একটি ভালো সিনেমা মানবমনকে উন্নত করতে পারেন। আর শিশুদের জন্য তাদের উপযোগী একটি ভালো সিনেমা খুব দরকারী। বাংলাদেশে শিশুদের জন্য ভাল কিছু সিনেমা নির্মিত হয়েছে। এর কয়েকটি সস্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে। যেগুলো পরিবারের সবাই মিলে দেখতে পারেন। যা পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে সহায়তা করবে। ছোটদের সঙ্গে বড়দের মিলবন্ধন তৈরি হবে।
ছুটির ঘন্টা
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আজিজুর রহমান ১৯৮০ সালে শিশুদের জন্য নির্মাণ করেন ছুটির ঘন্টা। ঈদের ছুটি ঘোষণা হয়েছে স্কুলে। সবাই চলে গেছে ১১ দিনের জন্য। এর মধ্যে স্কুলের বাথরুমে সকলের অজান্তে তালা বন্ধ হয়ে আটকে পড়েছে একটি ১২ বছর বয়সের ছাত্র। বদ্ধ বাথরুমে বেঁচে থাকার আকুতি ছিল ছবির প্রধান বিষয়বস্তু। ১০ দিন অমানবিক কষ্ট সহ্য করার পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ছবির আটকে পড়া বালক সুমন। এদিকে বাড়িতে তার মা তার জন্য কাঁদে আর খুঁজে। বাসার অন্য সদস্যরা নানা জায়গায় খুঁজে হয়রান। সুমনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হয় করূন ছবিটি। এতে মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছে শিশু শিল্পী সুমন ও অনন্যা চরিত্রে নায়ক রাজ রাজ্জাক, শাবানা, সুজাতা, শওকত আকবর, এবং এ টি এম শামসুজ্জামান।
এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী
১৯৮০ সালে প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক বাদল রাহমান নির্মাণ করেন এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী। জার্মান লেখক এরিক কাস্টনারের ১৯২৯ সালের উপন্যাস “এমিল এন্ড দি ডিটেক্টিভ” অবলম্বনে নির্মিত। খেলাঘরের ‘মুক্ত পাখিকে বন্দী কোরো না’ শীর্ষক রচনা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে খুলনার ছেলে এমিল ঢাকায় পুরস্কার নিতে আসে। ট্রেনে তার সাথে থাকা ৫০০ টাকা হারিয়ে ফেলে। টাকাটা নানুর জন্য মা দিয়েছিল। এই প্রথম একা কোথাও এসেছে এমিল। বলতে গেলে তেমন কিছুই চেনে না। তারপরও তার কিন্তু অনেক সাহস। যে করে হোক টাকা উদ্ধার করবেই। যে কথা সে কাজ। সন্দেহ হয় হ্যাট পরা একজনকে। তার পিছু নেয় এমিল। এরপর শুরু হয় তার অভিযান। অভিযানে তার সঙ্গী হয় ঢাকার একদল বিচ্ছু পিচ্চি ও তাদেরই একজনের মামা। এমিলের বাহিনীর অভিযান সফলতার মুখ দেখে। আর চোর ধরা পড়ে। সেই সময়ের শিশু-কিশোরদের কাছে ছবিটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল। এমনকি সব সময়ের শিশুদের কাছে এটা সমান উপযোগীতা রাখে।
দিপু নাম্বার ২
মুহাম্মদ জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে দিপু নাম্বার ২ চলচ্চিত্রটি। ১৯৯৬ সালে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম এটি নির্মাণ করেন। নব্বই দশকের শিশু-কিশোরদের কাছে এটি বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। দিপুর বাবা সরকারি চাকরিজীবী। তাই বদলির কারণে প্রতিবছর দিপুকে বদলাতে হয় স্কুল, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত পরিবেশ। রাঙামাটি জিলা স্কুলের ক্লাস এইটের ছাত্র। বরাবরের