রোমান কবির:
চলচ্চিত্র ও সংবাদপত্র দুটি বৃহৎ গণমাধ্যম। এই মাধ্যম দু’টি গণমানুষের প্রয়োজনে হাত ধরাধরি করে চলছে সেই শুরু থেকেই। যদিও সংবাদপত্র বহুকাল ধরে গণমাধ্যম হিসেবে গণমানুষের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করছে। অত্যন্ত নবীন শিল্প ও গণমাধ্যম হিসেবে গত শতাব্দীর শুরুতে চলচ্চিত্র আত্মপ্রকাশ করলেও সংবাদপত্রের সঙ্গে এর সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বলা যায় দিনে দিনে চলচ্চিত্রের বিকাশে সংবাদপত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর ফ্রান্সে চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হয়। এর পরই দেশে দেশে তা বিস্তার লাভ করে। এটি আস্তে আস্তে বিনোদনের পাশাপাশি শিক্ষা বিস্তার ও গণমাধ্যম হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করে। আর এর বিস্তারে সহায়ক হিসেবে কাজ করে সংবাদপত্র।
শুধু তা-ই নয় শুধুমাত্র চলচ্চিত্রকে উপজীব্য করে গড়ে উঠতে থাকে চলচ্চিত্র সংবাদপত্র। শুরু হয় চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা। সেই থেকে আজ অবধি দেশে দেশে নিজ দেশের চলচ্চিত্রের বিকাশে সংবাদপত্র ও চলচ্চিত্র সাংবাদিকরা দায়িত্ব পালন করছে। চলচ্চিত্রের বিকাশে সংবাদপত্রের ভূমিকাই সবার আগে। চলচ্চিত্র নিয়ে রিভিউ, সমালোচনা, রিপোর্ট ও চলচ্চিত্রের ইতিহাস তুলে ধরা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সংবাদপত্রই অগ্রগণ্য। চলচ্চিত্রকে নিয়ে সংবাদপত্রের পথচলার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দিনে দিনে এর ব্যাপকতা বিস্তার লাভ করেছে।
বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে চলচ্চিত্র ও সংবাদপত্র একসাথে যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরেছে। এছাড়া এ সব চলচ্চিত্রের প্রচারেও সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা ছিল অগ্রগামী। রুশ বিপ্লব পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। আর এ সব চলচ্চিত্রকে দেশে-বিদেশের মুক্তিকামী মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন চলচ্চিত্র সাংবাদিকরা। সোভিয়েত সরকার চলচ্চিত্রকে নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারের বাহন হিসেবে ব্যবহার করেছিল। আর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাঝে তা তুলে ধরতে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতাই ছিল প্রধান সহায়ক। ভারতীয় উপমহাদেশেও গত শতাব্দীর শুরু থেকে নির্মিত হয় নানা ধরণের চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র আবিষ্কৃত হওয়ার কিছুকাল পরে এ উপমহাদেশে অর্থাৎ ভারতে চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। আর এ খবর দেশের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে অগ্রগামী হয় সাংবাদিকরা।
আমাদের দেশে চলচ্চিত্রের আবির্ভাব অনেক দিনের। ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জে জন্ম নেয়া হীরালাল সেনের হাত ধরে এ অঞ্চলে চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের যাত্রালগ্ন থেকেই এখানকার আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার কারণে চলচ্চিত্রকে নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে এগুতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে চলচ্চিত্র সাংবাদিকরা বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে চলচ্চিত্রের গতিপথ প্রশস্তকরণে প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। ইরানের মতো ধর্মীয় গোঁড়ামিতে ভরা, রাজনৈতিক সমস্যা সংকুল একটি রাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তোলপাড় করার মত চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে, আর এক্ষেত্রে এই পথ প্রশস্তকারক হিসেবে সে দেশের চলচ্চিত্র শিল্প