রোমান কবির:
উনষত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলোতে পাকিস্তানে চলছে অস্থিরতা। সেই অস্থিরতার মধ্যে এফডিসির ২নং ফ্লোরে চলছে একটি সিনেমার শ্যুটিং। সেই শ্যুটিং নিয়ে পাকিস্তানী শাসকদের মধ্যে অস্থিরতা আরও বাড়ে। হঠাৎ একদিন আর্মি এসে শুটিং বন্ধ করে দেয়। সকাল দশটায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে যায় পরিচালক জহির রায়হান ও অভিনেতা রাজ্জাককে। বিকেল চারটায় ফিরে আসেন তারা। আসার আগে বন্ডসই দিয়ে আসতে হয় আর্মিদের কাছে। এরপরে অনেকবার সামরিক সরকারের কাছে তাকে জবাবদিহী করতে হয়, হাজিরা দিতে হয়। এর মধ্যেই তিনি করছেন সিনেমার কাজ। অবশেষে এরকম একটা বৈরী পরিবেশে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের উপর প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেন জহির রায়হান। ছবিটি শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, এটি স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেরণা। একটি আন্দোলন, একটি যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধের হাতিয়ার ক্যামেরা, লাইট আর সেলুলয়েড।
আমজাদ হোসেনকে সাথে নিয়ে দাঁড় করিয়ে ফেললেন অসাধারণ চিত্রনাট্য। গওহর জামিলের স্ত্রী রওশন জামিলকে নিলেন পরিবারের স্বৈরাচারী গিন্নির শক্তিশালী চরিত্রে। নিলেন রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেন, খান আতা, বেবি জামান, রোজি সামাদের মতো শক্তিমান অভিনেতাদের। তাদের নিয়ে জহির রায়হানের বাসায় হতো গোপন মিটিং। শুধু একটি ছবি নয়, এটি যেন একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি। আসলেই যুদ্ধ। পাকিস্তান শাসকগোষষ্ঠীর রক্তচক্ষু তখন তাদের উপর। এ কথা সবাই জানতেন। কিন্তু তারা যেন দীক্ষিত বিপ্লবী মন্ত্রে। প্রতিকুল পরিবেশে শুরু করলেন ছবির কাজ। ছবির প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি ক্যাবিন ক্রু- এক একজন হয়ে উঠলেন বিপ্লবী।
চলচ্চিত্রের প্রতিটি চরিত্র ছিল তৎকালীন সমাজ ও রাজনৈতিক একেকটি ঘটনার রূপক চরিত্র। আনোয়ার হোসেন ছিলেন বাংলার মুক্তি আন্দোলনের এক রাজনৈতিক নেতা। রাজ্জাক প্রগতিশীল ও প্রতিবাদী ছাত্রসমাজের একজন প্রতিনিধি। রওশন জামিল পাকিস্তানী স্বৈরাচার সরকারের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছেন। আর খান আতা সেই স্বৈরাচারীর শোষণে নিষ্পেষিত মুক্তির চেতনায় উদ্ভাসিত জনতা।
‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি একটি পরিবারের গল্প বলে। যে পরিবারের আধিপত্য নিয়ে চলে লড়াই। সেই পরিবারের একমাত্র স্বৈরাচারী চরিত্র রওশন জামিল উগ্রচণ্ডী দজ্জাল বড় বোন। তাঁর নির্যাতনে স্বামী খান আতাউর রহমান থাকেন তটস্ত। তাঁর উপর কোনো কথা বলার সাহস পায়না তার দুই ভাই শওকত আকবর ও রাজ্জাক।
একসময় তারা নীরব বিপ্লব করে বসে। শওকত আকবর বউ নিয়ে ঘরে আসে। রওশন জামিলের কপালে চিন্তার ভাঁজ। সংসারের একমাত্র চাবির গোছা যেন হাতছাড়া না হয়ে যায়। সে জন্য আগত বউয়ের উপর চলে নিষ্পেষনের স্টিম রোলার। এই নিষ্পেষণের সমাপ্তি ঘটাতে ছোট ভাই রাজ্জাক বিয়ে করলো। দুই ভাইবধূ রোজী ও সুচন্দা মিলে চাবির গোছা হস্তগত করে। এই চাবি হাতে পাওয়ার জন্য স্বৈরাচার রওশন জামিল কুটচালের আশ্রয় নেয়। এই কুটচালের চরম পর্যায়ে দুই বোনের মধ্যে ষড়যন্ত্র করে ভাঙন ধরায়। চাবি আবারও হস্তগত করে বড় বোন।
