বিশেষ প্রতিবেদক:
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি। ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু, গড়ায়ে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি। আমার সোনার দেশের রক্তে জাগালো ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে এ গানটি লেখেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। যা সুর করেন গীতিকার-সুরকার ও শিল্পী আবদুল লতিফ। পরে এ গানে সুর সংযোজন করেন এ দেশের মহৎ সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদ।তাঁর সুরের কারণেই প্রভাত ফেরির অনিবার্য গান হয়ে ওঠে এটি। হয়ে উঠে আমাদের অমর একুশের গান।
এর আগে অনেক শিল্পী রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে নিয়ে গান রচনা করেন ও সুর করেন। আটচল্লিশের ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের প্রথম পর্ব থেকে ভাষার গান রচনা শুরু হয়। সর্বপ্রথম গানটি রচনা করেন কবি ও গীতিকার অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরী। এতে সুরারোপ করেন প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী শেখ লুৎফর রহমান। গানটি হচ্ছে-‘শোনেন হুজুর/ বাঘের জাত এই বাঙালেরা/ জান দিতে ডরায় না তারা,/ তাদের দাবি বাংলা ভাষা/ আদায় করে নেবে তাই’। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির পটভূমিতে তিনি আরও কিছু গান রচনা করেন। যেমন- বাংলার বুকের রক্তে রাঙানো আটই ফাল্গুন/ ভুলতে কি পারি শিমুলে পলাশে হেরি লালে লাল খুন’
আবার যেমন আছে-বাংলাদেশ আর বাংলা ভাষা যখন একই নামের সুতোয় বাঁধা’।
১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের ঘটনা সারা দেশকে কাঁপিয়ে দেওয়ার পর তা নিয়ে প্রথম গান লেখেন ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক। তিনি লেখেন ‘ভুলব না, ভুলব না, একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’। গানটিতে সুর করেন নিজাম উল হক। অমর একুশের সূচনাপর্বের গান হিসেবে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। অমর একুশের আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত একাধিক ভাষাসংগ্রামী তাঁদের একুশের স্মৃতিচারণামূলক রচনায় গাজীউল হকের গানটিকে একুশের প্রথম গান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
ভাষাসংগ্রামী প্রকৌশলী মোশারেফ উদ্দিন আহমদদ লেখেন- ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল/ ভাষা বাঁচাবার তরে/ আজিকে স্মরিও তারে’ গানটি গাওয়া হয়। এটি ১৯৫৩ সালের প্রভাতফেরীতে প্রথম গাওয়া হয়। এটি সুর করেন আলতাফ মাহমুদ।
অমর একুশের আরও খবর
⇒ প্রভাত ফেরির মিছিল……
⇒ অমর একুশের সিনেমা
সুরকার ও শিল্পী আব্দুল লতিফ লিখলেন কালজয়ী একুশের গান: ‘ওরা আমার মুখের ভাষা/ কাইড়া নিতে চায়,/ ওরা, কথায় কথায় শিকল পরায়/ আমার হাতে পায়।’তারপর লিখলেন ‘বুকের খুনে রাখলো যারা/ মুখের ভাষার মান/ ভোলা কি যায়রে তাদের দান?’, ‘আমি কেমন কইরা ভুলি/ মুখের কথা কইতে গিয়া/ ভাই আমার খাইছে গুলি’, ‘রফিক-শফিক বরকত নামে/ বাংলা মায়ের দুরন্ত কটি ছেলে।/ স্বদেশের মাটি রঙিন করেছে/ আপন বুকের তপ্ত রক্ত ঢেলে’, ‘আবার এসেছে অমর একুশে/ পলাশ ফোটানো দিনে,/ এ দিন আমার ভায়েরা আমায় বেঁধেছে রক্তঋণে।
এদিকে শহরের নামীদামী গীতিকার ও শিল্পীরা গান রচনা করলেও ভাষার গান নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের চারণ কবি, গীতিকার ও শিল্পীরাও তৈরী করেন কালজয়ী গান। এগুলো সব সংরক্ষণ না হলেও কিছু কিছু সংরক্ষিত আছে। শামসুদ্দিন আহমদ, রমেশ শীল, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, শাহ আবদুল করিম, মহিন শাহ, আবদুল হালিম বয়াতি, মাতু মিয়া, কবিয়াল ফণী বড়ুয়ার মতো গ্রামে-গঞ্জের শিল্পীরা তাদের এ সব ভাষার গান নিয়ে চষে বেড়িয়েছেন হাটে বাজারে। শামসুদ্দিন আহমদ লেখেন-রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালি/ তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি। মোহাম্মদ মাতু মিয়া লেখেন বাংলা আমার মায়ের ভাষা এমন ভাষা আর যে নাই/ এ ভাষাতে মা-কে ডাকি ডেকেছে মোর সালাম ভাই।
শাহ আবদুল করিম লেখেন সালাম আমার শহীদ স্মরণে/ দেশের দাবি নিয়া দেশপ্রেমে মজিয়া/ প্রাণ দিলেন যেসব বীর সন্তানে। রমেশ শীল লেখেন-ভাষার জন্য জীবন হারালি/ বাঙালি ভাইরে রমনার মাটি রক্তে ভাসালি। বিজয় সরকার লেখেন- ‘বাংলাদেশের মানুষ, ফেব্রুয়ারি একুশে ভুলিতে পারবে না জীবনে/ ভাষা আন্দোলনের জন্য জনসমাজ হল বিপন্ন কুখ্যাত সরকারের শাসনে। ফণী বড়ুয়া লেখেন-বাঙালিদের বাংলা ভাষার রাখি ইজ্জত মান/ হাসিমুখে সফিক বরকত করে জীবন দান। আবদুল হালিম বয়াতি লেখেন-এদিক-ওদিক বলতে আমার অনেক হবে দেরি/ মন দিয়া শোনেন ভাষা আন্দোলনের জারি।