নিজস্ব প্রতিবেদক:
২৫ ডিসেম্বর পূর্ণ হলো বাংলাদেশের প্রথম টেলিভিশন বাংলাদেশ টেলিভিশনের ৫৭ বছর। (বিটিভি)। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান টেলিভিশন নামে ঢাকার ডিআইটি ভবনে নিচতলায় জাপানের এনইসি করপোরেশন সহায়তায় সরকারি এই চ্যানেলটির পথচলা শুরু হয়। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের পর এটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। এর আগে ১৯৬৭ সালে টেলিভিশন করপোরেশন ও স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’ একটি সরকারি গণমাধ্যমে রূপান্তরিত হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে আধুনিক প্রযুক্তি সংযুক্ত করে ১৯৭৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ডিআইটির ক্ষুদ্র পরিসর থেকে রামপুরার বৃহত্তর পরিমণ্ডলে স্থানান্তর করা হয় কেন্দ্রটি। প্রথম দিকে সাদা-কালো সম্প্রচার দিয়ে হলেও ১৯৮০ সালে রঙিন সম্প্রচারে আসে বিটিভি।
জন্মলগ্ন থেকে দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিকাশে কাজ করছে টেলিভিশনটি। স্যাটেলাইটের যুগে বেসরকারী টেলিভিশনের আধিক্য বৃদ্ধি পাওয়ায় কিছুটা ম্লান হলেও ঐতিহ্য রক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে টেলিভিশনটি। সংস্কৃতিবান মানুষের পছন্দের শীর্ষে এখন অবস্থান করছে তারা। গত পাঁচ দশকে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ও নাটক উপহার দিয়েছে তারা। এখনও কিছু জনপ্রিয় অনুষ্ঠান দিয়ে যাচ্ছে টেলিভিশনটি। গত চার দশক ধরে চলছে হানিফ সংকেতের উপস্থাপনায় অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ইত্যাদি।
বেশকিছু জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের মধ্যে যদি কিছু মনে না করেন (১৯৬৭-৬৮, ১৯৮২-৮৫) ফজলে লোহানীর উপস্থাপিত ম্যাগাজিন-জাতীয় অনুষ্ঠান। সেসময় করাচি টেলিভিশনে গর তু বুরা না মানে নামে একটি অনুষ্ঠান চলছিল, এই অনুষ্ঠানটি সেটির সাথে খানিকটা সাদৃশ্যপূর্ণ। কিছুদিন পর লোহানী লন্ডনে চলে যান এবং অনুষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৯৮২ সালের দিকে দেশে ফিরে তিনি অনুষ্ঠানটি পাক্ষিকভাবে আবার শুরু করেন। এবার অনুষ্ঠানটিতে বিনোদনের অংশে মূল কাজ করেন হানিফ সংকেত, লোহানী থাকেন প্রতিবেদন অংশে। ১৯৮৫ সালে লোহানীর মৃত্যুর পর অনুষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। বলা হয় এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে টেলিভিশনের সর্বপ্রথম রিপোর্টিং শুরু হয়।
হারজিত (১৯৭৩-৭৪) : আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নির্মিত ও উপস্থাপিত ধাঁধার অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটিতে দেখুনো বিভিন্নরকম ধাঁধার মধ্যে একটি ছিল “কবির লড়াই”। কবিতার মাধ্যমে আলাপ চালানোর এই লড়াইয়ে সে সময় অংশ নিয়েছিলেন রুদ্র মহম্মদ শহীদুল্লাহ, জাহিদ হায়দার, মুহম্মদ নূরুল হুদা প্রমুখ তরুণ কবিগণ।
সপ্তবর্ণা (১৯৭৫-৭৬) : আবদুল্লাহ আবু সায়ীদেরই আরেকটি ধাঁধার অনুষ্ঠান। হারজিতের চেয়ে বড় পরিসরে এটি আয়োজন করা হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই সে সময় নবপরিচিত পপসংগীতকে (এখন ব্যান্ডগান) প্রথম জাতীয় কোনো গণমাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। অনুষ্ঠানের গাননির্ভর ধাঁধাগুলোয় অংশ নেন পপশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর ও পিলু মমতাজ। অনুষ্ঠানটির শেষ পর্বে পপশিল্পী আজম খানও উপস্থিত হন এবং তার নতুন গান আলাল ও দুলাল গেয়ে শোনান। অনুষ্ঠানটির জন্য সায়ীদ ১৯৭৭ সালে শ্রেষ্ঠ টিভি উপস্থাপকের পুরস্কার লাভ করেন।
আপনার ডাক্তার (১৯৭০ দশক) : খ্যাতিমান ডাক্তার একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী (পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) চিকিৎসাবিষয়ক এই অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করতেন এবং এর জন্য ১৯৭৮ সালে শ্রেষ্ঠ টিভি উপস্থাপকের পুরস্কার লাভ করেন।
আনন্দমেলা (১৯৭৫-বর্তমান) : আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই “ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান” নামক ধারাটি সৃষ্টি করেন। শুরুতে ১৯৭৫ সালে ঈদ উপলক্ষে এই বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান তৈরি করা হয়, প্রথম ৫ বছরে এর ১০টি পর্ব প্রচারিত হয়, যার আটটি সায়ীদ করেছিলেন; পরবর্তীতে অন্য অনেকে এটি উপস্থাপনা করে চলেছেন। বিটিভি এটিকে ঈদের মূল অনুষ্ঠান হিসেবেই প্রচার করে থাকে।
চতুরঙ্গ (১৯৭৮-৭৯) : আনন্দমেলার পর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এই ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানটি শুরু করেন। নাচ, গান, নাটিকা, ধাঁধা সবকিছু মিলিয়ে নিজস্ব উপস্থাপনায় তিনি অনুষ্ঠানটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই জাদুকর জুয়েল আইচকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
ভরা নদীর বাঁকে (১৯৯০ দশক) : মোস্তফা জামান আব্বাসীর উপস্থাপিত গ্রামবাংলার লোকসংগীত বিষয়ক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রাববাংলার লোকসঙ্গীত জনপ্রিয়তা পায়।
ইত্যাদি (১৯৮৯-বর্তমান)। হানিফ সংকেতের নির্মিত ও উপস্থাপিত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান। এটি প্রথমে পাক্ষিক, পরে মাসিক এবং এখন ত্রৈমাসিকভাবে প্রচারিত হয়; তবে ঈদ উপলক্ষে বিশেষ পর্বের আয়োজন করা হয়।
শুভেচ্ছা (১৯৯৭) : আবদুন নূর তুষার এই বিনোদনমূলক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানটি প্রচার করেন। ইত্যাদির পর এটি জনপ্রিয়তা পায় নব্বই দশকের নগরজীবনের মানুষের কাছে।
শাইখ সিরাজের উপস্থাপিত কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান মাটি ও মানুষ দেশের কৃষকের কথা ও কৃষ্টির কথা তুলে ধরে।
সিসিমপুর (২০০৪-বর্তমান) পুতুল দিয়ে তৈরি শিশুতোষমূলক অনুষ্ঠান। নতুন কুঁড়ি (১৯৬৬, ১৯৭৬-২০০৬)। মুস্তফা মনোয়ারের এই অনুষ্ঠানটি ছিল মূলত শিশুশিল্পীদের নিয়ে। এছাড়া বিটিভি জাতীয় বিতর্ক মাতৃভাষা, জনপ্রিয় নাটক মুখরা রমণী বশীকরণ (১৯৬০ দশক)। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের লেখা নাটক টেমিং অফ দ্য শ্রুর অনুবাদ করেন মুনীর চৌধুরী এবং মুস্তাফা মনোয়ার সেটি নিয়ে নাটক পরিচালনা ও প্রযোজনা করেন। নাটকটিতে মূল অভিনেতা ও অভিনেত্রী ছিলেন গোলাম মোস্তফা ও আজমীরী জামান (রেশমা)।
এছাড়া খুবই জনপ্রিয় নাটক ছিল বিটিভির। যেখান থেকে মূলত বাংলা নাটকের উত্থান। এ নাটকগুলোই পাথেয় হিসেবে কাজ করেছিল পরবর্তীতে বাংলা নাটকে। সংশপ্তক, কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার, বহুব্রীহি, নক্ষত্রের রাত ছিল উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় নাটকের মধ্যে অন্যতম।
এছাড়া বিটিভির আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানগুলোও জনপ্রিয়তা পায়। স্পেলবাইন্ডার, স্পেলবাইন্ডার- ল্যান্ড অফ দ্যা ড্রাগন লর্ড, কেয়ার বেয়ারস, ডালাস, ফেয়ারী টেল থিয়েটার, আলিফ লায়লা, ফ্যামিলি টাইস, নাইট রাইডার, ম্যাকগাইভার, মিয়ামি ভাইস, পারফেক্ট স্ট্রানজারস, রভেন, স্মার্ফস, দ্যা বিল কসবি শো, দ্যা গার্ল ফ্রোম টুমোরো, দ্যা টুইলাইট জোন, দ্যা এক্স-ফাইলস, থান্ডার ক্যাটস, টুইন পিকস, জুয়েল ইন দ্য প্যালেস, রবিনহুড, ইনক্রেডিবল হাল্ক ইত্যাদি। টেলিভিশনে প্রথম প্রচারিত অনুষ্ঠানে প্রথম গান গেয়েছিলেন ফেরদৌসী রহমান, গানটি ছিল আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখা এই যে আকাশ নীল হল আজ / এ শুধু তোমার প্রেমে। টেলিভিশন কেন্দ্রের প্রথম প্রযোজক ছিলেন মুস্তাফা মনোয়ার, জামান আলী খান ও মনিরুল ইসলাম; পরবর্তীতে আসেন শহীদ কাদরী, আবদুল্লাহ আল মামুন, সৈয়দ আবদুল হাদী, দীন মোহাম্মদ, মোহাম্মদ জাকারিয়া, আতিকুল হক চৌধুরী। আর অনুষ্ঠান বিভাগের প্রথম ব্যবস্থাপক ছিলেন কলিম শরাফী।