চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও সংগঠক বেলায়াত হোসেন মামুন। তিনি ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক এবং ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। বর্তমানে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পর্ষদ’র জাতীয় কমিটির আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। জাতীয় চলচ্চিত্র অনুদান নীতিমালা নিয়ে বিতর্ক, চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন, জাতীয় চলচ্চিত্র সম্মেলন, চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন ও এর ভবিষ্যতসহ নানা বিষয় নিয়ে কালচারাল ইয়ার্ড’র সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাতকার নিয়েছেন আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি রোমান কবির।
কালচারাল ইয়ার্ড: ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেওয়া চলচ্চিত্রের অনুদানে অনিয়মের অভিযোগে চারজন নির্মাতা অনুদান স্থগিত ও পুনঃনিরীক্ষণের জন্য উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেছেন। আদালত এ ব্যাপারে একটি রুলও জারি করেছেন। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।
বেলায়াত হোসেন মামুন: অনুদানের প্রজ্ঞাপণ স্থগিত ও পুনঃনিরীক্ষণের জন্য চারজন নির্মাতা একটি মামলা করেছেন। আদালতে শুনানির পর একটি রুলও জারি করা হয়েছে। অনুদান বিষয়ে প্রথমবারের মতো হাইকোর্টে এ বিষয়ে রিট হয়েছে। যে রুল জারি হয়েছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। রুলে বলা হয়েছে, চলতি বছর যে ৩টি প্রজ্ঞাপণে ১৪টি চলচ্চিত্রের অনুদানের সরকারি ঘোষণা হয়েছে তা কেন অবৈধ হবে না এবং চলতি বছরের অনুদানে জমা হওয়া সকল প্যাকেজ প্রস্তাব কেন পুনঃনিরীক্ষণ করা হবে না? এই রুলে দু’টি বিষয়ে স্পষ্ট দিক পাওয়া যায়, তা হলো অনুদান প্রদান প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয় এবং এই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় দেয়া অনুদানের ঘোষণা পুনঃনিরীক্ষণ হওয়া জরুরি।
দেখুন, এমনিতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি অনুদান নিয়ে নানা ধরণের অভিযোগ উঠছে। অনুদান তো রাষ্ট্রের টাকায় দেয়া হয়, জনগনের টাকায়। এটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে দেয়া হয়। অনুদান নীতিমালায় যে সব শর্তগুলো আছে সেগুলো যদি পুরোপুরি ফলো করে অনুদান দেয়া হয়, তাহলে তো কারও কোন আপত্তি থাকে না। কিন্তু যারা মামলা করেছেন তারা বলছেন যে, অনুদান প্রদানের ঘোষণায় অনুদান নীতিমালার অনেকগুলো শর্ত ভঙ্গ হয়েছে। তারা এগুলোর প্রতিকার চান। এ জন্য তারা কোর্টে গেছেন। আমি একজন চলচ্চিত্রকর্মী হিসেবে মনে করি, এটি খুবই জরুরি পদক্ষেপ ছিলো। যখন সামাজিকভাবে আমরা কোন কিছুর মীমাংসা করতে পারি না। তখন আদালতের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আমাদের যাওয়ার জায়গায়ই বা কোথায় থাকে। চলচ্চিত্রকর্মীরা সেটাই ভেবেছেন। আমি তাদের এ লড়াইকে সাধুবাদ জানাই।
কালচারাল ইয়ার্ড : অনুদানে নীতিমালা কীভাবে ও কোথায় লঙ্ঘন হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
