বিশেষ প্রতিবেদক:
বর্তমানে ‘বাংলিশ’ নামে একটি ভাষা পাওয়া যাচ্ছে রেডিও, টেলিভিশনসহ সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। এটি এমন একটি ভাষা যা না বাংলা, না ইংলিশ। বরং দুয়ের মিলনে জখাখিচুড়ি। একে অনেকে বলছে বাংলিশ। ডিজিটাল যুগে এ ভাষা ব্যবহার হচ্ছে এ প্রজন্মের তরুণদের কাছে। একমান ভাষা রক্ষায় যারা কাজ করছেন তারা এর তীব্র বিরোধীতা করলেও একটি শ্রেণী একে তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন। তাদের ভাষ্য এটি বিশ্বায়নের ফল। একে নেতিবাচক ভাবে তুলে ধরার কিছু নেই। কিন্তু এই ভাষা যে আমাদের ভাষাকে বিকৃত করছে বা ভাষার মান বজায় রাখার অন্তরায় হচ্ছে এটি যেন তারা মানতে রাজি নন। বিশেষ করে এই এফএম রেডিওর যুগে এ ভাষাকে আরও গ্লোরিফাই করা হচ্ছে। যেটা ভাষা রক্ষায় অগ্রপথিকরা মেনে নিতে পারছেন না।
যুক্তি-তর্কের এই পর্যায়ে বলা যেতে পারে কোন ভাষাকেই খাটো করা নয়। বরং আমরা যখন বাংলা বলবো তখন বাংলাই বলতে হবে। আর যখন ইংরেজী বলবো তখন সেটাই বলতে হবে। এতে দুটি ভাষাই অক্ষুন্ন থাকবে। কোনো ভাষাকেই খাটো করা হবেনা। রেডিও যেহেতু শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব করার মাধ্যম। সুতরাং এই মাধ্যমকেই শ্রুতি মাধ্যম হিসেবে সঠিক ভাষা ব্যবহার করতে হবে। এতে ভাষার মান বজায় থাকবে। তার মানে শুধু শুদ্ধ ভাষা বলতে হবে এমন নয়, আবার আঞ্চলিক ভাষা পরিহার করতে হবে এমন নয়। যদি শুদ্ধ বলতে হয় তাহলে পুরো শুদ্ধ বলতে হবে। অন্য আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজন পড়লে সেটি প্রমিতভাবেই ব্যবহার করতে হবে। তবে তা প্রত্যেক ভাষার মান রক্ষা করবে।
এখনকার সময়ে রেডিওতে এক এফ এম রেডিওর উপস্থাপক অনুষ্ঠান শুরুর সময় বলছে,”ওহ ডিয়ার লিসেনার ওয়েলকাম ব্যাক আমি আছি তোমাদের সাথে…….”। আবার অনুষ্ঠান শেষে বলছে সো শুনতে থাকুন বন্ধু ওয়েট এন্ড কাম ব্যাক জাস্ট টাইম। এরকম সব রেডিওতেই। প্রমিত উচ্চারণের উপর জোর দেয়া হলেও তাতে নেই গা এদের। বরং তারা যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে কে কত বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে বলতে পারবে তার জন্য। কর্তৃৃপক্ষও তাদের এই ভাষাটাকেই বেশি উপযুক্ত মনে করছে। তার কথা দর্শক বেশি শুনবে বলে মনে করে এবং তারা এটিকে একটি আধুনিক ভাষ্য হিসেবে মনে করে। এ দেশের বাচিক ও আবৃত্তি শিল্পী গোলাম সারওয়ার মনে করেন, যে বাংলিশ ভাষার চল শুরু হয়েছে একে আধুনিক মনে করছে তারা। কিন্তু এতে ভাষার প্রতি অবজ্ঞা করা হচ্ছে, অপমান করা হচ্ছে। রেডিওতেই যদি এভাবে চলতে থাকে। তাহলে এদের দ্বারা সাধারণ মানুষ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম প্রভাবিত হবে।
ভাষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলা ভাষা নিয়ে আবেগ বা চর্চা যাই হোক না কেন, সর্বক্ষেত্রে প্রমিত বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং বাংলা ভাষা ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের এই শঙ্কা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। বাংলাভাষা নিয়ে এতো গর্ব অথচ সেই ভাষা নিয়ে আমাদের অবস্থান কোথায়? ইংলিশ বাংলিশ নয় শুদ্ধ বাংলা ভাষ চর্চাই হোক আমাদের পণ। বাংলা ভাষাকে বিকৃত না করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাদের দেশের এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এমন প্রবণতা তৈরি হয়েছে যে তাদের শিশুদের-সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে না পড়ালে যেন ইজ্জতই থাকে না। এখন সর্বত্র বাংলিশের ব্যবহার চলছে। তাহলে গর্বের বাংলা ভাষার শুদ্ধতা নিয়ে আমাদের চর্চা কোন পর্যায়ে? যে জাতি নিজের ভাষা শুদ্ধ করে শেখার প্রয়োজনবোধ করে না সে জাতির ভবিষ্যৎ কি? আঞ্চলিক ভাষা চর্চার নামে নাটক-সিনেমাগুলোতে যেভাবে বাংলা বিকৃতির প্রতিযোগিতা চলছে তাকে এক সময় বাংলিশ-এ বাংলাও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
এ বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু শুদ্ধভাবে বাংলা ভাষা চর্চার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, ‘সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের মতো বাংলার সাথে বিদেশি ভাষার অযাচিত মিশ্রণ ‘বাংলিশ’ও বাংলার শত্রু। বিদেশি ভাষা শিখুন, কিন্তু শুদ্ধভাবে বাংলা চর্চায় যত্নবান থাকুন। আর সর্বশেষ তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম এক চিঠিতে মন্ত্রনালয়ের একটি নির্দেশনা পাঠিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে দেশের সবগুলো রেডিও স্টেশনকে শুদ্ধ বাংলা ব্যবহার করে অনুষ্ঠান উপস্থাপনার নির্দেশ দিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়। এতে বাংলা ও ইংরেজির ভুল এবং বিকৃত উপস্থাপন না করতেও বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, রেডিও স্টেশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনার সময় বাংলা ও ইংরেজি মিলে বিকৃতভাবে ব্যবহার করা হয়, যেটি আসলে ‘বাংরেজি’।
তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, ‘আমরা বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে যে ‘বাংরেজি’ ভাষা তৈরি হয়েছে, সেটি বন্ধ করতে বলেছি। আমরা এ বলি না যে, খাইতেছি, যাইতেছি- এমন বাংলা বলতে হবে। আমরা যে ভাষায় কথা বলি তা অন্তত বলুক। তিনি বলেন, বিভিন্ন রেডিও স্টেশনের বেশকিছু অনুষ্ঠানে আই নো, ইউ নো টাইপের শব্দ দিয়ে আধা ইংরেজি আধা বাংলা বলা হয়, যা বন্ধ হওয়া দরকার।
প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্যে, ‘ভাষার ক্ষেত্রে যারা এমন করছেন, তারা ঠিকমতো একটি ইংরেজি কিংবা বাংলা বাক্য বলতে পারবেন কিনা আমার সন্দেহ হয়।