মত দিপু তার নতুন শহর ও নতুন স্কুলের সাথে মানিয়ে নেয়। নতুন স্কুলে দিপুর অনেক বন্ধু হয় কিন্তু শুধুমাত্র তারেক ছাড়া। তারেক দিপুর সাথে রীতিমত ঝগড়া বাঁধাতে চেষ্টা করে ও একদিন দিপুর গায়ে হাত তুলে। কিন্তু দিপু এই ব্যাপারে কারো কাছে অভিযোগ করে না। ঘটনাচক্রে একপর্যায়ে দিপু ও তারেকের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। দুইজন একে অন্যের কাছে নিজেদের দুঃখের গল্প শেয়ার করে। তাদের বন্ধুত্ব গভীর হলে দিপু তার সবচেয়ে গোপন অভিযানের কথা তারেক ও তার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে। এরপর শুরু হয় দুঃসাহসিক অভিযান। বুদ্ধি আর সাহস খাটিয়ে দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মূর্তি পাচারকারী চক্রকে ধরতে অভিযান। এরপর দিপু আবার বছর শেষে প্রস্থান করে অন্য কোন জেলায়।
আমার বন্ধু রাশেদ
মুহম্মদ জাফর ইকবালের শিশুতোষ উপন্যাস অবলম্বনে ২০১১ সালে মোরশেদুল ইসলাম নির্মাণ করেন আমার বন্ধু রাশেদ। রাশেদ একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে তার বয়সী ছেলেরা যখন পরিস্থিতি বুঝতে অক্ষম। তখন রাজনীতি সচেতন রাশেদ তার বন্ধুকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে। স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুতে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে রাশেদ। সঙ্গে কয়েকজন বন্ধু। সম্মুখযুদ্ধে বন্দী হয়ে যায় তাদের পরিচিত একজন মুক্তিযোদ্ধা। একদিন রাশেদ ও তার বন্ধুরা তাকে মুক্ত করে নিয়ে আসে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে। কিন্তু যুদ্ধের ডামাডোলে রাশেদ ও তার বন্ধুদের একসময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হয়। রাশেদ আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে যুদ্ধে। একসময় পাকিস্তানীদের হাতে প্রাণ যায় তার।
দূরত্ব
হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম নির্মিত দূরত্ব ছবিটি ২০০৪ সালে মুক্তি পায়। এগার বছরের একমাত্র ছেলে পুতুলকে বাবা মা কেউই ঠিকমত সময় দিতে পারেনা। বাসার কাজের বুয়াই ওর দেখা শুনা করে। বই পড়তে ছবি আঁকতে আর কম্পিউটারে গেম খেলতে ওর ভাল লাগে। এক সকালে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই বানরের খেলা দেখতে বেরিয়ে আসে। এরপর সে হাঁটতে হাঁটতে একটা পার্কে গিয়ে বসে। সেখানে আগে থেকেই ওর বয়সী আরেকটা ছেলে বসে ছিল। এরপর ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। কত শত গল্প হয়। ছেলেটা রেল স্টেশনে থাকে তার এক মাত্র বোনকে নিয়ে। ওদের মধ্যে দারুন সখ্যতা গড়ে ওঠে। ওরা ট্রেনে করে ময়মনসিংহ যায়। সেখানেই ট্রেনে এক গানওয়ালার সাথে দেখা হয় যে গান গায় আর দাতের মাজন বিক্রি করে সেই সাথে কান পাকা মলম কর্ণসুন্দর বিক্রি করে। পুতুল নতুন বন্ধুদের কাছ থেকে একটা টাকা চেয়ে নিয়ে এক কৌটা কর্ণসুন্দর কিনলে সেই বিক্রেতা যে কি খুশি হয় তা বলার নয়। ওদিকে একমাত্র ছেলেকে না পেয়ে বাবা মা দিশেহারা হয়ে যায়। এক হুজুর ডাকে। সেই হুজুর পুতুলের জামা কাপড়ের গন্ধ শুকে বলে কোথায় আছে। এভাবেই টান টান উত্তেজনায় ছবির গল্প এগিয়ে যায়।