শাহেদ নুর :
বাংলা চলচ্চিত্রের এক সময় ছিলো সোনালী যুগ। এরপর কয়েক দশক পেরিয়ে হারিয়ে গেছে সেই যুগ। নকল, ভাঁড়ামো ও অশ্লীলতা ভর করে ঢাকাই ছবিতে। সেই যুগের অবসান ঘটাতে নতুন শতাব্দীর শুরুতে কিছু নবীন নান্দনিক শিল্পী, চলচ্চিত্রকার বাংলা সিনেমার হাল ধরেন। নির্মান করে নতুন নতুন চলচ্চিত্র। এই শিল্পের উন্নয়নে এগিয়ে আসে নিবেদিত প্রাণ চলচ্চিত্র কর্মীরা। শুরু হয় নতুন ও নান্দনিক ধারার চলচ্চিত্র চর্চা। সেই চর্চার একজন অগ্রগণ্য সৈনিক বর্তমান সময়ের নন্দিত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও শিক্ষক তৌকির আহমেদ। তিনি নব্বই দশকের একজন জনপ্রিয় নাট্য অভিনেতা ও নির্মাতা। চলচ্চিত্র নির্মাণে ইতোমধ্যে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বেশকিছু সম্মাননা ঝুলিতে পুরেছেন।
১৯৬৬ সালের ৫ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন মেধাবী এই নির্মাতা। জনপ্রিয় অভিনেতা, লেখক, পরিচালক ও শিক্ষক তৌকির আহমেদের জন্মদিনে কালচারাল ইয়ার্ড পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।
আশির দশকের শেষের দিকে তিনি নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। তিনি একাধারে মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। বিটিভিতে প্রচারিত নাটকগুলোতে অভিনয় করে রোমান্টিক চরিত্রের শীর্ষ অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করেন। আড়াল, জোসনা কাল, সবুজ পাতার গল্প, সোনালী রোদ্রের রং দেখিয়াছি, উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে, পোড়া গন্ধ শহর জুড়ে, রুমমেট আবশ্যক, একজন ভীতু মানুষসহ অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেন তিনি।
অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি নাট্যনির্মাণেও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। নব্বই দশকের শুরুতে তিনি চলচ্চিত্র অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৯৬ সালে তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক নদীর নাম মধুমতী, দেশ বিভাগের প্রেক্ষাপটে নির্মিত চিত্রা নদীর পারে (১৯৯৯) এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত বিখ্যাত উপন্যাস লালসালু অবলম্বনে নির্মিত লালসালু (২০০১) চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
২০০৬ সালে নিজের পরিচালিত রূপকথার গল্প চলচ্চিত্রে একজন ট্রাক ড্রাইভার চরিত্রে অভিনয় করেন। ২০০৯ সালে জনপ্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ রচিত প্রিয়তমেষু উপন্যাস অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত প্রিয়তমেষু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি মঞ্চ নাটকেও তিনি অভিনয় করেছেন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলায় চার দিনব্যাপী বিজয় দিবস উৎসবে সেলিনা শেলীর রচনায় ও মোহাম্মদ আলী হায়দারের নির্দেশনায় যমুনা নাটকে অভিনয় করেন।
অভিনেতা ও নির্মাতা তৌকির আহমেদের আরও খবর :
⇒ হীরালাল সেন পদক পেলো তৌকিরের হালদা
⇒ বাংলাদেশের সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতা তৌকির
তৌকির আহমেদ পরিচালিত প্রথম নাটক তোমার বসন্ত দিনে। ২০০৪ সালে তিনি তার ষষ্ঠ নাটক অরন্যের সুখ দুঃখ পরিচালনা করেন। একই বছর তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক ছবি ‘জয়যাত্রা’। আমজাদ হোসেন রচিত ‘জয়যাত্রা’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি। এ ছবির জন্য তিনি ২০০৫ সালে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার পান। ২০০৬ সালে ছবিটি ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। তিনি ২০০৮ সালে শ্রেষ্ঠ প্রযোজক, শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
২০০৬ সালে তাঁর রচিত ও পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘রূপকথার গল্প’ মুক্তি পায়। তিনি ২০০৭ সালে দ্বিতীয় বারের মত শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার অর্জন করেন ছবিটির জন্য। ছবিটি ২০০৮ সালে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দর্শকদের বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। তিনি ২০০৭ সালে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘দারুচিনি দ্বীপ’। এটি ২০০৮ সালে সাতটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে।
দীর্ঘ আট বছর পর তিনি নির্মাণ করেন সিনেমা ‘অজ্ঞাতনামা’। এতে অভিনয় করেন শহীদুজ্জামান সেলিম, মোশাররফ করিম ও নিপুনসহ অনেকে। সিনেমাটি ২০১৫ সালে একুশে বইমেলায় তাঁর নিজের প্রকাশিত হওয়া ‘অজ্ঞাতনামা’ বইয়েরই চলচ্চিত্রায়ন। চলচ্চিত্রটি ২০১৬ সালে কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব এবং বে অফ ন্যাপলস ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রদর্শিত হয়।
এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস প্রজনন কেন্দ্র ‘হালদা’ নদী নিয়ে ২০১৭ সালে তৌকির আহমেদ নির্মাণ করেন তার পঞ্চম চলচ্চিত্র ‘হালদা’। ছবিটি ২০১৮ সালে ১৬তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ নির্মাতা পুরস্কার অর্জন করে। ২০১৯ সালে তিনি নির্মাণ করেন ভাষা আন্দোলনের উপর নির্মিত ছবি ‘ফাগুন হাওয়ায়’। ছবিটি দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়।
তৌকির আহমেদ সংক্রান্ত আরও সংবাদ :
⇒ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে তৌকির আহমেদের ‘হালদা’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘জয়যাত্রা’ নির্মাণের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া তিনি বেশকিছু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। তাঁর রচিত তিনটি বই অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে।
তৌকির আহমেদ ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে এস এস সি ও এইচএসসি পাশ করেন। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল এবং প্রযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্থাপত্যে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৯৫ সালে তৌকির আহমেদ লন্ডনের রয়্যাল কোর্ট থিয়েটার থেকে মঞ্চ নাটক পরিচালনার উপর প্রশিক্ষন নেন। ২০০২ সালে তিনি নিউইয়র্ক ফিল্ম একাডেমি থেকে চলচ্চিত্রে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র টেলিভিশন ইনস্টিটিউটসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও অভিনয়ে পাঠদান করেন।
১৯৯৯ সালের ২৩ জুলাই বাংলাদেশের আরেকজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী বিপাশা হায়াতকে বিয়ে করেন তিনি। তাদের এক মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। মেয়ের নাম আরিশা আহমেদ ও ছেলে আরীব আহমেদ।
⇒ নির্মাতা তৌকির আহমেদের বহুল প্রসংশিত সিনেমা ‘অজ্ঞাতনামা’