বেলায়াত হোসেন মামুন: এই বিষয়ে যারা মামলা করেছেন তারা বলবেন। আমি যেটা দেখেছি তা হলো অনিয়মের অভিযোগে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের অনুদান প্রদান কমিটির চারজন সদস্য পদত্যাগ করেছেন। তারা বলেছেন যে, মন্ত্রণালয় তাদের কথা শুনছে না। তাদের সুপারিশের বাইরে মন্ত্রণালয় অনুদান দিয়েছে। এগুলো তো পাবলিকলি এসেছে। একজন আবেদনকারী ড. মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন দাবি করেছেন, বাছাই কমিটির নাম্বারিংয়ে তিনি প্রথমে ছিলেন। কিন্তু তাকে অনুদানের জন্য বিবেচনা করা হয় নি। ওনার অভিযোগ যারা নাম্বারিংয়ে পিছিয়ে ছিলেন তাদেরকে অনুদান দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়গুলো আমরা অনলাইনসহ নানা গণমাধ্যমে জেনেছি। এটি পরিস্কার যে, বিষয়টি ঠিকভাবে হচ্ছে না বলেই এই অভিযোগগুলো উঠছে।
কয়েক বছর আগে চলচ্চিত্র নির্মাতা আবু সাইয়ীদ সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছিলেন, ওনার স্ক্রিপ্ট নাম্বারিংয়ে প্রথমে ছিলো। কিন্তু চূড়ান্ত বাছাইয়ে তার স্ক্রিপ্টকে ফেলে দিয়ে অন্য কাউকে অনুদান দেওয়া হয়েছে। তো এই অভিযোগ প্রতি বছর আসছে, যা দু:খজনক। রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে অনুদান প্রদানের কাজটি হচ্ছে। এটি কারও খামখেয়ালিতে হওয়া উচিত নয়। তথ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত এ ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া। এ ধরণের বিতর্কের উর্ধ্বে উঠে তাদের কাজ করা উচিত।
কালচারাল ইয়ার্ড : আপনি অনেক সময় বলেছিলেন এবং লিখেছেন যে, অনুদান দেওয়া হচ্ছে এমন সব চলচ্চিত্রকে, যা আসলে মানের বিচারে যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে কি করণীয় আছে বলে আপনি মনে করেন?
বেলায়াত হোসেন মামুন: চলচ্চিত্র ‘দেবী’র বিষয়ে আমি লিখেছিলাম। ছবিটি নিয়ে আমার যে লেখা সেখানে এ কথা লিখেছিলাম।
দেখুন, অনুদান প্রদানের প্রক্রিয়া হুট করে শুরু হয় নি। এরও একটি ধারাবাহিকতা আছে। আমাদের রাষ্ট্র ও সরকার পদ্ধতি এমন যে আপনি কিছু্ চাইলেই তা পেয়ে যাবেন না। এর জন্য সংশ্লিষ্ট মানুষদের অনেক চেষ্টা ও লড়াই করতে হয়। তো অনুদান প্রদানের এই পদ্ধতিও হুটহাট শুরু হয়ে যায় নি। চলচ্চিত্র সংসদকর্মীদের দাবির প্রেক্ষিতেই অনুদান প্রদানের বিষয়টি গৃহিত হয়েছিল। চলচ্চিত্র সংসদকর্মীদের দাবি ছিল সৎ, শুদ্ধ, নান্দনিক, সৃজনশীল ও নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্রের জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে হবে। চলচ্চিত্র তো একটি সৃজনশীল শিল্পমাধ্যম। এখানে শিল্প অর্থে আর্ট বুঝতে হবে। তো বেশ দাবি দাওয়ার প্রেক্ষিতে অনুদান প্রদান যখন শুরু হলো তখন কিন্তু শিল্পধর্মী চলচ্চিত্রকেই অনুদান প্রদানের কাজটি করা হলো। খেয়াল করুন প্রথম অনুদান পাওয়া চলচ্চিত্রের প্রস্তাব ছিল ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’, ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’। এ সব চলচ্চিত্র তো আজ আমাদের ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে।
