মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ দেশে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য কালজয়ী সিনেমা। তবে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা যে আন্দোলন থেকে, সেই ভাষা আন্দোলন যা আমাদের অহংকার, তা নিয়ে তৈরি হয়নি তেমন কোন সিনেমা। সত্তর সালে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান নির্মাণ করেন ভাষা আন্দোলন নিয়ে সিনেমা ‘জীবন থেকে নেয়া’। কিন্তু তাও পাকিস্তান সরকারের নানামূখী বাধার মুখে। দেশ স্বাধীনের পর বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা শহীদুল ইসলাম খোকন নির্মাণ করেন ‘বাঙলা’ নামের একটি চলচ্চিত্র। যে চলচ্চিত্রটি ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত। ছবিটিতে একটি বোবা মেয়ে কথা বলা শেখে একটি শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে। ছবির শেষে বোবা মেয়ের ভাষা বলার চেষ্টা। শেষমেষ বলতে পারা একটি শব্দ-বাঙলা।
জহির রায়হান ‘জীবন থেকে নেয়া’ ও শহিদুল ইসলাম খোকন তার ‘বাঙলা’ নামের ছবিতে কিছুটা হলেও ভাষা আন্দোলনকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তবে এছাড়া আর কোন চলচ্চিত্রই নির্মিত হয়নি। তবে জহির রায়হান ভাষা আন্দোলন নিয়ে আরেকটি সিনেমা নির্মানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালে চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তা নির্মাণের অনুমতি দেননি। এমনকি এফডিসিতে জমা দেয়া চিত্রনাট্যও ফেরত দেয়া হয়নি। দেশ স্বাধীনের পরে ছবিটি নির্মাণের চিন্তা করলেও তা বানাতে পারেননি জহির রায়হান। তিনি চলে গেলেন চিরতরে। পরে জহির রায়হানের স্ত্রী চিত্রনায়িকা সুচন্দা ছবিটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। কিন্তু চিত্রনাট্য খুঁজে না পাওয়ার কারণে তার সেই উদ্যোগও ভেস্তে যায়।
এই চলচ্চিত্রটি ছিল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের বড় প্রেরণা। একুশের কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ ছবিটিতে ব্যবহার করা হয়। এ গানটিকে মানুষের কাছে জনপ্রিয় করার পেছনে ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
এছাড়া যখন পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ ছিলো তখন এ চলচ্চিত্রে তাঁর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি ব্যবহার করা হয়। যা মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি দেন। ছবিটিতে ব্যবহার করা কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী গান ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ এবং খান আতাউর রহমানের বিখ্যাত গান ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে’। যে সব গান মুক্তিযুদ্ধে উজ্জীবিত করেছিলো মানুষকে।
স্বাধীন দেশে নির্মিত শহিদুল ইসলামের ‘বাঙলা’ সিনেমা ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে নির্মিত। এটিতে একটি পরিবারের সাংস্কৃতিক জাগরণ ও একটি বোবা মেয়ের কথা বলার চেষ্টা বিধৃত হয়। মেয়েটি পরিবারের অন্য সদস্যদের মত কথা বলতে চায়। গান গাইতে চায়। পারেনা, তারপরও তার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। একসময় একটি ভাষার মিছিল যায়। ছবিটি শেষ হয় ভাষার মিছিলের সঙ্গে একাত্ন হয়ে বোবা মেয়েটির কথা বলার চেষ্টার মধ্য দিয়ে। যেখানে সে কথা বলতে পারে। আর প্রথম যে শব্দটি সে উচ্চারণ করে সেটি হচ্ছে বাঙলা।