
রোমান কবির:
চলচ্চিত্রকে একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম বলা হয়। শিল্পের মাধ্যম হিসেবেও চলচ্চিত্র শক্তিশালী। আমরা চলচ্চিত্র বলতে শুধু কাহিনীচিত্র বুঝি। তবে উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে যখন চলচ্চিত্র যাত্রা করে তখন প্রামাণ্যচিত্রই প্রথম প্রদর্শন করেন ফ্রান্সের লুমিয়ের ব্রাদার্স। এরপর রবার্ট ফ্লাহার্টি থেকে শুরু করে বিশ্বের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতারা নির্মাণ করেছেন প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। সেগুলো শুধু কোন বাস্তব কাহিনীর প্রামাণ্যকরণ ছিলো না। সেগুলো ছিলো বাস্তব কাহিনীর শিল্পসম্মত উপস্থাপন। অর্থাৎ কোন প্রামাণ্যচিত্রকে শিল্পের বিচারে উতরে গেলেই তাকে চলচ্চিত্রের সংজ্ঞায় ফেলা যায়। এ সব প্রামাণ্য চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে বিশ্বের বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনের গল্প রয়েছে। যেগুলো দেখতে মানুষকে আকৃষ্ট করেছে।
সম্প্রতি আমাদের বাংলাদেশে নির্মাণ হয়েছে একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র, যা স্টার সিনেপ্লেক্স ও ব্লকবাস্টারসহ এই প্রথম দেশের প্রেক্ষাগৃহতে মুক্তি পেয়েছে। ছবিটি দেখতে ভিড় জমিয়েছে অনেক দর্শক। যা নির্মাতাসহ সবার কাছে এক বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। দর্শক চাহিদার বিপুলতার কারণে নির্মাতা ও প্রযোজক সিদ্ধান্ত নিয়েছে ছবিটি সারাদেশে আরও বেশি হলে মুক্তি দেওয়ার। ছবিটি নিয়ে সব জায়গায় সাড়া পড়ে গেছে। নির্মাতা পিপলু খান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনের কিছু গল্প তুলে এনেছেন এই চলচ্চিত্রে। ছবিটির নাম ‘হাসিনা: আ ডটার’স টেল’। কোন রাজনৈতিক ও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়, স্রেফ তাঁর জানা জীবনের অজানা অধ্যায় তুলে এনেছেন নির্মাতা।
গত শুক্রবার মুক্তি পাওয়া ছবিটি দেখে রাজনৈতিক, শিল্পী, পরিচালক থেকে সাধারণ মানুষ প্রত্যেকে আবেগ আপ্লুত। কেউ কেউ অনলাইনে তাদের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেছেন, কেউ কেউ পত্রিকায় ও ব্লগে লিখে জানিয়েছেন অনুভূতি। জাতির জনক ও তাঁর কন্যাদ্বয়ের গল্প চলচ্চিত্রের পর্দায় দেখে এর শিল্পীত উপস্থাপন স্পর্শ করেছে দর্শক হৃদয়।
হাসিনা: এ ডটার’স টেল’র আরও খবর :
⇒ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘হাসিনা: এ ডটারস টেল’
⇒ বঙ্গবন্ধু কন্যার অদেখা জীবনের গল্প
এই ছবিটি দেখলাম একজন চলচ্চিত্রের শিক্ষার্থী ও চলচ্চিত্রকর্মী হিসেবে। দেখলাম একজন বাঙালি নির্মাতা হিসেবে।
এই গল্পটি আমাদের জাতির জনকের, তাঁর কন্যার, তাঁর কন্যাদ্বয়ের, তাঁর বাংলাদেশের। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে। ওইদিন ভাগ্যক্রমে বিদেশে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। পরবর্তীতে শেখ হাসিনা দেশে এসে ধরেছেন দলের হাল। হয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। ছিলেন দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামের অগ্রসেনা। একজন জননেত্রী, একজন প্রধানমন্ত্রীর এই গল্প কমবেশি আমাদের সবার জানা। তবে এর বাইরে একজন স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া এক মেয়ের গল্প, একজন সফল মায়ের গল্প, একজন মমতাময়ী বোনের গল্প, একজন অসাধারণ দাদী, নানীর গল্প ‘হাসিনা: আ ডটার’স টেল’।
