বিশেষ প্রতিবেদক :
মুহম্মদ খসরু। জন্ম ১৯৪৬ সালে ভারতের হুগলী জেলায়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পঞ্চাশের দশকে পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসেন। ছিলেন একজন আলোকচিত্রী। ছিলেন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সারাজীবন। ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়েছেন এ দেশের নির্মাতা ও চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের। ‘ধ্রুপদী’ নামে একটি চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায় অসংখ্য চলচ্চিত্রপ্রেমী বন্ধু ও ভক্তদের কাঁদিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি।
২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপারজেয় পাদদেশে হাজারও সৃহৃদের অশ্রুসিক্ত ভালোবাসায় শেষ বিদায় নেন তিনি। তাঁকে কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরের মোহনপুরে তাঁর জন্মভিটা কবরস্থানে দাফন করা হয়। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন, চলচ্চিত্র সম্পাদক, ‘ধ্রুপদী’ চলচ্চিত্রের এই অগ্রপথিকের প্রয়াণে কালচারাল ইয়ার্ড পরিবার শোকাহত। তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।
মুহম্মদ খসরু ছিলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার (বিসিক) নকশা কেন্দ্রে আলোকচিত্রী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’ এর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সাল থেকে চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা ‘ধ্রুপদি’ সম্পাদনা করা শুরু করেন। এর সর্বশেষ সংকলন প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। এছাড়াও তিনি চলচ্চিত্র বিষয়ক আরও একটি পত্রিকা ‘চলচ্চিত্র’ সম্পাদনা করেছেন।
বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ ও জাতীয় ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইন্সটিটিউটের প্রশিক্ষক হিসাবেও কাজ করেছেন। ১৯৭৫ সালে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার পালঙ্ক ছবিটিতে খসরু ভারতীয় চলচ্চিত্রকার শ্রী রাজেন তরফদারের সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণ শুরু করার পেছনেও তার অবদান রয়েছে। সত্তরের দশকে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটকের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন তিনি। যা তাঁর ‘ধ্রুপদি’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। সেময় সাক্ষাতকারটি বেশ সাড়া ফেলেছিল। এটি পরে উপমহাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় পুনর্মুদ্রণও হয়েছিল।
মুহম্মদ খসরু চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিকাশে দীর্ঘ ৫০ বছর নিরবচ্ছিন্ন অবদানের জন্য হীরালাল সেন আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সুবর্ণ জয়ন্তী পদক পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ আজীবন সম্মাননা ২০১৭।
মুহম্মদ খসরুর প্রয়াণে শোকাহত সাংস্কৃতিক অঙ্গন। তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে আসেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, তাঁর বন্ধু সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে আসেন সুলতানা কামাল, মুফিদুল হক, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য মুহম্মদ সামাদ, নির্মাতা মসিহউদ্দিন শাকের, মোরশেদুল ইসলাম, আহমেদ মুজতবা জামাল, মানজারে হাসিন মুরাদ, অঞ্জন জাহিদুর রহিম, আকরাম খানসহ দেশের তরুণ নির্মাতা ও চলচ্চিত্রকর্মীরাভ, ফিল্ম সোসাইটি, শর্টফিল্ম ফোরাম, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ সহ দেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র সংগঠনগুলোও শেষ শ্রদ্ধায় শরিক হন।
সম্মিলিত কণ্ঠে দেশের গান গেয়ে মুহম্মদ খসরুকে বিদায় জানান দীর্ঘদিনের সুহৃদরা। এ সময় বন্ধু খসরুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে এসে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, বিশ্ব চলচ্চিত্র সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি খসরুর কাছ থেকে। তার মাধ্যমেই আমার মতো অনেকের বিশ্ব চলচ্চিত্রের সাথে খুব ভালো করে প্রথম পরিচয় ঘটে। চলচ্চিত্রের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের হাতে ধরে চিনিয়েছেন খসরু। সেই ১৯৭১-৭২ সালের দিকের কথা। সেই সময় থেকে খসরুর সাথে আমার সম্পর্ক। সে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলোতে ঘুরে ঘুরে অসাধারণ সব দেশের সিনেমা সংগ্রহ করতো। যেগুলো পরবর্তীতে আমরা দেখতাম। দেখে আলোচনা করতাম।
তিনি বলেন, ব্যক্তিগত জীবনে আমরা ঘনিষ্ঠ ছিলাম। অনেক আনন্দময় জীবন কাটিয়েছি। আমাদের সেই আনন্দের সময়ের বন্ধুদের সংখ্যা একে একে কমে যাচ্ছে। আজকে খসরু চলে গেল, কিন্তু সে আমাদের মধ্যে থাকবে। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে, আমাদের চলচ্চিত্রের জগতে, আমাদের সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র অঙ্গণে অনির্বাণ দ্বীপশিখার মতো জ্বলবে।
এ সময় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ তাঁর স্মৃতিচারণ করে বলেন, যার মধ্যে নূন্যতম সম্ভাবনা দেখতেন তার পিছনেই ছুটতেন তাকে ডাকতেন। তাদের নানানভাবে উৎসাহিত করতেন, সাহায্য করতেন। তাঁর শুরু করা আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে আশা জানালেন বিশিষ্ট জনেরা।
চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম বলেন, তিনি একটি সেন্টার গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, সেই সেন্টারটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। আমি আশা করি সেই কাজটি সমাপ্তি হোক।
এছাড়াও মুহম্মদ খসরুর মৃত্যুতে শোকাহত বন্ধু-সুহৃদরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্মৃতিচারণ করছেন। শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। কামনা করছেন যেন তাঁর আত্না শান্তিতে থাকেন