শান্তা আক্তার :
একটি কবিতা পড়া হবে তার জন্য সে কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের/ কখন আসবে কবি? কখন আসবে কবি?/ শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন। কবি নির্মলেন্দু গুনের এই কবিতাটি স্মরণ করিয়ে দেয় এক রাজনৈতিক কবিতার কথা। এই কবিতাটি দৃপ্ত কন্ঠে শুনিয়েছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবর রহমান। এই কবিতায় মোহমুগ্ধ বাঙালি উদ্দীপ্ত হয়েছিলো শোষণের বিরুদ্ধে জেগে উঠার মুলমন্ত্রে।
আজ ৭ মার্চ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ভাষণ উজ্জীবিত করেছে বাঙালিকে। তিনি শুনিয়েছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই ভাষণের ১০৩ লাইন, ১৯ মিনিট দৈর্ঘ্যের প্রতিটি শব্দই ছন্দে ছন্দে হয়ে উঠেছে পুরো একটি কবিতা। কবি নির্মলেন্দু গুন এই ভাষণকে বলছেন, এটি সাধারণ কোন ভাষণ নয়, এটি একটি কবিতা। এই ভাষণটি সত্যিই ছিল কাব্যসমৃদ্ধ। এই ভাষণকে মার্কিন সাপ্তাহিক পত্রিকা টাইমস ‘বঙ্গবন্ধুর পয়েট অব পলিটিকস’ শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ স্টোরি করেছিল। মার্কিনিরা এই ভাষণকে স্টাডি করে এতে পেয়েছিলেন কবিতার সন্ধান।
নেতার উপস্থিতি আর কাব্যময়ী ভাষণে উজ্জীবিত জাতি পরবর্তীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে। নির্মলেন্দু গুন বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ যেমন বাঙালির কবি, বঙ্গবন্ধু তেমন বাঙালির রাজনৈতিক কবি। নির্মলেন্দু গুনের কবিতার ভাষায়……..
স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’
একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে-
‘কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি?’
এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না,
এই বৃক্ষে- ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,
এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না।
তাহলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি?
তাহলে কেমন ছিল শিশু পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে,
ফুলের বাগানে ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি?
জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে
হয়েছে উদ্যত কালো হাত।
তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ
কবির বিরুদ্ধে কবি,
মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,
মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ…।
হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,
শিশু পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি
একদিন সব জানতে পারবে,- আমি তোমাদের কথা ভেবে
লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প।
সেদিন এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর;
না পার্ক না ফুলের বাগান,- এসবের কিছুই ছিল না,
শুধু একখণ্ড অখণ্ড আকাশ যে রকম, সে রকম দিগন্ত প্লাবিত
ধু-ধু মাঠ ছিল দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়।
আমাদের স্বাধীনতাপ্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশে ছিল
এই ধু-ধু মাঠের সবুজে।
কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে এই মাঠে ছুটে এসেছিল
কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক, লাঙল জোয়াল কাঁধে
এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক, পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে
এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক, হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে
এসেছিল মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা,
ভবঘুরে আর তোমাদের মতো শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে।
একটি কবিতা পড়া হবে তার জন্য সে কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের।
‘কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি?’
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা,
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা- ;
কে রোধে তাঁহার বজ্র কণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শুনলেন তাঁর
অমর কবিতাখানি:
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের।