বিশেষ প্রতিবেদক:
কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, পুরুষতন্ত্রের নির্যাতন ও ধনীর শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট গ্রামীণ বাংলাদেশের এক নারীর জীবন সংগ্রামের অনবদ্য দলিল ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’। বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক আবু ইসহাকের উপন্যাস ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ অবলম্বনে সিনেমাটি যৌথভাবে নির্মাণ করেন শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহউদ্দিন শাকের। ১৯৭৯ সালে সিনেমাটি নির্মাণ করা হয়।
সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র শ্রমজীবী নারী জয়গুন। বাংলাদেশের এক গ্রামের দরিদ্র মেয়েটির প্রথম স্বামী জব্বার মুন্সী মারা যাওয়ার পর করিম বকশ নামে এক কৃষকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। গরুর দুধ বিক্রি করে করিম বকশ সংসার চালায়। ১৯৪৩ সালে আকালের সময় স্বামী তাকে ত্যাগ করে। শিশুপুত্রকে নিজের কাছে রেখে মেয়েসহ জয়গুনকে তাড়িয়ে দেয় করিম। ছেলে বড় হয়ে খাওয়াবে কিন্তু মেয়ে থাকলে বিয়ে দিতে খরচ হবে সেজন্য এই চালাকি করে সে। শহরের লঙ্গরখানায় গিয়ে সন্তানদের নিয়ে প্রাণ বাঁচায় জয়গুন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দৃশ্য দিয়ে সিনেমা শুরু হয়। এরপর জয়নুল আবেদীনের দুর্ভিক্ষের স্কেচ দেখানো হয়। টাইটেলের পর কাহিনি শুরু হয় জয়গুনের গ্রামে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে। জয়গুনের সঙ্গে রয়েছে তার প্রথম পক্ষের সন্তান কিশোর হাসু, দ্বিতীয় স্বামীর মেয়ে মায়মুন, মৃত ভায়ের স্ত্রী ও সন্তান। দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে রয়েছে তার শিশু পুত্র কাসু। শিশুটিকে করিম বকশ মায়ের কাছে যেতে দেয় না, তাকে আঁকে রাখে নিজের কাছে। জয়গুনের মাতৃহৃদয় হাহাকার করে কোলের সন্তানটিকে এক নজর দেখার জন্য। লুকিয়ে সে মাঝে মাঝে দেখা করে ছোঁ ছেলের সঙ্গে। এ জন্য অনেক গালমন্দ খেতে হয় তাকে। শিশুটিকেও মারধোর করা হয় মায়ের কাছে যাওয়ার অপরাধে।
জয়গুন গ্রামে ফিরে এসে আশ্রয় নেয় তালগাছের ভিটা বলে পরিচিত তার বাবার রেখে যাওয়া সূর্যদীঘল বাড়িতে। গ্রামে সাধারণত বাড়ি বানানো হয় উত্তর-দক্ষিণ বিস্তারী। দু-একটি বাড়ি হয় পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তারী। এই বাড়িগুলোকে বলা হয় সূর্যদীঘল বাড়ি। এগুলো অপয়া হিসেবে পরিগণিত। বলা হয় এ বাড়িতে বাস করলে নির্বংশ হতে হয়।
জয়গুনের বাবা এক সময় জমিটা কিনেছিলেন স্বল্প দামে। এ ভিটায় এর আগে অনেক বাসিন্দার মৃত্যু হয়েছে অপঘাতে। গ্রামের অনেকে এখানে প্রেতাত্মা ও অশুভ শক্তির ছায়া দেখেছে বলে গুজব রয়েছে। অসম সাহসী জয়গুন তার সন্তানদের দিয়ে এ ভিটাতে নতুন করে ঘর তোলে। কারণ ভূতের ভয় করলে গরীব মানুষের চলে না। জয়গুন নিজের ও আশে পাশের কয়েকটি গ্রামে গ্রহস্থালীর কাজ করে সংসার চালায়। প্রতি পদে তাকে গ্রহকত্রীর অপমান সহ্য করতে হয়, সহ্য করতে হয় কর্তার কুনজর। কিশোর হাসু কাছাকাছি নারাছুগঞ্জ স্টেশনে কুলিগিরি এবং অন্যান্য ছোঁটখাটো কাজ করে সংসারের চাকা সচল রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করে। গ্রামের ফকির জয়গুন ও তার ভাবীকে ভয় দেখায় এ ভিটাতে এবং বিশেষ করে চারপাশের গাছগুলোতে রয়েছে জিনের আছর। যদিও হাসু বলে, “আমরা তো ক দিন গাছতলাতেই ছিলাম, আমাদের তো কিছু হয় নাই।” ফকির বলে “হয় নাই হতে কতক্ষণ।” সে বাড়ি বন্ধন করে। অর্থাৎ ঝাঁড়ফুঁক করে তাবিজ দেয়। এর বদলে সে পায় চাল। এ ধরনের লোক ঠাকানো কাজই তার পেশা।
