বিশেষ প্রতিবেদক :
বিপ্লবী চলচ্চিত্রকার, চলচ্চিত্র আন্দোলনের দিকপাল, চলচ্চিত্র শিক্ষক, নির্মাতা, সমালোচক ও মুক্তিযোদ্ধা আলমগীর কবিরের প্রয়াণ দিবস আজ। ১৯৮৯ সালের ২০ জানুয়ারি বগুড়া চলচ্চিত্র সংসদের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ফেরার পথে নগরবাড়ী ফেরিঘাটে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন।
বরেণ্য এই চলচ্চিত্রকারের প্রয়াণে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তাঁর মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করবে চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষ। চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষের সঙ্গে এ দিনে বিপ্লবী এ চলচ্চিত্রকারকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছে কালচারাল ইয়ার্ড।
বাংলাদেশের বিকল্প চলচ্চিত্রের পথিকৃত আলমগীর কবির সুস্থধারার সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাণ ও বিকাশের অন্যতম কারিগর। ১৯৩৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাঙামাটি জেলায় এই চলচ্চিত্রের শিক্ষকের জন্ম। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন আলমগীর কবির। শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হানের অসামান্য সৃষ্টি মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য দলিল ‘স্টপ জেনোসাইড’-এর চিত্রনাট্য করেছেন। জহির রায়হানের সঙ্গে থেকে পুরো কাজে সহায়তা করেছেন।
নিজে নির্মাণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘লিবারেশন ফাইটার্স’। আলমগীর কবির একে একে নির্মাণ করেছেন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ধীরে বহে মেঘনা, সীমানা পেরিয়ে, রূপালী সৈকতে, সূর্যকন্যা, পরিণীতা, মোহনা, মণিকাঞ্চন প্রভৃতি। নির্মাণ করেছেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র কালচার ইন বাংলাদেশ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। তাঁর তিনটি চলচ্চিত্র ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের ‘বাংলাদেশের সেরা ১০ চলচ্চিত্র’ তালিকায় স্থান পেয়েছে।
১৯৭৩ সালে আলমগীর কবির নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ধীরে বহে মেঘনা’। এই ছবি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন সংযোজন। এতে মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজ, মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণণের দৃশ্য, মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধযাত্রার দৃশ্য, ১৬ ডিসেম্বর ট্রাকভর্তি মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি এবং ঘরে ফেরার দৃশ্য তিনি সংযুক্ত করেছেন। এই চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার (বাচসাস) এবং জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এটি তাঁর পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।
১৯৭৫ সালে তিনি নির্মাণ করেন তাঁর দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘সূর্যকন্যা’। এই চলচ্চিত্রে ব্যক্তি, সমাজ ও ইতিহাসে নারীর অবস্থান এক সাহসী পদক্ষেপে বর্ণনা করেছেন তিনি। এই চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। পান জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার।
আলমগীর কবির সম্পর্কিত আরও খবর
⇒ চলচ্চিত্রের সীমানা পেরিয়ে বিপ্লবী আলমগীর কবির
১৯৭৭ সালে আলমগীর কবির নির্মাণ করেন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘সীমানা পেরিয়ে’। চলচ্চিত্রটি সত্তরের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের একটি সত্যি ঘটনাকে উপজীব্য করে। এই জলোচ্ছ্বাসের ধ্বংসলীলার প্রায় তিন মাস পর একজোড়া মানব-মানবীকে বরিশালের দক্ষিণের একটি সামুদ্রিক চরে আদিম পরিস্থিতিতে কোনো রকমে বেঁচে থাকতে দেখা গিয়েছিল। ঢাকার তৎকালীন সংবাদপত্রে ঘটনাটির বিবরণ আলমগীরের কবিরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তিনি এর বেশ কয়েক বছর পর চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। এই চলচ্চিত্র নির্মানের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ সংলাপ ও চিত্রনাট্য রচয়িতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৭৯ সালে নির্মাণ করেন ‘রূপালী সৈকতে’। চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার (বাচসাস) পায়। এছাড়া শিল্পকলায় অসাধারণ অবদানের জন্য ২০১০ সালে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ ভূষিত হন তিনি।
আলমগীর কবির একই সঙ্গে স্বল্পদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্য ও বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন সাফল্যের সঙ্গে। তিনি বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন করেছেন। ছিলেন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। তিনি একটি ইংরেজি সিনে জার্নাল প্রকাশ করতেন। দেশের প্রথম চলচ্চিত্র সংসদ ও চলচ্চিত্র সংসদ ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন তিনি।
ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৫২ সালে মেট্রিক ও ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৪ সালে হায়ার সেকেন্ডারি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগ থেকে ১৯৫৮ সালে অনার্স করেন। এরপর লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। অর্জন করেন ফলিত গণিতে বিএসসি ডিগ্রি।
লন্ডনে তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হন। লন্ডনের বামপন্থী দৈনিক ডেইলি ওয়ার্কার এ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন তিনি। পরে তিনি ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত চলচ্চিত্র ইতিহাস ও পরিচালনা বিষয়ক কয়েকটি কোর্স করেন। এরপর দেশে ফিরে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। নির্মাণ করেন একের পর এক চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র সমালোচক ও শিক্ষক হিসেবেও ছিলেন অনন্য।
আলমগীর কবির ১৯৬৫ সালে বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। লন্ডনের ইস্ট পাকিস্তান হাউজ, ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট এ সংযুক্ত হয়ে বিভিন্ন আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ফরাসি সরকার রাজনৈতিক কারণে তাঁকে গ্রেফতার করেন। সেখানে কয়েক মাস জেল খাটেন তিনি।
বিপ্লবী চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের আরও খবর
⇒ চলচ্চিত্রের বিপ্লবী আলমগীর কবির : জন্মদিনে শ্রদ্ধা হে গুণী
১৯৬৬ সালে দেশে ফিরে এসে তিনি ইংরেজি পত্রিকা দ্য অবজারভারে কাজ শুরু করেন। সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায়ও কাজ করেন তিনি। সাংবাদিকতার জন্য তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। চলচ্চিত্র সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ পুরস্কার লাভ করেন। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশ নেয়ায় আইয়ুব সরকারের অধীনে কয়েক মাস জেলও খাটেন তিনি।
তিনি পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র চলচ্চিত্র সংসদ ‘পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হন। এরপর পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি ত্যাগ করে নিজের প্রচেষ্টাতেই গড়ে তোলেন ‘ঢাকা সিনে ক্লাব’। প্রকাশ করেন চলচ্চিত্র বিষয়ক তাঁর প্রথম বই সিনেমা ইন পাকিস্তান। এই বইতে তিনি মূলত তৎকালীন পাকিস্তানি চলচ্চিত্র জগতের বাস্তব অবস্থাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেন।
দেশের তরুণ-তরুণীদের আধুনিক চলচ্চিত্রের ভাষা সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা ফিল্ম ইনস্টিটিউট। এ সময় তিনি মওলানা ভাসানীর ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্রের কাজ শুরু করেন।
স্বাধীনতার পর স্থানীয় চলচ্চিত্রে নকলের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি। গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্রকার সংসদ’। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ও ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এই সময়ে ‘ভিন্টেজ পাবলিকেশন্স’ নামক একটি প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তোলেন তিনি।
বাংলা একাডেমির উদ্যোগে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ফিল্ম ইন বাংলাদেশ ও শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম তিনটি ছবির চিত্রনাট্যের বই ‘চিত্রনাট্য’। এ দেশে চিত্রনাট্যের ওপর এটাই ছিল প্রথম বই। বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ও ইনস্টিটিউটে চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রশিক্ষণ কাজ শুরু হলে তিনি সেই কোর্সের সমন্বয়কারী নিযুক্ত হন এবং প্রশিক্ষকের দায়িত্বও পালন করেন। সেই বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’ এর স্মরণিকাও প্রকাশ করেন তিনি।
১৯৬৮ সালে মঞ্জরা বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। কিন্তু সেই বিয়ে টেকেনি। এরপর তিনি ১৯৭৫ সালে বিয়ে করেন অভিনেত্রী জয়শ্রী কবিরকে। তিনি ছিলেন ৩ কন্যার জনক। ১৯৮৯ সালের ২০ জানুয়ারি বগুড়া চলচ্চিত্র সংসদের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ঢাকায় ফেরার পথে নগরবাড়ী ফেরিঘাটে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন বরেণ্য এই চলচ্চিত্রকার।