করে ভারতীয় উপমহাদেশ পর্যন্ত ছড়িয়েছে চলচ্চিত্রে রাজনীতি। আর এই রাজনীতির প্রভাবে উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক নিয়েও তৈরী হয়েছে ধোঁয়াষা। ১৯১৩ সালে ভারতের একজন ফটোগ্রাফার উপমহাদেশের প্রথম কাহিনীচিত্র ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ নির্মাণ করেন। সেই থেকে তাঁকে ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক বলা হয়। কিন্তু ইতিহাস বলে অন্য কথা। দাদা সাহেব ফালকে নন তৎকালীণ পূর্ববাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশের মানিকগঞ্জের বকজুরি গ্রামের ছেলে হীরালাল সেন ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শণ করেন।
১৮৯৫ সালে ফ্রান্সের লুই লুমিয়ের ব্রাদার্সরা যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ও দেশে দেশে তা প্রদর্শণ করছেন এর বছরখানেকের মধ্যে বোম্বেতে তাদের চলচ্চিত্র প্রদর্শন হয়। হীরালাল সেন লুই লুমিয়ের ব্রাদার্সের প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেন। এরপর তিনি নিজেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
১৮৯৮ সালে হীরালাল সেন তার ভাই মতিলাল সেনের সাহায্যে কলকাতায় প্রথম বায়োস্কোপ কোম্পানিও খোলেন। হীরালাল সেন প্রথম ‘পারস্যের ফুল’ নাটকের একটি নাচের দৃশ্য তোলেন। এরপর ‘আলীবাবা ও চল্লিশ চোর’ নাটকের দৃশ্যধারণ করেন তিনি। কলকাতার টাউন হলে দেশনেতা সুরেন্দ্র ব্যানর্জীর নেতৃত্বে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের দৃশ্য তোলেন হীরালাল সেন। এমনকি হীরালাল ভারতে প্রথম বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণ করেন। কিন্তু ১৯১৭ সালে এক অগ্নিদুর্ঘটনায় তাঁর সব সৃষ্টি নষ্ট হয়ে যায়। তবে তিনি যে কাজ করেছেন বেশিরভাগই তিনি করেন কলকাতায়। সে সময় তিনি এ সব কাজের জন্যও ছিলেন সুপরিচিত। শতবর্ষ পরেও এ কথাটি স্বীকার করা হয়না। আর এর কারণ উপমহাদেশের রাজনীতি।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক আন্দোলন সর্বক্ষেত্রে বাঙালিরা ছিল এগিয়ে। কিন্তু ভারত থেকে পাকিস্তান সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত ও নিস্পেষিত ছিল বাঙালিরা। দেশভাগের পর এই অংশের মুসলমানদের প্রতি পাকিস্তানিদের অন্যায় আচরণ ও ভারতে পাড়ি জমানো হিন্দুদের প্রতি বাঁকা দৃষ্টি। সবমিলিয়ে বাঙালিরা সবসময়ই ছিল বঞ্চিত। উপমহাদেশের রাজনীতিই বাঙালিদের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। এ রাজনীতির শিকার হয়েই বলা যায় একজন বাঙালি তথা বাংলাদেশের সন্তান হীরালাল সেন উপমহাদেশে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেও রয়ে গেছেন আড়ালে।
চলচ্চিত্র বোদ্ধারা বলছেন, ভারতীয় রাজনীতির শিকার হীরালাল সেন। দেশভাগের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান হওয়া পূর্ব বাংলা পরবর্তীতে হয় বাংলাদেশ। এই বাংলার সন্তান হীরালাল। যদিও কাহিনী চলচ্চিত্রকে মানদন্ড ধরে চলচ্চিত্রের জনক অনুসন্ধান করা হলে দাদা সাহেব ফালকে নামটাই প্রথমে উল্লেখ করতে হয়। যদিও তিনি হীরালাল সেনের অনেক পরে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। আর এ ছবিটি নির্মাণের কারণে ফালকে পেলেন এই ভূখন্ডে চলচ্চিত্রের জনকের মর্যাদা। এই যুক্তিকে যদি ধরতেই হয় তবে বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসে যে লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় তাদেরও অস্বীকার করতে হয়।