নির্মাতা পিপলু খান সিনেমার পর্দায় তুলে এনেছেন একজন শেখ হাসিনার জীবনের অজানা গল্প। নির্মাণ করেছেন একটি আখ্যান। ছবির শুরুতে দেখা যায়, শেখ হাসিনা রান্না করছেন, সঙ্গে আছে তাঁর নাতি নাতনিরা। এর ফাঁকে বলেছেন নিজের অজানা গল্প। সেই ছোটবেলায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় গাছপালা ঘেরা ছবির মতো সুন্দর একটি গ্রামে বড় হওয়ার গল্প। বলেছেন বাড়ির পাশে থাকা নদীর গল্প। নিজের আলসে খানার গল্প। সেই আলসে খানার হাসিনা আজ দেশের ব্যাস্ত প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর জবানিতে উঠে এসেছে রাজনীতির সময়কালের অধিকাংশ সময় জেলে থাকা পিতা শেখ মুজিবের কথা। জেলে থাকা বাবাকে শৈশবে খুবই কম সময়ই কাছে পেয়েছেন। তাঁর জবানীতে আমরা জানতে পারি, আমাদের জাতির পিতার প্রিয় গানের কথা। ‘আমার সাধ না মিটিলো, আশা না পুরিলো সবই ফুরায়ে যায় মা।’ ফুটে উঠে জাতির পিতার আশা আকাঙ্খার কথা। সেগুলো দুই মেয়ের জবানীতে ধারণ করে ক্যামেরায় এর সফল চিত্রায়ণ করেছেন নির্মাতা।
গণভবনের লনে বসে নিজেদের গল্প বলেছেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। যে গল্প আমাদের অনেকের অজানা। বেলজিয়ামে থাকা শেখ হাসিনা ও তার পরিবার সেখানের রাষ্ট্রদূত সানাউল্লাহ মিয়ার বাড়িতে রাতে ছিলো ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের পার্টিতে। সকালে দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সপরিবারে হত্যার ঘটনা শুনে সেদিন সানাউল্লাহ মিয়া তার মেয়েদের নিজের বাড়িতে রাখতে অস্বীকার করেন। রাতে করান ক্যান্ডেল লাইট ডিনার আর সকালে বলেন বাসা থেকে চলে যেতে। এমনকি তাদের যাওয়ার জন্য নিজের গাড়ি দিতেও অস্বীকার করেন সেই রাষ্ট্রদূত। শেখ হাসিনার কথায় ফুটে উঠে সেদিনের সেই বেদনার কথা। আর সেই বেদনাকে শিল্পের ছোঁয়ায় পর্দায় মুর্ত করে তোলেন নির্মাতা।
বঙ্গবন্ধু যাকে রাষ্ট্রদূত করে পাঠালেন সেই-ই বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের বের করে দিলেন। শেখ হাসিনা জানালেন, সেদিন সকালে সানাউল্লাহ মিয়ার বাড়িতে যে, টেলিফোন বেজে উঠে তা এত কর্কশ ছিলো, যা তিনি কখনো শুনেন নি। এরপর সেখান থেকে জার্মানিতে থাকা রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশিদ তাদের আশ্রয় দেন। তিনি নিজে গাড়ি করে তাদের নিয়ে আসেন। বেলজিয়াম থেকে জার্মানি। সেখান থেকে ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর আশ্রয়ে ছিলেন দুই বোন তাদের পরিবার নিয়ে। এ সময়গুলোর কথা হাসিনা ও রেহানার মুখে তুলে আনেন নির্মাতা। ক্যামেরায় তুলে ধরেন সেই স্থানগুলোর চিত্র। একটি আবহ তৈরি করতে এই চিত্রগুলো ক্লোজ শটে ও মিড শটে ধারন করেন নির্মাতা। তবে ভারতে থাকা ইন্দিরা গান্ধীর বাড়িটির একটি ইস্টাবিলিশিং শটের অভাব বোধ করছিলাম। নির্মাতা বোধহয় তাঁর পয়েন্ট ভিউ থেকেই এরকম কোন শট নেননি। আর নিলেও বাদ দিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে নির্মাতাই ভালো বলতে পারবেন।
ভারতে থাকতে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিচয়ও গোপন রাখতে হয়েছিলো। নাম বদলেও ফেলতে হয়েছে। সেই কষ্টের স্মৃতি তুলে ধরেন শেখ রেহানা। যে আমরা পরিবার ছাড়া, দেশ ছাড়া হয়ে ঘুরছি এদিক-ওদিক। সেখানে আমাদেরকে নিজেদের পরিচয় মুছে ফেলতে হয়েছে। এই কষ্ট বুঝানোর মতো না।