অন্যের বাড়ির দাসীগিরি ছেড়ে জয়গুন ময়মনসিংহ থেকে চাল এনে আশে পাশের গ্রামে ব্যবসা শুরু করে। এতে তার সংসারের কিছুটা আয় বাড়ে। কিন্তু তার এ কাজকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখে গ্রামের ধনীরা। কারণ নারীর স্বাধীন চলাফেরা তাদের পছন্দ নয়। মায়মুন হাঁস পালে। সেই হাঁসের ডিম দিয়ে দিতে হয় মসজিদের ইমামকে। ইমাম সেই ডিমকে ‘হারাম’ বলে আখ্যায়িত করে কারণ জয়গুন কাজ করে খায় অন্যের বাড়িতে ও ভিন গ্রামে।গ্রামের মোড়ল গদু প্রধান জয়গুনের উপর কুদৃষ্টি দেয়। তাকে ‘নিকা’ করতে চায়, যদিও তার ঘরে আরো দুই স্ত্রী রয়েছে। কিন্তু সাহসী জয়গুন গদু প্রধানকে প্রত্যাখ্যান করে।
এদিকে জয়গুনের কিশোরী মেয়ে মায়মুনের বিয়ে স্থির হয়। কিন্তু বিয়ের আসরে বলা হয় জয়গুনকে তওবা করতে হবে এবং সে ময়মনসিংহে ব্যবসার কাজে যেতে পারবে না ও গ্রামের বাইরে কাজ করতে যেতে পারবে না। এভাবে জয়গুনের জীবিকার পথ বন্ধ করে দিয়ে তাকে নিজের বশে আনতে চায় গদু প্রধান। মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য জয়গুন তওবা করে। এদিকে কাসুর অসুখ হলে তাবিজ ও ফকিরের ঝাঁড়ফুঁকে যখন তার অবস্থা মরমর তখন এগিয়ে আসে জয়গুন। শফিকে দিয়ে শহর থেকে ডাক্তার আনে, মায়মুনের পোষা হাঁস দুটি বিক্রি করে চিকিৎসা করায়। দিনরাত ছেলের সেবা করে। এই সেবার ফলে সুস্থ হয় কাসু। জয়গুনের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করে করিম বকশ। কাসুকে সে ফিরিয়ে দেয় মায়ের কাছে।
শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় মায়মুনকে। মায়মুন ফিরে আসে মায়ের আশ্রয়ে। জীবিকার পথ বন্ধ হওয়ায় চরম অভাবে পড়ে জয়গুন। শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকার তাগিদে সে কাজ নেয় ধানকলে।তওবা ভাঙায় তার উপর প্রতিশোধ পরাছু হয়ে ওঠে গদু প্রধান। প্রতি রাতে বাড়িতে ঢিল মারতে থাকে সে। ভিটা থেকে জয়গুনদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করে সে।
এদিকে করিম বকশ চায় ছেলেমেয়েসহ জয়গুনকে আবার ঘরে নিতে। কিন্তু জয়গুন রাজি হয় না। কারণ তাহলে করিম বকশের নতুন স্ত্রীর সংসার নষ্ট হবে।এক রাতে ঢিল মারার সময় দেখে ফেলায় গদু প্রধান গলা টিপে হত্যা করে করিমকে। গ্রামে রটনা হয় যে সূর্য দীঘল বাড়ির অশুভ শক্তি হত্যা করেছে করিমকে। হত্যাকাণ্ডটি দেখে ফেলেছিল জয়গুন। সে প্রতিবাদী হওয়ায় এবার আঘাত আসে তার উপর। গদু প্রধানের লোক আগুন দেয় তার বাড়িতে। পুড়ে যায় জয়গুনের সব স্বপ্ন।
ছবিটির প্রযোজক ছিলেন মসিহউদ্দিন শাকের। সংলাপও লেখেন তিনি। সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন আলাউদ্দিন আলী। ছোট ছোট দৃশ্য ও সংলাপের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় গ্রামীণ জীবনের কুসংস্কারকে। এই কুসংস্কার ও অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে শোষণ চালায় মোড়লশ্রেণীর মানুষ তা তুলে ধরা হয়। সমাজে দরিদ্র নারী দ্বিমুখী নির্যাতনের শিকার। দরিদ্র বলে এবং নারী বলে তার ওপর চলে ক্রমাগত নিপীড়ণ। তবু এই নিপীড়ণকে পায়ে দলে এগিয়ে যায় জয়গুনের মতো সাহসী নারীরা। ছবিটি শিল্পমানে অনন্য। মন্তাজের প্রয়োগ ছিল অসাধারণ। সংলাপ, পরিচালনা, দৃশ্য ধারণ এবং অভিনয়গুণে এটি ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের মর্যাদা অর্জন করেছে।
