শাহেদ নুর :
দেশীয় চলচ্চিত্র অঙ্গনে ২০১৮ সালটি ছিলো কিছুটা আশা আর কিছুটা নিরাশার। নকল ও মানহীন কিছু ছবি হতাশ করলেও কিছু বাণিজ্যিক ছবির সফলতা এবং মৌলিক গল্পের কিছু ছবি ও বিকল্প চলচ্চিত্রের সম্ভাবনাময় ব্যাপ্তি আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছে এ বছরের চলচ্চিত্র অঙ্গনকে। এদিকে প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় ফেসবুক, ইউটিউবসহ অনলাইন মাধ্যমগুলোতে ছোট চলচ্চিত্রের প্রসার বেড়েছে এ বছর। এ বছরে ঢালিউডে মুক্তি পেয়েছে ৫৬টি কাহিনী চলচ্চিত্র। যা সারাদেশের হলগুলোতে মুক্তি পায়। আর এবারই প্রথম ২টি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে মুক্তি পেয়েছে। এবারের আলোচিত চলচ্চিত্রগুলো নিয়ে কালচারাল ইয়ার্ড-এর বছর শেষের পর্যবেক্ষণ।
প্রদর্শক সমিতির সূত্র ও অন্যান্য সমীক্ষার সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ৫৬ চলচ্চিত্রের মধ্যে ১১টি চলচ্চিত্র আমদানি করা কলকাতার বাংলা ছবি ও ৪টি যৌথ প্রযোজনার ছবি। আর এ সব ছবির মধ্যে হিট হওয়া ছবির তালিকায় রয়েছে মাত্র ৪টি সিনেমা।
ঢালিউডের আলোচিত সিনেমা
মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢালিউডের কিং খান খ্যাত শাকিব খান অভিনীত সিনেমাগুলো। এগুলোর মধ্যে আছে আশিকুর রহমানের ‘সুপার হিরো’, উত্তম আকাশের ‘আমি নেতা হবো’ ও ‘চিটাগাইঙ্গা পোয়া নোয়াখাইল্যা মাইয়্যা’, ওয়াজেদ আলী সুমনের ‘ক্যাপ্টেন খান’, জয়দেব মুখার্জীর ‘চালবাজ’ ও ‘ভাইজান এলো রে’, রাজিব বিশ্বাসের ‘নাকাব’ ও আবদুল মান্নানের ‘পাংকু জামাই’। ছবিগুলোর মধ্যে কলকাতার পরিচালকদের দ্বারা নির্মিত চালবাজ ও ভাইজান এলো রে ব্যবসায়িকভাবে সফল। বাংলাদেশের সিনেমা হিসেবে আশিকুর রহমানের ‘সুপার হিরো’ ও ওয়াজেদ আলী সুমনের ‘ক্যাপ্টেন খান’ আলোচনায় ছিলো। আর ছবিগুলো তেমন হিট করেনি। শাকিব খানের মতো হিট নায়কের হিটের মাত্রা এ বছর কমই বলা যায়।
এ বছরে ঢালিউড একটি নতুন জুটি পেয়েছেন বলে মত বিশ্লেষকদের। সেই জুটি সিয়াম-পূজা অভিনীত ‘পোড়ামন-২’ ও ‘দহন’ সিনেমাগুলো ছিলো আলোচনার শীর্ষে। জাজ মাল্টিমিডিয়া প্রযোজিত দুটি ছবিই পরিচালনা করেছেন রায়হান রাফি। মৌলিক ও বাস্তববাদী চলচ্চিত্র হিসেবে নাম করে নেয় ছবি দুটো।
যৌথ প্রযোজনা ও সাফটা চুক্তির আওতায় টলিউডের বেশ ক’টি ছবি মুক্তি পেয়েছে এবার। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ইন্সপেক্টর নটি কে’, ‘নূর জাহান’, ‘মনে রেখো’, ‘সুলতান : দ্য সেভিয়ার’, ‘তুই শুধু আমার’, ‘ফিদা’, ‘পিয়া রে’, ‘জিও পাগলা’, ‘আমি শুধু তোর হলাম’ ‘গার্লফ্রেন্ড’, ‘চালবাজ’ ও ‘ভাইজান এলো রে’। এর মধ্যে শুধু ভাইজান এলো রে ছবিটিই সাড়া ফেলে কিছুটা।
আরেফিন শুভ অভিনীত, জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত ‘ভালো থেকো’ ও নায়ক আলমগীর পরিচালিত ‘একটি সিনেমার গল্প’ মুক্তির আগে আলোচনার জন্ম দিলেও ব্যবসায়িকভাবে সফলতার মুখ দেখতে পারেনি ছবি দু’টি। ববি অভিনীত ও প্রযোজিত ‘বিজলী’-কে বলা হয়েছে দেশের প্রথম সুপারহিরোইন ছবি। তবে সুপারহিরোইন বলা হলেও ব্যবসায়িক সফলতার মুখ দেখেনি ছবিটি। দর্শককেও সেভাবে আকৃষ্ট করতে পারেনি ছবিটি।
মাহিয়া মাহি ও সাইমন অভিনীত ‘জান্নাত’ আলোচনা সৃষ্টি করেছিল ঢালিউডের বাতাসে। তবে মুক্তির পর ব্যবসায়িক সফলতা পায়নি তেমনভাবে।
নকল ও মানহীন সিনেমা
এ বছরের সবচেয়ে বাজে, নকল ও মানহীন সিনেমার তালিকায় যুক্ত হয়েছে অনেক। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: প্রেমের কেনো ফাঁসি, ধূসর কুয়াশা, রাঙা মন, পাগল মানুষ, ফিফটি ফিফটি লাভ, লিডারসহ আরও কিছু সিনেমা।
ভিন্ন ধারার মৌলিক গল্পের সিনেমা
ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র হিসেবে দারুণ এক ব্যবসাসফল ছবি ছিলো জয়া আহসান প্রযোজিত ও অভিনীত ‘দেবী’। জাজ মাল্টিমিডিয়া এ ছবির প্রদর্শক। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘দেবী’র রানু চরিত্রে জয়া আহসান ও মিসির আলী চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী ছিলো অপ্রতিদ্বন্ধী। এ ছাড়াও জয়ার প্রযোজনা ও অভিনব প্রচারণা কৌশল নজর কেড়েছে সবার। জয়া অভিনীত ‘পুত্র’ ব্যবসাসফল না হলেও জয়ার অভিনয় ছিলো প্রশংসনীয়।
এছাড়া ভিন্নধারা ও মৌলিক গল্পের আশা জাগানিয়া ছবির মধ্যে আরও রয়েছে ইমতিয়াজ আহমেদ বিজন পরিচালিত পারিবারিক ছবি ‘মাটির প্রজার দেশে’, আকা রেজা গালিবের ‘কালের পুতুল’, অন্তু আজাদের ‘আহত ফুলের গল্প’, গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘স্বপ্নজাল’, আসিফ ইসলাম ও ফয়সাল রদ্দি নির্মিত শিক্ষাবিষয়ক ও শিশুতোষ সিনেমা ‘পাঠশালা’ ইত্যাদি। ছবিগুলো দেশে ও বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কারও জেতে ছবিগুলো। এছাড়াও ‘পোস্ট মাস্টার ৭১’ নামের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি সিনেমা এ বছর মুক্তি পায়। বছর শেষে মুক্তি পায় ‘স্বপ্নের ঘর’ ও ‘অর্পিতা’। এ ছবিগুলো নতুন বছরে সারাদেশে ব্যাপকভাবে মুক্তি দেওয়ার কথা জানা যায়।
বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র
খুব স্বল্পসংখ্যক সিনেমা বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রে সংযুক্ত হয় বরাবরই। তবে এবার বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র মূলধারার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনেকদুর এগিয়ে গেছে এ বছর। সারাদেশে শিল্পকলা একাডেুমসহ বিকল্প পদ্ধতিতে মুক্তি পেয়েছে তরুণ প্রজন্মের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রগুলো। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে ৬৪টি জেলায় একযোগে মুক্তি পেয়েছে স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র উৎসব। এখানে মোট ৭০টি কাহিনীচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। উৎসবে সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় স্বজন মাঝি ও অসীম সরকার নির্মিত ‘গল্প সংক্ষেপ’ও সেরা প্রামাণ্য চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় ব্রাত্য আমীন নির্মিত ‘অপারেশন জ্যাকপট’। শ্রেষ্ঠ নির্মাতা পুরস্কার পান ‘ঘ্রাণ’ চলচ্চিত্রের জন্য এস এম কামরুল আহসান ও ‘কবি স্বামীর মৃত্যুর পর আমার জবানবন্দি’ চলচ্চিত্রের জন্য তাসমিয়াহ আফরিন মৌ। প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘পুতুল পুরান’ এর জন্য শ্রেষ্ঠ নির্মাতা পুরস্কার পান ঝুমুর আসমা জুঁই। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের দ্বারা নির্মিত হয় অনেক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র।
প্রামাণ্য চলচ্চিত্র
এ বছরের আলোচিত দু’টি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘হাসিনা: এ ডটার’স টেল ও রাজাধিরাজ রাজ্জাক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনীভিত্তিক সিনেমা হাসিনা: এ ডটার’স টেল। স্টার সিনেপ্লেক্স ও ব্লকবাস্টারসহ প্রেক্ষাগৃহেও সিনেমাটি মুক্তি পায়। টেলিভিশনেও এ ছবিটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়। আরেকটি আলোচিত প্রামাণ্যচিত্র অভিনেতা রাজ্জাকের জীবনীভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র রাজাধিরাজ রাজ্জাক। চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনায় শাইখ সিরাজ এটি নির্মাণ করেন। প্রামাণ্যচিত্রটি স্টার সিনেপ্লেক্স ও ব্লববাস্টারে মুক্তি পায়। প্রামাণ্য চলচ্চিত্র দু’টি আলোচনার জন্ম দেয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রামাণ্যচিত্র সিনেমা হলে প্রদর্শন একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে এ বছর।