রোমান কবির
মেঘ পিয়নের ব্যাগের ভেতর মন খারাপের দিস্তা/ মন খারাপ হলে কুয়াষা ধোঁয় ব্যাকুল হলে তিস্তা/মন খারাপের খবর আসে/ বন পাহাড়ের দেশে/ চৌকোনা সব বাক্সে যেথায় যে মন থাকছে সে/ মন খারাপের খবর পড়ে দারুণ ভালবেসে/ মেঘের ব্যাগের ভেতর ম্যাপ রয়েছে মেঘ পিয়নের পাড়ি/পাকদন্ডী পথ বেয়ে তার বাগান ঘেরা বাড়ি…….।
পাহাড়ের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘ। পাহাড়ি রাস্তায় ছুটে চলছে গাড়ি। যারা একবার হলেও পাহাড়ে গেছেন তাদের জন্য এনে দেয় নস্টালজিয়া। সঙ্গে যাদের আছে কিছু মন খারাপের গল্প তাদের করে দেয় আনমনা। তিনটি ক্লোজআপে তিনটি ফটোগ্রাফ বলে দেয় একটি পরিবারের গল্প। কিশোরী তিতলির ফ্যান্টাসি, সিনেমার সুপারস্টার হিরো।
মেঘ কেটে পিয়ন এসে চিঠি দিয়ে যায়। তিতলির মন খারাপের আরেকটি বার্তা। আসেনি যে চিঠির অপেক্ষায় থাকে তিতলি। তার বান্ধবী প্রিয়া হিরোর চিঠি পেয়েছে। সে নিয়ে মায়ের কাছে অভিমান অভিযোগ তার। মায়ের স্বান্তনা বানী- চিঠি দিবে হিরো। তারপরও বিশ্বাস হতে চায়না তা-ই প্রশ্ন। ‘ও আমায় লিখবেনা মা’। মায়ের আশ্বাস ‘লিখবে লিখবে, পোষ্টে গন্ডগোল হয়েছে মনে হয়।’ ‘লিখবে বলো’, ‘বললাম তো লিখবে’। কথা ঘুরানোর চেষ্টা মায়ের। ‘কি পড়বি বল আমি বের করে দিচ্ছি’।
হিরোকে বিয়ে করতে চায় তিতলি। আঙুল দিয়ে মাকে দেখায় হিরোর ছবি। মা-মেয়ের ক্লোজ আপ একসাথে। এ কি খেলছে- মায়ের চোখে মুখে। দর্শকের মনে চিন্তার রেখা টেনে দেয়।
বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তিতলি। একি শুধু তিতলির গল্প নাকি তার মায়েরও গল্প। হিরো রোহিত রায় কি শুধু তিতলির, নাকি তার মায়েরও হিরো। মা-মেয়ের মন খারাপের গল্প বলছে ঋতুপর্ণ ঘোষ। হিরো রোহিত রায়কে ঘিরে তিতলির ফ্যান্টাসি, বিরক্ত দেখালেও আনন্দ দেয় মাকে। মা তাই তিতলির মাঝবয়সী হিরোকে বিয়ে করতে চাওয়াকে লাই দিচ্ছেন।
ক্লোজ শটে দেখাচ্ছেন মা-মেয়ের অভিমান আর লাজুক চাহনিকে। সংলাপ নির্ভর ছবির মা-মেয়ের কথা-বার্তা এগিয়ে নিয়ে যায় ছবির গল্প। গাড়ি দিয়ে মুম্বাই ফেরত বাপিকে তুলতে চায় তিতলি ও তার মা। রোহিত রায়কে নিয়ে গল্পের মাধ্যমে ছবির শুরু। সেটি এগোয় মায়ের কিশোরী বয়সের নস্টালজিক গল্পের মধ্য দিয়ে। এক সময় মাঝ রাস্তায় গাড়ি ব্রেক কষে। একটি সিনেমার প্রোডাকশন কন্ট্রোলার তাদের এক শিল্পীর জন্য লিফট চায়। তবে যখন জানতে পারেন এই শিল্পী আর কেউ নন, তিতলির সেই প্রিয় সিনেমার হিরো রোহিত রায়।
তখন তিতলির চাপা উত্তেজনা তার ক্লোজ শটে না ধরে টু শটে মা-মেয়ের ক্লোজশটে ছবির ক্লাইমেক্সেকে আরও চূড়ান্ত করে। তিতলির চাপা উত্তেজনা ম্লান হয়ে তখন ধরা দেয় মায়ের চাপা উত্তেজনাকে। আর তাই তো ডিফোকাসে দূর থেকে রোহিত রায়ের আসার চিত্র দেখে বুক কেঁপে উঠে উত্তেজনায় সেটা তিতলির মায়েরই। তিতলিকে নয়, তিতলির মাকে দেখে কিছুটা চমকে উঠার মতো অবস্থা রোহিত রায়ের। গাড়ির মধ্যে তিতলি আর রোহিত রায়ের আড্ডার মাঝে মায়ের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা রোহিত রায়ের।
গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে তিতলি ও গাড়ির ড্রাইভারের বাজারে চলে যাওয়া। পাহাড়ের মাঝে একা রোহিত রায় ও উর্মি (তিতলির মা)। কিছুটা থমকে যাওয়া দু’জনের। তারপরে কাছে আসা। তৈরি হয় তিতলির হিরোর সঙ্গে মায়ের কাছে আসার গল্প। একটি জীর্ণ শীর্ণ উদ্বাস্তু কলোনীতে থাকে যুবক রানা ওরফে রোহিত রায়। একটি ফিল্মের হিরো হবার চেষ্টায় সিনেমা পাড়ায় ঘুরছে। এদিকে অবস্থাসম্পন্ন ঘরের উর্মির সঙ্গে তার প্রেম। একসময় বিয়ে হয়ে যায় উর্মির। বহু বছর পরে সেই উর্মির সঙ্গেই দেখা পাহাড় ঘেরা দার্জিলিংয়ে। এতদিনে উদ্বাস্তু কলোনীর রানা হয়ে উঠেছে সুপারস্টার রোহিত রায়। মুম্বাইতে তার বিরাট বাংলো। তবে এখনও বিয়ে করেনি। এটা কি শুধু উর্মিকে ভুলতে পারেনি বলে।
হিরোর সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে উচ্ছ্বাস নিয়ে ফিরে আসে তিতলি। আশেপাশে নেই রোহিত রায় ও তার মা। কুয়াশার আড়ালে শোনা যায় তিতলির মায়ের গান। রোহিত রায়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের কথা জানা হয়ে যায় তার। মা-মেয়ের মধ্যে অভিমান জমে, ঝড়ের রাতে মেয়েকে সব খুলে বলে উর্মি। রোহিত রায় বিয়ে করে এক সাংবাদিককে। চিঠি আসে মায়ের কাছে, ম্যাগাজিনে ছাপা হয় তার বিয়ের খবর।
কিশোরী অবুঝ তিতলি হঠাৎ যেন হয়ে উঠে দায়িত্বশীল একজন। দীর্ঘদিনের কুয়াশা কেটে রোদ উঠে চারদিকে। জানালার পাশে বসা মা-মেয়ের ক্লোজআপ থেকে ক্যামেরা ট্র্যাকিং ব্যাক করে লং শটে চলে যায়। শেষ হয় ঋতুপর্ণ ঘোষের মা-মেয়ের মন খারাপের আখ্যান তিতলি। আসলেই কি শেষ হয় নাকি- সঙ্গীতকার দেবজ্যেতি মিশ্রের সৃষ্টিতে আখ্যান সৃষ্টি হয় নতুন বারতা দিয়ে।
মেঘ পিয়নের কোথায় বাড়ি, কোথায় সে কোন দুরে/ আষাঢ় হলেই কোথায় থেকে আসে আকাশ জুড়ে/মন খারাপের দিস্তে গুলি কখন বিলি করে, রাত জাগা কোন ভোরে, মেঘের দ্বি-প্রহরে/পাকদন্ডী পথের দ্বারে বাগান ঘেরা ঘরে/এখন রোদ উঠেছে, মেঘ পিয়নের যাওয়ার সময় প্রায়/ যেসব চিঠি হয়নি বিলি পড়েছে ঝরণায়..
অভীক মুখোপাধ্যায়ের চিত্রধারণ ও অর্ঘ্যকমল মিত্রের কাঁটাছেঁড়া তিতলির আখ্যানকে করেছে সমৃদ্ধ। অপর্ণা সেন আর কঙ্কণা সেন শর্মার রাগ, দু:খ, ক্ষোভ আর অভিমান-ফ্যান্টাসির শ্রুতিমধুর সংলাপ আখ্যানে মিলিয়ে যেতে সহায়তা করেছে অন্ধকারে বসা দর্শককে। মিঠুন চক্রবর্তী আর দীপংকর দে’র পর্দায় উপস্থিতি আখ্যানের ক্ষুধা মিটিয়েছে আরও।
শৈলেশ জয়সওয়ালের শব্দসৃজন অনুভূতিতে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে। সংলাপ প্রক্ষেপন চমৎকারভাবে ফুটিয়ে এনেছে। ফলি সাড়া ফেলার মতো। সব মিলিয়ে নাটক, সংলাপ আর চিত্র ধারণের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সম্পাদনায় নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষের মুন্সিয়ানায়, জাস্ট স্যালুট।
লেখক: সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা