রোমান কবির :
ওয়াহিদুল হক, বাংলা সংস্কৃতির দিকপাল। সংস্কৃতির আলো জ্বালিয়ে পথ দেখানো এক ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’। তাঁর এই বাঁশির সুর তিনি ছড়িয়ে গেছেন আজীবন। পেশায় ছিলেন সাংবাদিক, লেখক ও সঙ্গীত শিল্পী। ছিলেন সংগঠক, রবীন্দ্র গবেষক ও শিল্পী, বাচিক ও আবৃত্তি শিল্পীদের শিক্ষক। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি ছিলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক নিরন্তর যোদ্ধা। সংস্কৃতির আলোবর্তিকা হাতে ঝোলা কাঁধে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। সংষ্কৃতি সংগঠন ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন বাচিক চর্চা শিল্প প্রতিষ্ঠান কণ্ঠশীলনসহ বহু সংগঠন। সংস্কৃতির এই মহান শিক্ষাগুরুর জয়ন্তী আজ। এই দিনে কালচারাল ইয়ার্ড পরিবার তাঁকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে।
আবুল ফারাহ মোহাম্মদ ওয়াহিদুল হক ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ ঢাকা জেলার ভাওয়াল মনহরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন৷ আরমানিটোলা গভর্ণমেন্ট হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন৷ ছাত্র থাকা অবস্থায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। ষাটের দশকে দি অবজারভারের শিফট্-ইন চার্জ ছিলেন। মর্নিং নিউজ ও দ্যা ডেইলি স্টারের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবেও তিনি কাজ করেছেন৷ ছিলেন দ্যা পিপলস্ পত্রিকার সম্পাদক। ওয়াহিদুল হক প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘ ১০ বছর। বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ও ছায়ানটের সভাপতি সানজিদা খাতুনকে ব্যাক্তিগত জীবনে বিয়ে করেন তিনি।
ওয়াহিদুল হকের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন সংগঠক। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের শিক্ষাগুরু। রবীন্দ্র সংগীত গবেষক ও শিক্ষক। সংগঠক ও বাঙালি সংস্কৃতির একনিষ্ঠ প্রচারক। রবীন্দ্র সংগীত ছিল তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র। ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি ‘ছায়ানট’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে কাজ করেন। নব্বই দশকের শেষ দিকে ছায়ানটের সহ-সভাপতি হন। এ পদে তিনি ছিলেন আমৃত্যু। এছাড়া তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন সাহিত্যের বাচিক চর্চা ও প্রসার প্রতিষ্ঠান কণ্ঠশীলন। এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
ছায়ানট ও কণ্ঠশীলন ছাড়াও ওয়াহিদুল হক জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের কার্যকরী পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও আমৃত্যু সভাপতি, শিশু আবৃত্তি সংগঠন শিশুতীর্থ ও আনন্দধবনির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। বাংলাদেশ ব্রতচারী সমিতির সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ আবৃত্তি ফেডারেশন (বর্তমান আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ)-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, আবৃত্তি পরিষদ-এর সভাপতিসহ বহু সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।
চলচ্চিত্র সংস্কৃতি অঙ্গনেও তিনি ভূমিকা রেখেছেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি পরে বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। ২০০১ সাল থেকে আমৃত্যু ‘নালন্দা’র-কার্যকরী পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন।
চেতনা ধারায় এসো, গানের ভিতর দিয়ে, সংস্কৃতিই জাগরণের প্রথম সূর্য, প্রবন্ধ সংগ্রহ, ব্যবহারিক বাংলা উচ্চারণ অভিধান, সংস্কৃতির ভুবন বই লিখেছেন তিনি। তাঁর আবৃত্তি ও গানের সিডির মধ্যে রয়েছে: সকল কাঁটা ধন্য করে, আজ যেমন করে গাইছে আকাশ, আছ অন্তরে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা।
সঙ্গীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৮ সালে একুশে পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত হন ওয়াহিদুল হক। এছাড়া তিনি কাজী মাহবুবউল্লাহ ট্রাস্ট স্বর্ণ পদক, বাংলা একাডেমী সম্মানসূচক ফেলোশীপ লাভ করেন। শিল্পকলায় অসাধারণ অবদানের জন্য ২০১০ সালে বাংলাদেশের ‘সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার’ ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ ভূষিত হন তিনি।
২০০৭ সালের ২৭ শে জানুয়ারি বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।