শাহেদ নুর :
সেতারশিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্কর, পরবর্তীতে যিনি হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম পথপ্রদর্শক। তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে পূর্ব থেকে নিয়ে গিয়েছেন পশ্চিমে। সারাবিশ্বে তুলে ধরেছেন ভারতের ধ্রুপদী সঙ্গীতকে। বিশ্বখ্যাত সেতারবাদন শিল্পী রবিশঙ্কর বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিত রায়ের ‘পথের পাঁচালি’ সিনেমায় প্রথমবারের মতো সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এ সিনেমায় সত্যজিত রায় যেমন খ্যাতিমান হোন, তেমনি কালজয়ী হয়ে আছেন রবিশঙ্করও। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এ গুরুর জন্মদিন আজ। ধ্রুপদী সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের সাথে কালচারাল ইয়ার্ড পরিবার তাঁকে এ দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে।
১৯২০ সালের ৭ এপ্রিল বেনারসের তিলেভণ্ডেশ্বর গলির ভাড়া বাড়িতে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রবিশঙ্কর। তাঁর পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিলো বাংলাদেশের নড়াইলের কালিয়ায়। রবিশঙ্কররা ছিলেন সাত ভাই। তাঁর বড় ভাই বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্কর। তাঁর বাবা শ্যাম শঙ্কর চৌধুরী ছিলেন একজন প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ ও আইনজ্ঞ। বারো বছর বয়স থেকেই রবি শংকর বড় ভাইয়ের নাচের দলের একক নৃত্যশিল্পী ও সেতার বাদক ছিলেন। আঠারো বছর বয়সে রবিশঙ্কর বড় ভাই উদয় শংকরের নাচের দল ছেড়ে মাইহারে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অমর শিল্পী আচার্য আলাউদ্দীন খান সাহেবের কাছে সেতারের দীক্ষা নেন। দীক্ষা গ্রহণকালে তিনি আচার্যের পুত্র সরোদের অমর শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খানের সংস্পর্শে আসেন। গুরুগৃহে রবি শংকর দীর্ঘ সাত বছর সেতারে সঙ্গীত শিক্ষা গ্রহণ করেন।
উচ্চাঙ্গ সেতার শিল্পী হিসেবে তিনি ছিলেন ঐতিহ্যমুখী ও শুদ্ধতাবাদী। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রবিশঙ্কর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাহক হিসেবে তাঁর সেতারবাদনকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রথম তুলে ধরেন। ১৯৫৬ সালে তিনি ইউরোপ ও আমেরিকায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এ সময় তিনি এডিনবার্গ ফেস্টিভালে এবং বিখ্যাত সঙ্গীত মঞ্চ রয়াল ফেস্টিভাল হলে সেতার বাজান।
একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে মানবিক সহায়তার জন্য জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে সেতার বাজিয়েছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তিনি মূলত এই অনুষ্ঠানের জন্যই জর্জ হ্যারিসনকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে জর্জ হ্যারিসনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনুষ্ঠানমালায় পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও তাঁর সঙ্গীরা উদ্বোধনী অঙ্কে সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের সঙ্গীতের মিলন পণ্ডিত রবিশঙ্করের অমর কীর্তি। বিখ্যাত বাঁশীবাদক জ্যঁ পিয়েরে রামপাল, জাপানী বাঁশীর সাকুহাচি গুরু হোসান ইয়ামামাটো এবং কোটো (ঐতিহ্যবাহী জাপানী তারযন্ত্র) গুরু মুসুমি মিয়াশিতার জন্য তিনি সঙ্গীত কম্পোজিশন করেছেন। বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ফিলিপ গ্রাসের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনা প্যাসেজেস তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।
