নিজস্ব প্রতিবেদক :
বাংলা ভাওয়াইয়া গানের সম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদের জন্মদিন আজ। ১৯০১ সালের এই দিনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর গাওয়া বিখ্যাত গান ওকি গাড়িয়াল ভাই, নদী না যাইও রে, বাউকুমটা বাতাসে, ধিক ধিক মইষালরেসহ অসংখ্য জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া গান যুগ যুগ ধরে আবহমান বাংলাকে তুলে ধরছে মানুষের কাছে। শুধু ভাওয়াইয়া গানই নয়, আব্বাসউদ্দীনের অসংখ্য ভাটিয়ালি, মারফতি, পল্লীগীতি, জারি, সারি, মুর্শিদি, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালা গানও রয়েছে। তিনি একাধারে একজন প্রখ্যাত বাংলা লোকসঙ্গীত সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার ও গায়ক। জন্মদিনে আব্বাস উদ্দিনের প্রতি কালচারাল ইয়ার্ড পরিবারের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা।
আব্বাসউদ্দীন আহমদের পিতা জাফর আলী আহমদ ছিলেন কলকাতার তুফানগঞ্জ মহকুমা আদালতের উকিল। বলরামপুর স্কুলে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ১৯১৯ সালে তুফানগঞ্জ স্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা এবং ১৯২১ সালে কুচবিহার কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। এখান থেকে বিএ পরীক্ষায় অণুত্তীর্ণ হয়ে তিনি সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন। আব্বাস উদ্দিন আধুনিক গান, স্বদেশী গান, ইসলামী গান, পল্লীগীতি, উর্দু গান সবই গেয়েছেন। তবে তিনি সফলতার শীর্ষে এসেছেন পল্লীগীতিতে।
ছোটবেলা থেকে থিয়েটার ও স্কুল-কলেজের সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান শুনে তিনি গানের প্রতি আকৃষ্ট হোন। গানের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর ছিলো না। তবে তিনি ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খাঁর নিকট উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিখেছিলেন। প্রথমে রংপুর ও কুচবিহার অঞ্চলের ভাওয়াইয়া, ক্ষীরোল চটকা গেয়ে আব্বাসউদ্দীন সুনাম কুড়ান। এরপর তিনি জারি, সারি, মুর্শিদি, বিচ্ছেদি, ভাটিয়ালি, মর্সিয়া, দেহতত্ত্ব, পালা গান ইত্যাদি গান গেয়ে জনপ্রিয়তা পান। তিনি যেভাবে সুরেলা কণ্ঠে পল্লীগানের সুর ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা অদ্বিতীয়।
আব্বাসউদ্দীন ছিলেন প্রথম মুসলমান গায়ক যিনি আসল নাম ব্যবহার করে এইচ এম ভি থেকে গানের রেকর্ড বের করতেন। রেকর্ডগুলো বাণিজ্যিকভাবে ভীষণ সফলতা পায়। তাঁর দেখাদেখি হিন্দু ধর্মের গায়করা মুসলমান ছদ্মনাম ধারণ করে গান শুরু করেন।
সঙ্গীত অঙ্গনের আরও খবর
⇒ ঢাকার সিনেমার জন্য প্রথমবারের মতো গান গাইবেন কবির সুমন
আব্বাসউদ্দীন কলকাতায় রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ডিপিআই অফিসে অস্থায়ী পদে এবং পরে কৃষি দপ্তরে স্থায়ী পদে কেরানির চাকরি করেন। চল্লিশের দশকে আব্বাসউদ্দীনের গান পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে মুসলিম জনতার সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশ বিভাগের পর (১৯৪৭ সালে) ঢাকায় এসে তিনি সরকারের প্রচার দপ্তরে এডিশনাল সং অর্গানাইজার হিসেবে চাকরি করেন। পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৫৫ সালে ম্যানিলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সঙ্গীত সম্মেলন, ১৯৫৬ সালে জার্মানিতে আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত সম্মেলন এবং ১৯৫৭ সালে রেঙ্গুনে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে তিনি যোগদান করেন।
বাংলা সিনেমায় অভিনয়ও করেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ। সিনেমাগুলোর মধ্যে বিষ্ণুমায়া (১৯৩২), মহানিশা (১৯৩৬), একটি কথা ও ঠিকাদার(১৯৪০)। এ সব সিনেমাতে তিনি গানও করেছিলেন। তখনকার দিনে মুসলমান ব্যক্তির সিনেমা করা ছিলো একটা ব্যতিক্রম ঘটনা। তাই হয়ত ‘বিষ্ণুমায়া’ ছবিতে অভিনয়ের পরও এর ভূমিকা লিপিতে আব্বাসউদ্দীনের নাম ছিলো না। অভিনেত্রী কানন দেবীর কাছ থেকে বিষয়টি জানা যায়।
আব্বাসউদ্দীনের রচিত একমাত্র গ্রন্থ আমার শিল্পী জীবনের কথা(১৯৬০)। সঙ্গীতে অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর প্রাইড অব পারফরমেন্স (১৯৬০), শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৯) এবং স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে (১৯৮১) ভূষিত হন। তাঁর সন্তান ফেরদৌসী রহমান এবং মুস্তাফা জামান আব্বাসী বাংলাদেশের ভাওয়াইয়া গানের অন্যতম গায়ক। ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর পল্লীগানের এই মহান সম্রাট মৃত্যুবরণ করেন।