সাধারণত চলচ্চিত্রের প্রযোজকদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যবসার জন্য সিনেমা করা। অলমোস্ট সবাই এমন। এটা যে খারাপ তা বলছি না। ব্যবসা করতে চাওয়া খারাপ নয়। কিন্তু যে কোনো ব্যবসার স্বাভাবিক ধরণ হচ্ছে তা ক্রমাগত পণ্যায়নের দিকে দৌঁড়াতে থাকে। এ জন্য বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের প্রযোজকগণ তাদের ছবিকে আগাগোড়া ইন্টারটেইনমেন্টের প্যাকেজ বানাতে চান। এই বিনোদন সর্বস্বতার ভেতরে শুদ্ধ চলচ্চিত্র প্রাণ বাঁচাতে পারে না। ফলে বাণিজ্যিক ঘোরের বাইরে এসে যদি শুদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হয়, তাহলে সেখানে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল অংশগ্রহণ দরকার হয়। এমন একটি প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের অনুদান প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো। তো আমরা যদি বাংলাদেশের অনুদানের প্রেক্ষাপট চিন্তা করি তাহলে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘দেবী’ যেমন চলচ্চিত্র তার অনুদান পাওয়ার কথা নয়।
আমি আমার লেখায় বলেছিলাম যে ‘দেবী’ একটি ধরণের হরর ঘরানার চলচ্চিত্র। যদিও এর নির্মাতা ও প্রযোজক দাবি করছেন এটি সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার। কিন্তু আমি এই সিনেমার ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছি, এটি মোটেই সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার নয়, এটি একটি জাস্ট ভুতুড়ে ছবি। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসটিকেও তারা আসলে বুঝতে পারে নি। ছবিটির নির্মাতা, প্রযোজক ও চিত্রনাট্যকার উপন্যাসের এসেন্স না বুঝেই এর এডাপ্টটেশন করার চেষ্টা করেছেন। ফলে ভুল করেছেন।
তো কথা হলো একটি হরর ঘরানার চলচ্চিত্রের জন্য রাষ্ট্র কেন পাবলিক ফান্ডের অর্থ দেবে? সেটার জন্য তো বাণিজ্যিক ঘরানার প্রডিউসাররা আছেন। রাষ্ট্র অর্থায়ন করবে এমন সিনেমাকে, যে সিনেমা চলচ্চিত্র হিসেবে সৎ ও শুদ্ধ হবে। কোন ভৌতিক গল্পের দৃশ্যায়নের জন্য রাষ্ট্রের অর্থায়ন করা উচিত নয়। জনগনের টাকায় যে চলচ্চিত্র হবে, সেটিতো শিল্প বা আর্ট হিসেবে দাঁড়াতে হবে। আমরা আর্ট আর ইন্ড্রাস্ট্রিকে মিলিয়ে ফেলি। এক ধরণের গোঁজামিল দেওয়ার চেষ্টা করি। আর এই গোঁজামিলটা কাজ করে না। দেবীর ক্ষেত্রে করে নি।
‘দেবী’ একটি বাণিজ্যিক কাঠামোতে নির্মিত চলচ্চিত্র। এটা ‘দেবী’র অপরাধ নয়। বরং এমন চলচ্চিত্র হতেই পারে। হওয়া উচিতও। কিন্তু তা রাষ্ট্রের অর্থে নয়। পাবলিকের অর্থে সমাজে ভূতুড়ে গল্পের চলচ্চিত্র কোনো সচেতন মানুষ দেখতে চাইবেন না। কথা হলো যে, স্ক্রিপ্টে ছবিটি নির্মিত হয়েছে তা কেমন করে অনুদান পেলো? যদি স্ক্রিপ্ট শুরু থেকেই এমন হয়ে থাকে, তাহলে এই স্ক্রিপ্টের অনুদান পাওয়া উচিত হয় নি। যারা অনুদান দিয়েছেন, এই চিত্রনাট্যকে অনুদানের জন্য বিবেচনা করেছেন তারা সঠিক কাজ করেন নি।
এছাড়া এখন অনুদান নীতিমালায় একটি পরিবর্তন আনা দরকার। সেটি হলো, প্রডিউসার বা প্রযোজককে অনুদান প্রদানের চিন্তা বাদ দিতে হবে। এটা ভুল পদ্ধতি। অনুদান ব্যবসার উদ্দেশ্যে দেয়া হয় না। প্রযোজকের যে ধারণা আমাদের দেশে প্রচলিত তাতে প্রযোজক হচ্ছেন অর্থলগ্নিকারক। আর অর্থলগ্নিকারক স্বাভাবিকভাবেই লগ্নিকৃত অর্থের রিটার্ন চাইবেন। তাই জনগণের টাকায় যে অনুদান দেয়া হয়, তা প্রযোজকদের দেয়ার কোনো অর্থ থাকতে পারে না। এটা অনুদান প্রদানের যে এসেন্স, তার পরিপন্থি।
এখনকার অনুদান নীতিমালায় প্রযোজক বা প্রডিউসারকে অনুদান দেয়া হবে, এই ক্লজ থাকাতে যারা চলচ্চিত্র নির্মাতা নন, যারা চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছেন না, এমন লোকজন রাষ্ট্রীয় অর্থ পাওয়ার চেষ্টা করছেন। যেমন আমরা দেখেছি গতবার জয়া আহসান পেয়েছেন। এবার শমী কায়সার পেয়েছেন। এই বিষয়গুলো খুব ভালো নয়। কারণ একটি চলচ্চিত্রের জন্য একজন নির্মাতা যে লড়াই করছেন, একটি দীর্ঘ সময় সে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাকে অনুদান না দিয়ে এ ধরণের মুখচেনা মানুষকে দেয়া হচ্ছে, যারা চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে নির্মাতা হিসেবে সম্পৃক্ত নন। এটি ঠিক না।
কালচারাল ইয়ার্ড : অনুদান কমিটির গুণগত পরিবর্তন দরকার কী না?
বেলায়াত হোসেন মামুন: অবশ্যই দরকার। আমি মনে করি অনুদান কমিটি প্রতি বছর বদলানো দরকার। আগের কমিটিতে যারা থাকবেন পরের কমিটিতে তারা থাকবেন না। অনুদান যেহেতু রাষ্ট্রের অর্থ প্রদানের একটি প্রক্রিয়া। তাই এটিকে বিতর্কের উর্ধ্বে রাখতে হবে। আর এটা সবার জন্যই জরুরি। দীর্ঘদিন একই কমিটি বা একই ব্যক্তিবর্গ দায়িত্বপালন করলে এর ভিতরে সিন্ডিকেশনের মতো একটি ব্যাপার গড়ে ওঠে। এ ধরণের অভিযোগ আমরা শুনতে পাচ্ছি। ফলে সমাজের মানুষের কাছে একটি ভুল বার্তা যাচ্ছে যে, ওনাদের কাছে গিয়ে যদি আমরা একটু লবিং করি। তাহলে আমরা অনুদান পেয়ে যেতে পারি। এই জায়গাটা শুধরানো দরকার।
যে মানুষগুলো অনুদান কমিটিতে আছেন, তাদের সম্মানের কথাও বিবেচনা করা উচিত। কারণ তারা সারাজীবনের কাজ ও ত্যাগ দিয়ে এই মর্যাদা অর্জন করেছেন। তাদের এই মর্যাদার জায়গাটি ঠুনকো কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হোক, এটা কারো চাওয়ার কারণ নেই। এ সকল কমিটিতে দায়িত্ব পালনের কারণে যদি সম্মানীত মানুষজন বিব্রত হন, তবে তা হবে আমাদের সকলের জন্য দুঃখজনক। আর আমাদের সমাজ অর্থনৈতিক বিষয়ে গুজব ও কানকথায় ভীষণ উৎসাহী। ফলে এমন পরিস্থিতি যেন তৈরি না হতে পারে সে দিকে সবার সতর্ক দৃষ্টি থাকা দরকার। কমিটি প্রতিবছর বদল হলে এবং নীতিমালার অনুসারে কঠোরভাবে যদি অনুদান প্রদানের প্রক্রিয়া জারি থাকে, তবে তা নিয়ে এসব অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটবে না বলে মনে করি।
এছাড়া আরও একটি জরুরি বিষয়ে আলাপ তুলতে চাই। যদিও কথাটি অনেকদিন ধরেই বলছি। তা হলো, চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সকল কমিটিতে আমলাদের অংশগ্রহণ কমানো উচিত। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যে সকল কর্মকর্তা আছেন তাদের চলচ্চিত্র নিয়ে পৃথক কোনো প্রস্তুতি নেই, তারা এ বিষয়ে এক্সপার্টও নন। তারা চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশুনাও করেন নি। তারা সাচিবিক কাজ করার জন্য প্রশিক্ষিত। আমার কথা হলো চলচ্চিত্র নিয়ে তারাই নীতিনির্ধারণ করবেন যারা চলচ্চিত্র বিষয়ে নীতিনির্ধারণের সক্ষমতা রাখেন, তারা হবেন এমন মানুষ যারা দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্র নিয়ে নানা তৎপরতার মধ্যে আছেন; এই মানুষগুলোকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তাদের নির্ধারণ করা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য কাজ করবেন দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তাগণ। কিন্তু দুঃখজনক হলো এমনটি হচ্ছে না।