কারণ ১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্যারিসে প্রথম নির্মাণ ও প্রদর্শণী যে চলচ্চিত্র তা কিন্তু প্রামাণ্যচিত্র। একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা কাজ শেষে বের হচ্ছে। তারই চিত্র ধারণ করেছিলেন তারা। এরপর তারা নির্মাণ করেছেন একটি ট্রেন ছুটে চলছে প্ল্যাঁফর্মের গা ঘেঁষে। একটি শিশুর খাবার টেবিলে খাবার গ্রহণের দৃশ্য। এগুলো সবই প্রামাণ্যচিত্রের উদাহরণ। এ হিসেবে হীরালাল সেন চলচ্চিত্র নির্মাণে ফালকের চেয়ে এক দশক এগিয়ে। না্যঁদৃশ্য ছাড়া যে সব অনুষ্ঠানের চলচ্চিত্র হীরালাল এই শতকের শুরুর দিকে তুলেছিলেন এবং প্রদর্শন করেছিলেন তা প্রামাণ্যচিত্র, বিজ্ঞাপন চিত্র বা রাজনৈতিক চলচ্চিত্র। আর তাই লুমিয়ের ব্রাদার্সদের রুলস মেনে চললে হীরালাল সেনই উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকার। কিন্তু ভারতের বোদ্ধারা এটি জেনেও চোখ বন্ধ করে ফালকেকেই প্রথম চলচ্চিত্রকার বলছেন। ফালকেকে নিয়ে পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট, সত্যজিত রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেবাসে ফালকের বিষয়ে পড়ানো হয়। কিন্তু হীরালাল সেন সম্পর্কে জানার কোন সুযোগ নেই ভারতীয় চলচ্চিত্রকারদের। বরং যখনই হীরালালের নাম উঠে এসেছে বোদ্ধারা তাকে এড়িয়ে গেছেন সযতনে। এমনকি সত্যজিত রায় এ বাংলায় এলেও তিনি হীরালালকে মানতেও নারাজ ছিলেন।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের শতবর্ষীয় উদযাপন অনুষ্ঠানে দাবি করা হয় যে, ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাস শুরু হয় ১৯১৩ সালে। তবে এর বিপরীতে ব্রিটিশ জাদুঘরের ইমেজ কিউরেটর ল্যুক ম্যাককার্নান বলেন, ১৯১৩ সালের পূর্বের ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাস একটি খণ্ডিত অংশ কিন্তু তাই বলে তা কম আকর্ষণীয়ও নয়। এই ইতিহাস এখনো পুরোপুরি বোধগম্য যেমন নয় তেমনই উপেক্ষিতও বটে। আমরা সেইসব সিনেমা আজ দেখতে পারিনা কারণ ধারণা করা হয় ভারতীয় নির্বাক সিনেমার প্রায় ৯৯ শতাংশ হারিয়ে গেছে কিন্তু আমরা যা জানতে পারি তা হলো ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসেরও একটি পুরোনো ইতিহাস আছে।
উপমহাদেশের তিন আমলের রাজনীতি বাঙালিকে বিভক্ত করেছে। তাদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সত্ত্বাকেও গ্রাস করেছে অনেকাংশে। আর অতল গহ্বরে চলে গেছে বাঙালি চলচ্চিত্রকার হীরালাল সেন। যে শুধু ভারত নয় আফ্রো-এশিয়ার সর্বপ্রথম চলচ্চিত্রকার বলেও বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। ইতিমধ্যে এ নিয়ে গবেষণা করছেন পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রবোদ্ধারা। দুই বাংলার চলচ্চিত্রবোদ্ধারা মনে করেন এই বাংলা থেকে যথাযুক্ত প্রমাণ হাজির করে সঠিক সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে হীরালালকে উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রকার হিসেবে স্বীকৃতি এনে দেয়া সম্ভব। এ নিয়ে গবেষণা, আলাপ-আলোচনা ও দেন-দরবার শুরু হয়েছে। চলচ্চিত্র আন্দোলনের কর্মীরা এ নিয়ে ব্যাপক সরব। আশা করা যায় এই দশকেই বাংলার সন্তান হীরালাল সেনকে তাঁর যথোপযুক্ত সম্মান আমরা এনে দিতে পারব। আর তা করতে হবে আমাদের নিজেদেরই।
লেখক: সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা