রোমান কবির :
গত শতকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের ছেলে থেকে বুড়ো সবার কাছেই সমান জনপ্রিয় এই ব্যক্তিটি। পরনে নোংরা ঢিলেঢালা প্যান্ট, জীর্ণ কালো কোট আর পায়ে মাপহীন জুতো। মাথায় কালো হ্যাট আর হাতে লাঠি নিয়ে হাঁটছেন ভবঘুরে মানুষটি। দেখেই হাসি পায়। তাঁর অদ্ভূত তবে বাস্তব উপলব্ধিতে নাড়া দেয় এমন কান্ড-কারখানা দেখে হাসি থামাতে পারেনা কেউই। ভবঘুরে চরিত্র সৃষ্টিকারী এই ব্যাক্তির জীবনটাই ছিল ভবঘুরে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের প্রিয়, কারও কারও কাছে অনুকরণীয় আদর্শ স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র। যার পরিচয় চার্লি চ্যাপলিন নামে। নির্বাক যুগের এই অভিনেতার আজ জন্মদিন। কালচারাল ইয়ার্ডের পক্ষ থেকে এই মহাঅভিনেতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল ইংল্যান্ডের দক্ষিণ লন্ডনের ওয়েলওর্থের বার্লো স্ট্রিটে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা চার্লস চ্যাপলিন আর মা হানা চ্যাপলিন দু’জনই ছিলেন অভিনয় শিল্পী। এ জন্য পারিবারিক আবহেই তাঁর শিল্পসত্তা বিকশিত হয়। তবে তাঁর ছেলেবেলা খুব বেশি সুখকর ছিলো না। ছোটবেলাই বাবাকে হারান। পিতৃহারা চ্যাপলিনের সেই থেকে কষ্টের শুরু। মাত্র নয় বছর বয়সে তাঁকে রোজগার শুরু করতে হয় পরিবারের হাল ধরার জন্য। তিনি অবর্ণনীয় কষ্ট আর দারিদ্র্যতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছেন সাফল্যের শীর্ষে।
এই দুর্দশাগ্রস্থ শৈশব সম্পর্কে চ্যাপলিন বলেছিলেন, যদি ভাগ্য সহায় না হতো তাহলে আমি লন্ডনের পথে পথে চুরি করে বেড়াতাম। আর বেওয়ারিশ লাশ হয়ে কবরে যেতে হতো।
মা ও ভাইয়ের সঙ্গে দক্ষিণ লন্ডনে বসবাস করতেন তিনি। তবে ভাড়া দিতে পারতেন না প্রায়ই এ জন্য তাদেরকে বাসা থেকে বের করে দিতেন বাড়িওয়ালা। এরপর অন্য একটি বাড়িতে উঠতেন। এভাবে তাড়া খাওয়ার চেয়ে পার্কের বেঞ্চিতেই তিনি বেশি থাকতে পছন্দ করতেন। চার্লি একটি মুদির দোকানে কিছু দিন কাজ করেন। এরপর সেখান থেকে কাজ পান একটি ডাক্তারখানায়। সেখানে কাজ চলে যাওয়ার পর লোকের বাড়িতে বাসন মাজার কাজ নেন। এরপর একে একে রঙের দোকান, লোহার দোকান, কাঁচের কারখানা, ছাপাখানা, কাগজ বিক্রিসহ নানা ধরণের কাজ করেন।
চার্লি চ্যাপলিন সম্পর্কিত আরও খবর
⇒ চার্লি চ্যাপলিনের ১৩০তম জন্মদিন
তার মা-বাবা দু’জনেই মঞ্চাভিনয় করতেন। সেই সুবাদে মায়ের স্থলাভিষিক্ত হয়ে কাজ শুরু করেন মঞ্চে। কারণ তার মাকে তখন পাগল হয়ে পাগলাগারদে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিলো। সেই সময়ের জনপ্রিয় লোকদল ‘জ্যাকসন্স এইট ল্যাঙ্কাশায়ার ল্যাডস’-এর সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন চ্যাপলিন।
৯ বছর বয়সে চ্যাপলিন একটি নাচের দলে যোগ দেন। ওই দলটির সঙ্গে যুক্ত থেকে নাচ দেখিয়ে কিছু অর্থ-কড়ি রোজগার করতেন। সেই রোজগার দিয়েই চ্যাপলিন দিন কাটাতেন। ওই নাচের দলে চ্যাপলিন কমেডিয়ানের ভূমিকা পালন করতেন।
১৯১৪ সালে ২৫ বছর বয়সে প্রথম সিনেমাতে অভিনয় করেন চার্লি চ্যাপলিন। নাম ছিলো ‘মেকিং এ লিভিং’। সিনেমার পরিচালক ছিলেন ফ্রান্সের অরি লোর্মা। এক রিলের এ সিনেমাটি প্রদর্শনের মেয়াদ ছিল মাত্র দশ মিনিট। এ সিনেমাতে চার্লি অভিনয় করেন খামখেয়ালি উচ্ছৃংখল প্রকৃতির যুবকের চরিত্রে।