এই কুটচালে নিষ্পেষিত তার স্বামী, আর দুই ভাই। সঙ্গে আছে বাড়ির চাকর বাকর। এই পরিবারের আত্ন্রীয় রোজী ও সুচন্দার বড় ভাই আনোয়ার হোসেন। তিনি একজন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা। সরকারের শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন তিনি। পরিচালক জহির রায়হান একটি পরিবারের গল্প বলেছেন। সাথে বলেছেন দেশের ভাষা আন্দোলনসহ পাকিস্তান সরকারের নিপীড়নের সত্যকথন।
সেই পরিবারটি এই দেশ, পরিবারের চাবির গোছা হচ্ছে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু আর তা নিয়ে স্বৈরাচারী বড় বোনের সঙ্গে দুই ভাইয়ের বউয়ের লড়াই। সব লড়াই শেষে শহীদ মিনারে গিয়ে শহীদদের স্মরণ। এ যেন বাঙালিদের উপর পাকিস্তান সরকারের শোষণ-নিপীড়ন আর এ দেশের মানুষের মুক্তির আকাঙ্খার সার্থক রুপায়ন করেছেন পরিচালক। শুধু রুপক নয়, আনোয়ার হোসেন ও রাজ্জাকের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিষ্পেষিত বাঙ্গালীর আন্দোলন সংগ্রাম ও জেল-জুলুমের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে ছবিটিতে।
ছবিটিতে জেলে আনোয়ার হোসেন ও রাজ্জাকসহ মুক্তিকামী রাজনীতিকরা নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি ব্যবহারের মাধ্যমে বাঙ্গালিদের উৎসাহ দিয়েছে। রাজ্জাকের নবজাতক এর নাম মুক্তি নামের মাধ্যমে বাঙালির মুক্তির আকাঙ্খা। ছবিটিতে ব্যবহার হয় রবীন্দ্রনাথের ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী’কবিতাটি।
এছাড়া রীবন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি প্রথম ব্যবহার করেন জহির রায়হান তাঁর ছবিতে। সেখান থেকেই গানটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দেশ স্বাধীনের পর এটিই হয় আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। অর্থাৎ ছবিটি প্রতিটি ফ্রেমে স্বাধীনতার আকাঙ্খার সার্থক চিত্রায়ণ করেছেন জহির রায়হান।
১৯৭০ সালে ১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের বছরখানেক আগে ছবিটি মুক্তি দেয়া হয়। অনেক দেন দরবার ও বাধার মুখে ছবিটি মুক্তি পায়। ছবিটির পোস্টারেই রয়েছে প্রেরণা। এর স্লোগান-‘একটি দেশ, একটি সংসার, একটি চাবির গোছা’। ছবির নাম ‘জীবন থেকে নেয়া’। সত্যিই তৎকালীন বাঙালির জীবন থেকে নিয়েই ছবিটি। যা জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্ধুদ্ধ করে।
ছবিটির চিত্রনাট্য করেন আমজাদ হোসেন। চিত্রগ্রহণ করেন আফজাল চৌধুরী, সম্পাদনায় মলয় বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গীত পরিচালনায় খান আতাউর রহমান। আনিস ফিল্মের পরিবেশনায় অভিনয় করেন রাজ্জাক, সুচন্দা, আনোয়ার হোসেন, শওকত আকবর, রোজি সামাদ, খান আতাউর রহমান, রওশন জামিল, বেবি জামান আমজাদ প্রমুখ।
লেখক: সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।