একুশ বছর বয়সে তিনি আলাউদ্দীন খান সাহেবের মেয়ে অন্নপূর্ণা দেবীকে বিয়ে করেন। তাদের পুত্র সন্তান শুভেন্দ্র শঙ্কর। তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হলে আমেরিকান কনসার্ট উদ্যোক্তা স্যু জোন্স এর সাথে প্রণয়ে জড়ান তিনি। তখন তাদের একটি কন্যা সন্তান হয়। রবি শঙ্করের এই কন্যা নোরা জোন্স একজন প্রথিতযশা জ্যাজ, পপ, আধ্যাত্মিক এবং পাশ্চাত্য লোক সঙ্গীতের শিল্পী ও সুরকার। নোরা জোন্স ২০০৩ ও ২০০৫ সালে দশটি গ্র্যামি এওয়ার্ড পান। পরবর্তীতে রবিশঙ্কর তার গুণগ্রাহী ও অনুরক্তা সুকন্যা কৈতানকে বিয়ে করেন। এই বিয়েতে তাঁর দ্বিতীয় কন্যা অনুশকা শংকরের জন্ম হয়। বাবার কাছে শিক্ষা নিয়ে অনুশকা নিজেও সেতার বাদক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
চলচ্চিত্রে পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গীত পরিচালনা
কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিত রায়-এর ‘অপু ট্রিলজি’ অর্থাৎ ‘পথের পাঁচালি’, ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’ এবং সেইসঙ্গে ‘পরশপাথর’ চলচ্চিত্রগুলোতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেন। তাঁর সেই সুরসৃষ্টি কালজয়ী হয়ে আছে। সত্যজিত রায় শিল্পী রবিশঙ্করের উপর এক স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি বানানোর চিন্তা করেন। চিরাচরিত প্রথায় দৃশ্যের বর্ণনার বদলে কলম ও তুলি দিয়ে কালো কালিতে একের পর এক ছবি এঁকে সংলাপহীন, সংগীতবহুল ছবির ভিজ্যুয়াল স্ক্রিপ্ট বা দৃশ্য-চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন সত্যজিত রায়। এই দৃশ্য-চিত্রনাট্যের প্রতিটি ফ্রেমে রয়েছে রবিশঙ্করের ক্লোজ-আপ। সেই ক্লোজ-আপগুলোতে সেতারবাদনরত শিল্পীর নিবিষ্ট মুখের, সেতারে তাঁর হাতের আঙুলের, সেতারের গায়ের কারুকাজের, তবলিয়ার হাতের এবং আরও কিছু শৈল্পীক মোটিফ রয়েছে।
তার ভাবনার প্রাথমিক পর্বে নিজের কাজের ধারা অনুযায়ী সাদা-কালো জলরঙে মোট ৬৪টি স্কেচ করেছিলেন সত্যজিত। রবিশঙ্করও ওই খাতা দেখে মুগ্ধ হন। এগুলো নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ছবি তৈরির চিন্তা ছিলো সত্যজিতের। যদিও শেষ পর্যন্ত সত্যজিৎ রায় ছবিটি করতে পারেন নি। সেটি তাঁর খাতায় চিত্রনাট্যের চেহারাতেই থেকে গিয়েছিলো। ২০১৪ সালে সেইসব স্কেচ নিয়ে দুই মলাটের বই প্রকাশ করে সত্যজিৎ রায় সোসাইটি ও কলিনস। এর নাম দেওয়া হয় ‘সত্যজিৎ রায়’স রবিশঙ্কর: অ্যান আনফিল্মড ভিজ্যুয়াল স্ক্রিপ্ট’। এতে আছে রবিশঙ্করের কাজ নিয়ে সত্যজিতের রচনা, সত্যজিতের ছবির সঙ্গীত নিয়ে রবিশঙ্করের দু’টি সাক্ষাৎকার এবং সত্যজিৎ-রবিশঙ্কর বিষয়ক যাবতীয় তথ্য। বইটি সম্পাদনা করেছেন সত্যজিতের ছেলে সন্দীপ রায়।
১৯৬২ সালে ভারতীয় শিল্পের সর্বোচ্চ সম্মাননা পদক ভারতের রাষ্ট্রপতি পদক, ১৯৮১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ সুশীল সমাজ পুরস্কার পদ্মভূষণ ও ১৯৯৯ সালে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ভারতরত্ন-এ ভূষিত হন রবিশঙ্কর। এছাড়া ফুকোদা এশিয়ান কালচারাল প্রাইজেস-এর গ্র্যান্ড প্রাইজ, সুইডেনের পোলার মিউজিক প্রাইজ, ফরাসী সর্বোচ্চ সিভিলিয়ান অ্যাওয়ার্ড লিজিয়ন অব অনার, রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কর্তৃক প্রদত্ত অনারারী নাইটহুডসহ অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন তিনি। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত দেশিকোত্তমসহ ১৪টি সম্মানসূচক ডক্টরেট অর্জন করেন তিনি।
পণ্ডিত রবিশঙ্কর ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ১১ই ডিসেম্বর ৯২ বছর বয়সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মারা যান।