নিজস্ব প্রতিবেদক :
বাংলাদেশের প্রথম সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ও ভিন্ন ধারার যুগান্তকারী চলচ্চিত্র ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’র চিত্রনাট্যকার ও নির্মাতা মসিহউদ্দিন শাকের। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সহযোদ্ধা বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা শেখ নেয়ামত আলীর সঙ্গে মিলে ১৯৭৯ সালে আবু ইসহাকের বিখ্যাত উপন্যাস ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ থেকে নির্মাণ করেন ছবিটি। এরপর আর কোন চলচ্চিত্র নির্মাণ না করলেও চলচ্চিত্রের সঙ্গে তাঁর সারাজীবনের বন্ধন। তিনি চলচ্চিত্র শিক্ষকতার সাথে জড়িয়ে আছেন।
বরেণ্য এই চলচ্চিত্রকার, নির্মাতা ও চলচ্চিত্র সংসদকর্মীর আজ জন্মদিন। তাঁর জন্মদিনে কালচারাল ইয়ার্ড পরিবারের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
১৯৪৮ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন মসিহউদ্দিন শাকের। বুয়েট থেকে আর্কিটেকচারে পাশ করে সরকারী চাকরিতে ঢুকলেও অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করতে চাননি বলে সেটা ছেড়ে দেন। এরপর বেসরকারি ফার্মে চাকরি করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন করতেন। ছোটবেলা থেকেই প্রচুর বই পড়তেন। এর মধ্যে চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশুনা করেছেন অনেক।
২০১৮ সালে শর্ট ফিল্ম ফোরামের অফিসে বসে আলাপ করছিলেন কালচারাল ইয়ার্ডের সঙ্গে। আলাপ করার সময় বললেন তাঁর চলচ্চিত্র ভাবনার কথা। তুলে ধরলেন ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ নির্মাণের নানা স্মৃতি। তিনি জানান, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তিনি বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস পড়ার সময় এটি নিয়ে ছবি বানানোর কথা ভাবেন। তখনও তিনি জানতেন না এটি দিয়ে বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিত রায় ছবি বানিয়ে ফেলেছেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি আবু ইসহাকের ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ পড়ে ভাবেন এটি নিয়েও ছবি হতে পারে। তখন থেকেই মনের মধ্যে লালন করতে থাকেন বিখ্যাত উপন্যাস দিয়ে ছবি বানানোর স্বপ্ন।
পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটির সদস্য ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটি করতেন। সংসদ আন্দোলনের আরেক সহযোদ্ধা মেধাবী চলচ্চিত্র নির্মাতা শেখ নেয়ামত আলীর সাথে মিলে সিদ্ধান্ত নেন ছবি করার। পরে ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ উপন্যাস থেকে চিত্রনাট্য তৈরি করেন তাঁরা। চিত্রনাট্যে কাঁটাছেড়া করে সংলাপ সংযোজন করে চূড়ান্ত চিত্রনাট্য তৈরি করেন মসিহউদ্দিন শাকের।
ছবিটি তৈরি করতে যেয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছিলো বলে জানান মসিহউদ্দিন শাকের। তিনি বলেন, কোন গল্প দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হলে প্রথমে লেখকের অনুমতি নিতে হয়৷ কিন্তু আমরা লেখকের অনুমতি না নিয়েই ছবিটির চিত্রনাট্য তৈরি করে ফেলেছিলাম৷ ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ বইটির লেখক কাজী ইসহাক তখন ঢাকায় ছিলেন না৷ আমরা তাঁর কাছে অনুমতি চেয়ে চিঠি পাঠালাম। কিন্তু তিনি আমাদেরকে অনুমতি দিলেন না। তিনি বলেন আমরা কখনও ছবি বানাইনি। আমরা কি পারব? এছাড়া তিনি বললেন যে, আমাদের আগেই পরিচালক বাদল রহমান এ ছবি করার অনুমতি নিয়ে গেছেন। সেই সময়ে আমরা খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। আমরা খুব কষ্ট করে এর চিত্রনাট্যটা তৈরী করেছিলাম। ওই সময় পত্রিকায় আমরা একটি বিজ্ঞাপন দেখলাম। বিজ্ঞাপনটি ছিলো ভালো ছবি তৈরির জন্য সরকারিভাবে অনুদান দেয়া হবে৷ এর জন্য চিত্রনাট্য জমা দিতে বলা হয়েছে৷ আমরা সেই সময় বাদল রহমানের কাছে জানতে চাইলাম তিনি অনুদানের ছবির কথা ভাবছেন কিনা৷ বাদল রহমান আমাদের জানালেন তিনি এমিলেন গোয়েন্দা বাহিনীর চিত্রনাট্য জমা দিবেন৷ আমি শেখ নেয়ামত আলী ভাইকে বললাম আমরা সূর্য দীঘল বাড়ীর চিত্রনাট্য জমা দিয়ে ফেলি। যদি ছবিটি অনুদানের জন্য নির্ধারণ করা হয় তখন আমরা আবার ছবিটি করার জন্য অনুমতি চাইবো৷ এই সিদ্ধান্তে আসার পর আমরা আমাদের চিত্রনাট্যটি জমা দিয়েছিলাম৷ সৌভাগ্যবশত আমারা অনুদান পাই।
আরও পড়ুন : সূর্য দীঘল বাড়ি: পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী সংগ্রামের চিত্র
এরপর আমি আবার সূর্য দীঘল বাড়ীর লেখকের কাছে ছবিটি করার অনুমতি চেয়ে চিঠি পাঠাই। এবার তিনি আমাদের আর ফিরিয়ে দেন নি। তিনি অনুমতি দিয়ে দিলেন। কিন্তু তিনি ঢাকায় আসার পর তাঁর সঙ্গে একটি চুক্তি হলো। চুক্তিটি হলো আমরা ছবিটি তৈরি করে প্রথমেই যে টাকা পাব সেটা তাকে দিয়ে দিব৷ কিন্তু পরিতাপের বিষয় আমরা তাঁকে সব টাকা দিতে পারিনি। এতকিছুর পরেও সিনেমার শুটিংয়ে গিয়েও বেশ প্রতিকুলতার মধ্যে পড়তে হয়েছে আমাদের। শুটিংয়ের একটা সময় টাকা শেষ হয়ে গিয়েছিলো। এরপর অনেক ঋণ করতে হয়েছিলো আমাকে।-বলেন মসিহউদ্দিন শাকের।
ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে সফল না হলেও আটটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। এছাড়া দেশে বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার ও প্রশংসা অর্জন করে সিনেমাটি। গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত সামাজিক শ্রেণি বৈষম্যের এক সুন্দর উপস্থাপন ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ ছবিটি।
তিনি পেশায় একজন স্থপতি। চলচ্চিত্র আন্দোলনের অগ্রজপ্রতিম, চলচ্চিত্রকার, লেখক, পরিচালক ও শিক্ষক মসিহউদ্দিন শাকের বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি) এর আজীবন সদস্য।