পাশে পেয়েছে সেই দেশের চলচ্চিত্র সাংবাদিকদের। এতে আব্বাস কিয়ারোস্তামি, মহসেন মখমলবাফ, জাফর পানাহির মত চলচ্চিত্রকাররা নির্বিঘ্নে বিশ্বকে তাদের সমৃদ্ধ কাজ দেখাতে পারছে। বাংলা ভাষাতে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে সত্যজিৎ রায় বিশ্ব জয় করেছেন। আর তার কর্মযজ্ঞ বিশ্ববাসীর সামনে প্রচার করেছেন চলচ্চিত্র সাংবাদিকরা। আমাদের দেশে ঋত্বিক ঘটক, আব্দুল জব্বার, জহির রায়হান, আলমগীর কবির, খান আতা, সুভাষ দত্ত, চাষী নজরুলসহ বরেণ্য নির্মাতাদের সঙ্গে চলচ্চিত্র সাংবাদিকদের সখ্যতা জ্বলজ্বলে ছিল। ফলে উভয়ের হৃদয়ভিত্তিক সৃজনশীলতা সহজেই সমুজ্জল হয়ে উঠেছিলো। সেই ধারা এখনও বহমান।
নব্বই দশকের শেষভাগ থেকে যখন এ দেশের চলচ্চিত্র অন্ধকারের দিকে ধাবিত হয়। তখনও একে আলোর পথ দেখাতে ভূমিকা পালন করে চলচ্চিত্র সংবাদ। সচেতন চলচ্চিত্রকার ও সাংবাদিকদের প্রচেষ্টায় আমাদের চলচ্চিত্র বারবার লাইফ সাপোর্ট থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে ফিরে আসে। সংবাদপত্র ও গণমানুষের সংশ্লিষ্টতায় অশ্লীলতা ও নকল চলচ্চিত্রকে দূরে ঠেলে ভালো মানের মৌলিক চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়। এবং এ সব চলচ্চিত্র দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে হয় সমাদৃত। এ দেশে নির্মিত হয় জীবন থেকে নেয়া, ওরা এগারোজন, মাটির ময়না, রানওয়ে, মনপুরা, টেলিভিশন, অজ্ঞাতনামা, আয়নাবাজি থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য নির্ভর চলচ্চিত্র। এ সব চলচ্চিত্রকে মানুষের কাছে সমাদৃত করতে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা সবসময় অগ্রণী হয়।
এই বাংলায় ১৯১৩ সালের দিকে শুরু হয় চলচ্চিত্র সম্পর্কিত লেখালেখি। তখন ওইভাবে চলচ্চিত্র সম্পর্কিত সংবাদপত্র বিকাশ লাভ না করলেও চলচ্চিত্রের সংবাদ পত্রিকার পাতায় স্থান পায়। মূলত বাংলায় পুরোপুরিভাবে সিনেমা সংক্রান্ত পত্রিকার সূচনা হয়েছিল ১৯২০ সালের দিকে। প্রথম প্রকাশিত সেই চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকার নাম ছিল ‘বিজলী’। নলিনীকান্ত সরকার, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, শচ্চিদানন্দ সেনগুপ্ত, অরুণ সিংহ এবং লেখক ও চলচ্চিত্রকার দীনেশ রঞ্জন দাসের উদ্যোগে শুরু হয়েছিল সাপ্তাহিক এই পত্রিকাটি। ‘বিজলী’ ছিল চলচ্চিত্র নিয়ে একদম আলাদাভাবে প্রকাশিত একমাত্র বাংলা পত্রিকা।
১৯২২ সালে হেমেন্দ্র প্রসাদ ঘোষ আরম্ভ করলেন বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা ‘বসুমতী’। সাহিত্যই ছিলো এতে প্রধান। কিন্তু তার ফাঁকে ফাঁকে কিছু ফিল্ম বিষয়ক আলোচনা স্থান পেতো। দর্শকদের কাছে এ পত্রিকার সাহিত্য নয় স্থান পায় ফিল্ম বিষয়ক আলোচনাগুলো। এগুলোর চাহিদা দেখেই সম্পূর্ণভাবে চলচ্চিত্র বিষয়ক দ্বিতীয় সিনেমা পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে। দ্বিতীয়বার প্রকাশিত এই সিনেমাভিত্তিক পত্রিকাটির নাম ছিল ‘সচিত্র শিশির’। ‘সচিত্র শিশির’ নামে এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন বিজয়রত্ন মজুমদার। ওই একই বছর ‘ভারতী’ পত্রিকায় বাংলা সিনেমার ইতিহাসের উপর একটি লেখা প্রকাশিত হয়। লেখাটি পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৯২৯ সালে বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘দীপালী’ বলে একটি মাসিক পত্রিকা বের করেন। পুরো সিনেমা পত্রিকা না হলেও, এতে মূলত সিনেমার খবরই থাকতো বেশি। ১৯৩০ সালে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় সাপ্তাহিক ‘বায়োস্কোপ’ পত্রিকা শুরু করলেন। এতে শুধু বাংলা খবর থাকত না, হলিউড ও বোম্বে সিনেমার খবরও স্থান পেয়েছিল। এর কারণেই ‘বায়োস্কোপ’ এর জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। (চলবে….)
চলচ্চিত্রের বিকাশে সংবাদপত্রের ভূমিকা (শেষ পর্ব)