১৯১৪ সালে তার নিজের সৃষ্ট দ্য ট্রাম্প বা ভবঘুরে চরিত্রটি দিয়ে তিনি বিশ্ব চলচ্চিত্রে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগে মানুষকে হাসানোর মতো দুরূহ কাজটি শুধু অঙ্গভঙ্গি দিয়ে তিনি করতেন অত্যন্ত সফলভাবে। ১৯১৮ সালের মধ্যে তিনি বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের মর্যাদা লাভ করেন।
তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র সিটি লাইট ১৯৩১ সালে নির্মিত একটি নির্বাক হাস্যরসাত্মক প্রেমের সিনেমা। এ সিনেমাটি চার্লি চ্যাপলিনের কাহিনী, পরিচালনা ও প্রযোজনায় নির্মিত। এটি কমেডি-রোমান্টিক সিনেমার ক্যাটাগরিতে আজও এক নম্বর স্থান দখল করে আছে। ১৯৪০ সালে নির্মিত দ্য গ্রেট ডিকটেটর চলচ্চিত্রটি তাঁর বানানো অন্যতম আলোচিত ছবি।
১৯২৫ সালের ৬ জুলাই প্রথমবারের মতো অভিনেতা হিসেবে টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে আসেন চার্লি চ্যাপলিন। চার্লির ট্রেড মার্ক চরিত্র ভবঘুরে ২৬ বছরে আবির্ভূত হয় ৭০টি পূর্ণ ও স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিতে। ১৯৮৭ সালে দেড় লাখ ডলারে বিক্রি হয় চার্লির টুপি ও ছড়ি।
চার্লি চ্যাপলিন নিজেই নিজের নির্মিত ছবিতে অভিনয় করতেন, চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা করতেন। এমনকি অনেক ছবি তিনি নিজে প্রযোজনা করতেন। এমনকি সঙ্গীত পরিচালনাও করতেন তিনি।
চ্যাপলিনের উল্লেখযোগ্য সিনেমা
তার চলচ্চিত্রগুলোতে বৈরীতার সাথে দ্যা ট্রাম্পের সংগ্রামের করুণ রসের স্ল্যাপস্টিক হাস্যরস বিদ্যমান ছিল। কয়েকটি চলচ্চিত্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়বস্তু ছিল এবং কয়েকটিতে আত্মজীবনীমূলক উপাদান ছিল। চ্যাপলিন তার কাজের পুনঃস্বীকৃতি পেলে ‘এই শতাব্দীর চলচ্চিত্রকে শিল্প রূপে দাঁড় করানোর পিছনে তার অপরিমেয় প্রভাবের জন্য’ তাকে ১৯৭২ সালে একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার প্রদান করা হয়। শিল্পকলায় অবদানের জন্য তাকে ফ্রান্স সরকার ১৯৭১ সালে লেজিওঁ দনরের কমান্ডার ও রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯৭৫ সালে নাইটহুডে ভূষিত করেন।
মৃত্যুর পরও চ্যাপলিন তাঁর নির্মিত দ্য গোল্ড রাশ, সিটি লাইট্স, মডার্ন টাইমস ও দ্য গ্রেট ডিক্টেটর চলচ্চিত্র দিয়ে অমর হয়ে আছেন। এই চলচ্চিত্রগুলোকে প্রায়ই মার্কিন চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা তালিকায় স্থান করে নিতে দেখা যায়।
চার্লি চ্যাপলিনের ৭৫ বছরের দীর্ঘ অভিনয় জীবনে তিনটি বাদে বাকি সব চলচ্চিত্রই ছিল নির্বাক। চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম কথা বলেন ১৯৪০ সালে, দ্য গ্রেট ডিকটেটর চলচ্চিত্রে।
চ্যাপলিনের উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে- মেকিং অব লিভিং (১৯১৪), দ্য ট্রাম্প (১৯১৪), কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস (১৯১৫), এ ডগস লাইফ (১৯১৭), শোল্ডার আর্মস (১৯১৮), দ্য কিড (১৯২১), দ্য সার্কাস (১৯২৬), সিটি লাইটস (১৯৩১), মডার্ন টাইমস (১৯৩৬), দ্য গ্রেট ডিক্টেটর (১৯৪০), দ্য গোল্ড রাশ (১৯৪২), লাইম লাইট (১৯৫২), এ কিং অব নিউইয়র্ক (১৯৫৭) ইত্যাদি।
সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত চার্লি চ্যাপলিনের সমাধি
১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর সুইজারল্যান্ডে চার্লি চ্যাপলিন প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান। ১৯৭৮ সালের ৩ মার্চ সুইজারল্যান্ডের করসিয়ার-সার- ভেভে গোরস্তান থেকে চুরি হয়ে যায় চার্লি চ্যাপলিনের মৃতদেহ। অবশেষে ১৮ মার্চ পুলিশ মৃতদেহটি উদ্ধার করে এবং পুনরায় সমাহিত করা হয় চার্লি চ্যাপলিনকে।