উঠে আসে আজমীর শরিফে যাওয়ার গল্প। সেখানে একই দিনে বঙ্গবন্ধুও গেছেন। তারিখটা একই থাকলেও সালটা ছিলো ভিন্ন। ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু সেখানে যান। আর ১৯৮১ সালের ৯ এপ্রিল যান শেখ হাসিনা। মাজারের সাক্ষর বইয়ে এটি দেখে তখন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা আরও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। সেই আবেগের গল্প ছুঁয়ে গেছে সব দর্শক হৃদয়।
একজন শেখ হাসিনার মতে টুঙ্গিপাড়া গ্রাম পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। শেষ বয়সে টুঙ্গিপাড়ায় এসে থাকার ইচ্ছা ব্যাস্ত এই প্রধানমন্ত্রীর। একটি মেয়ে পরিবারের সবাইকে হারিয়ে হারোনোর আর কিছুই নেই তার। একটাই চাওয়া তার দেশের মানুষকে ভালোবেসে তাদের জন্য কাজ করে যাওয়া। দেশকে বাবার স্বপ্নের সোনার বাংলা করে গড়ে তোলা।
বেদনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া দুই বোন এখন দাদী ও নানী। ব্যাস্ততার মধ্যে থাকা বাকি সময়টুকু নাতি-নাতনীদের নিয়ে কাটায়। তাদের আনন্দে রাখার চেষ্টা করে। শেখ হাসিনা বলছেন, আমরা দু:খের মধ্যে থাকলেও আমাদের সন্তান ও তাদের সন্তানরা যেন দু:খের মধ্যে না থাকে, তাই আমাদের এই কষ্টের কথা তাদের আমরা বলি না।
হাসিনা-একটি মেয়ের গল্প দর্শককে অশ্রুসিক্ত করেছে। এর গল্প বলার ধরণ, সঙ্গীত ও সাউন্ড ইফেক্টের ব্যাবহার এই স্টোরিটেলিং প্রসেসকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বেদনাসিক্ত বাঙালি দর্শক নিজেদের শোককে শক্তিতে পরিণত করে প্রেক্ষাগৃহ ছেড়েছে বলে আমার পর্যবেক্ষণ। দর্শকের অভিব্যাক্তি সেই কথাই বলেছে।
শেখ হাসিনার গল্পের এই প্লট অবশ্যই শিল্পের বিচারে উত্তীর্ণ। শিল্প নির্মাণের গাঁথুনিতে গেঁথে শেখ হাসিনার গল্পকে নির্মাতা পিপলু খান পৌঁছে দিয়েছেন মানুষের হৃদয়ে। ৩২ নং এর বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি জড়িত সেই বাড়িটির ক্লোজ শটে ধরা সেই জানালা, এর ফাঁক দিয়ে আসা এক চিলতে আলো, সিড়ির গোড়ায় পড়ে থাকা টেলিফোন, বই, ছবি, প্রয়োজনীয় জিনিষপাতি বঙ্গবন্ধুর ছোঁয়া অনেকদিন না পেয়ে নির্জীব হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু এখানেও ৩২ নম্বরের কিছু ইস্টাবিলিশিং শটের অভাব বোধ করছিলাম। কোন ইস্টাবিলিশিং শট থাকলে আমার কাছে মনে হয় ভাল লাগতো।
টুঙ্গিপাড়ার সেই নৈসর্গিক প্রকৃতি ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিময় সেই গান অনন্য ছিলো। দর্শক হৃদয়ে তৈরি হয়েছে পিতা হারানোর বেদনা। ট্রলি শটে নেওয়া টুঙ্গিপাড়ার সেই দৃশ্যগুলো আর ব্যাকগ্রাউন্ডে সঙ্গীতের ব্যবহার এক অনন্য শিল্পমাত্রা দিয়েছে ছবিটিকে।
শেখ হাসিনার গল্প যেই মেজাজে, যেই ফর্মে করা উচিত, যে শিল্পমান বজায় রাখা উচিত এর সঠিক ব্যবহার করে নির্মাতা পিপলু খান ও তার কলাকুশলীরা। সাদিক আহমেদের সিনেমাটোগ্রাফির মুন্সিয়ানা ও নবনিতা সেনের সম্পাদনা কৌশল ছবির গাঁথুনিকে অনন্য করে তুলেছে মনে হয়েছে। দেবজ্যোতি মিশ্রের সঙ্গীতের ব্যবহার এক কথায় অসাধারণ।
সবশেষে বলতে হচ্ছে, সেন্টার ফর রিচার্স এন্ড ইনফরমেশন (সিআরই)’র এই নিবেদন ইতিহাসের এক প্রামাণ্য দলিল হয়ে থাকবে। শুধু তা-ই নয় একটি শিল্প হিসেবেও এটি টিকে থাকবে যতদিন বাংলাদেশ থাকবে।