ছবিটি সমালোচকদের প্রশংসায় সিক্ত হয়। ছয়টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। শেখ নিয়ামত আলী শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার জয় করেন। অনবদ্য অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান ডলি আনোয়ার। ১৯৮০ সালে ছবিটি জার্মানির ম্যানহেইম চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়ে তিনটি পুরস্কার জয় করে। এটি পর্তুগালের ফিগুয়েরা দ্য ফোজ চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়ে একটি পুরস্কার জয় করে। এটি ডন কিহটে পুরস্কারও পায়। বাংলাদেশ সিনে জার্নাল অ্যাসোসিয়েশন ছয়টি বিভাগে ছবিটিকে পুরস্কৃত করে।
এই কাহিনীর বিচিত্রতার মধ্যে মূল বিষয় অভাব, অনটন, জীবন সংগ্রাম ও বিদ্রোহ, ধর্ম, কুসংস্কার, মোড়ল মেম্বার হুজুরদের ক্ষমতা ও সামাজিক প্রতিপত্তি, পিতৃতান্ত্রিকতা, কাম লালসা, সামাজিক বিধি-নিষেধ, জাতীয়তাবোধ । সর্বোপরি গ্রামীণ সামন্তবাদী শ্রেণি কর্তৃক শ্রমজীবী ক্ষুধার্ত মানুষদেরকে ক্রমাগত শোষণ।
ছবির আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ধর্মীয় মৌলবাদ। গ্রামের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী মায়মুনের হাঁসের প্রথম চারটা ডিম হাসু হুজুরকে দিতে যায়। কিন্তু হুজুর তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ, জয়গুন পর্দা করেনা। এই আণ্ডা হারাম চীজ এই ফতোয়া দিয়ে ফেরত দেওয়া হয়।
এই হুজুরকেই আবার দেখা যায় গ্রামের মোড়ল গদু প্রধান, মাতব্বর খলিল খাঁ’র হয়ে কাজ করতে। নাবালিকা মায়মুনের বিয়ের দিন জয়গুনকে ফাঁদে ফেলা হয়। তাকে তওবা করতে হয় সে আর গ্রামের বাইরে কাজ করতে যাবেনা। তওবা না করলে মেয়ের বিয়ে হবেনা। এমন পরিস্থিতে জয়গুন বাধ্য হয় তওবা করতে।
আরেক দৃশ্যে ‘ পাকিস্তান বড়ি খাইলে কৃমি সারে ’ – ট্রেনে ক্যানভাসারের বড়ি বিক্রি নেহায়েত একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ৪৭ পূর্ব সময়ে স্বার্থপর, নষ্ট রাজনীতির কালে মুসলিম লীগ জিগীর তোলে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের। পাকিস্তান কায়েম হলেই মুসলমানের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এরকম একটা উন্মাদনা তখন সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের মনে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল এবং তা মানুষের অন্তরে বিরাজ করতো। এর বিপরীত চিন্তার মানুষ যে ছিলোনা তা নয় ।
সমস্যা যে চুকে যায় না, সেই সকরুন বাস্তবতা একটু পরেই ছবিতে দেখতে পাই। এখানে একটা দৃশ্যে চমৎকারভাবে সেই ইংগিত দিয়ে দেওয়া হয়েছে । সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে উপমহাদেশ ভাগ হওয়ার পর উৎফুল্ল জনতা ট্রাকে করে মিছিল বের করে । পাকিস্তানপ্রেমী জাতীয়তাবাদীরা শ্লোগান তোলে, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, কায়েদে আযম জিন্দাবাদ, নারায়ে তকবীর ’। পথচারীরা আগ্রহ নিয়ে দেখতে থাকে। এমন সময় ট্রাকটি পানি কাদাময় একটা রাস্তা দিয়ে দ্রুত বেগে যাওয়ার সময় দণ্ডায়মান এক পথচারীর জামা-কাপড় জল কাদায় একেবারে মাখা মাখি করে দিয়ে যায়। অসহায়, ক্ষুব্ধ লোকটির অভিব্যক্তি বলে দেয় আসন্ন সাধের পাকিস্তানী দিনগুলো কেমন হতে যাচ্ছে।
এই ছবির সব থেকে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে জয়গুনের বেঁচে থাকার লড়াই। মাথা না নুয়ানো। হ্যাঁ পরিস্থিতির শিকার হয়ে তাকে তওবা পড়ে গ্রামবন্দী থাকতে হয়েছে কিছুকাল । কিন্তু সেই ‘তওবা’কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পুনরায় গ্রহ ও গ্রামের বাইরে তাকে কাজ করতে যেতে দেখা যায়।