নিজস্ব প্রতিবেদক:
আপনি কেন সিনেমা বানান? এমন উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমি একেবারেই পাগল। সিনেমা না বানিয়ে থাকতে পারি না। আমাদের তো কিছু একটা করে বাঁচতে হয়, তাই না? তাই আমাকে সিনেমা করে বাঁচতে হয়। আসলেই তিনি ছিলেন পাগল। সিনেমার পাগল। শুধু বিনোদন না, তিনি সিনেমা বানাতেন মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য যে, তাদের অধিকার কি? গণমানুষের অধিকার আদায়ে, শোষণের বিরুদ্ধে শোষকের যন্ত্রণা ও তাদের ফুঁসে ওঠার চিত্র ফুটে উঠত তার সিনেমায়। তিনি বলতেন, সিনেমা আমার কাছে শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার হাতিয়ার। সারাজীবন বাউন্ডুলে জীবন পরিচালনা করা সেই পাগলাটে সিনেমা নির্মাতা ঋত্বিক কুমার ঘটক।
ভারতীয় উপমহাদেশের তিনজন পরিচালকের একজন। সত্যজিতের সঙ্গে যার নামটি বরাবর উচ্চারণ হয়। আজ তাঁর জন্মদিন। কালচারাল ইয়ার্ড পরিবারের পক্ষ থেকে এই পাগলাটে সিনেমা করিয়েকে শ্রদ্ধা।
ভারতের প্রখ্যাত এই সিনেমা পরিচালকের জন্ম পূর্ববাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশে। ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার ঋষিকেশ দাস লেনের ঝুলন বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে তার জমজ বোন ‘প্রতীতি দেবী’। বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক ও মা ইন্দুবালা দেবীর আদরের ‘ভবা’ ও ‘ভবি’ ছিলেন তারা। ঋত্বিক ঘটকের মূল বাড়ি পাবনায়। ৯ ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট ঋত্বিক ও প্রতীতি। সরকারি আইনজীবি বাবার চাকরির সুবাদে তাদের থাকতে হয়েছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। তাঁর স্কুল জীবন শুরু হয় ময়মনসিংহে। রাজশাহীতে তাঁর স্কুল জীবনের বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত হয়। রাজশাহীর পদ্মা পাড়ে কাটে তাঁর শৈশব।
ঋত্বিক কুমার ঘটকের আরও খবর
⇒ ঋত্বিক ঘটক: সিনেমা যার কাছে ভাঙা বুদ্ধিজীবীর প্রতিবাদের ভাষা
⇒ সিনেমার ক্ষ্যপাটে ঋত্বিক ঘটকের প্রয়ান দিবস
মাত্র একুশ বছর বয়সে দেশ ভাগের কারণে পরিবারের সঙ্গে পাড়ি জমান ওপারে। দাঙ্গা, মন্বন্তর, দেশভাগ ও সঙ্গে স্বজন হারানোর বেদনা তাকে পীড়া দেয়। সংস্কৃতিমনা পরিবারের ছেলে ঋত্বিক নাটক ও সিনেমাকে উপজীব্য করে ফুঁসে উঠেন শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। করেন গণনাট্য আন্দোলন।
তিনি নাটক লিখেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন, অভিনয় করেছেন শ্রমজীবী ও প্রান্তিক মানুষের জন্য। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বলে গেছেন দুঃখী মানুষের গল্প। দেশভাগের যন্ত্রণা থেকে করেন নাটক ‘দলিল’। করেন চলচ্চিত্র। দেশভাগ নিয়ে তার ট্রিলজি মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১) এবং সুবর্ণরেখা (১৯৬২)। এই ছবিগুলো তাকে এনে দেয় খ্যাতি। তাঁর চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে দেশত্যাগী, বাস্তুচ্যুত, ছিন্নমূল, দলছুট, নির্বাসিত মানুষের কথা।
ঋত্বিক ঘটকের প্রথম ছবি ‘নাগরিক’। তবে এটি মুক্তি পায় তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৭৭ সালে। তিনি একে একে নির্মাণ করেন অযান্ত্রিক (১৯৫৮), বাড়ী থেকে পালিয়ে (১৯৫৮), মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৭), মুসাফির (১৯৫৭), মধুমতী (১৯৫৮), স্বরলিপি (১৯৬০), কুমারী মন (১৯৬২), দ্বীপের নাম টিয়া রং (১৯৬৩), রাজকন্যা (১৯৬৫), হীরের প্রজাপতি (১৯৬৮)। এছাড়া বেশকিছু তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন তিনি।
১৯৬৫ সালে স্বল্প সময়ের জন্য পুনের চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন ও পরবর্তীতে ভাইস-প্রিন্সিপাল হন।
আরও পড়ুন : প্রয়ানের ৪২ বছর পরও অমলিন ঋত্বিক ঘটক
১৯৭৩ সালে তিনি অদ্বৈত মল্লবর্মন এর উপন্যাস অবলম্বনে বাংলাদেশী প্রযোজিত সিনেমা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নির্মাণ করেন। তিনি নির্মাণ করেন তাঁর জীবনের শেষ চলচ্চিত্র যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪)। এটি বলা হয় তার আত্মজীবনীমূলক সিনেমা। এ ছবি করার পরপরই ঋত্বিক ঘটক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তিন বছর হাসপাতালে থাকার পর ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৫০ বছর বয়সে হাসপাতালে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে মারা যান সিনেমার পাগল ঋত্বিক ঘটক।