দেখা যাচ্ছে, চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কমিটিতে ১৫ জনের মধ্যে ১০ জন থাকেন আমলা আর ৫ জন থাকেন সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট মানুষ। এই ৫ জনের মাত্র ৩ জন হন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট মানুষ। ১৫ জনের মধ্যে ৩ জন কীভাবে চলচ্চিত্র বিষয়ে নীতিনির্ধারণের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিতে পারেন? ফলে এসব নামকাওয়াস্তের কমিটি থেকে চলচ্চিত্রের জন্য ভালো সিদ্ধান্ত কীভাবে আসবে?
মনে রাখা দরকার যে, চলচ্চিত্র বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার এক্সপার্টিজ আমলাদের নেই। তারা রাষ্ট্রের কর্মচারি, তারা তো জনপ্রতিনিধি নন। সিদ্ধান্ত দেওয়া তাদের দায়িত্ব নয়। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাদের। এটি সাংবিধানিক চিন্তার জায়গা থেকেই বলছি। এসব বিষয়ে আমাদের অধিকতর যত্নশীল ও স্পষ্টবাদী হওয়া উচিত। আমলাদের চামচাগিরি করে চলচ্চিত্র কেন, কোনো কিছুরই ভালো ফল আসতে পারে না। আবার আমলাদের দায়িত্বশীল আচরণ ছাড়াও কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত সরকারি কাঠামোতে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা কঠিন। ফলে রাষ্ট্রীয় সকল কাজে যার যার এখতিয়ারের সীমায় থাকা জরুরি। যার যা কাজ, তাকে তা করতে দিলেই এই ধরণের খিচুরি পরিস্থিতি থেকে আমরা বেঁচে থাকতে পারবো।
কালচারাল ইয়ার্ড : কিছুদিন আগে মন্ত্রণালয়ের আমলাদের দিয়ে গঠন করা হয়েছে চলচ্চিত্র বিষয়ক জাতীয় পরামর্শ কমিটি, সেখানে যদিও কয়েকজন চলচ্চিত্রকাররা রয়েছেন। এই কমিটি কী ধরণের ভূমিকা পালন করবে বলে আপনি মনে করেন?
বেলায়াত হোসেন মামুন: এই কমিটি কি ধরণের ভূমিকা রাখবে তা আমি জানি না। এই কমিটি কী ধরণের নীতিমালার আলোকে তৈরি হয়েছে তাও জানি না। জানি না এই কমিটির ক্ষমতা ও এখতিয়ার কতটুকু। এই কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত বিষয়ক কোনো নীতিমালা বা সিদ্ধান্ত না জেনে এই কমিটি সম্পর্কে মতামত দিতে পারি না। যদি এমন হয়, এই কমিটি যে সিদ্ধান্ত দেবেন বা পরামর্শ দেবেন; তথ্য মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনে যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলো ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে বাধ্য থাকবে, তাহলে এটি একটি শক্তিশালী কমিটি হবে। আর যদি এটি নামকাওয়াস্তে জাস্ট পরামর্শ দিলো এবং পরামর্শ গ্রহণ করা বা না করা আমলাদের ব্যাপার, তাহলে এই কমিটির কোন কার্যকারিতা থাকবে না। সেক্ষেত্রে এটি একটি আইওয়াসমূলক কর্মকাণ্ড হবে। সেক্ষেত্রে আমলাদের নানা বাজে সিদ্ধান্তের দায় এই কমিটির মধ্য দিয়ে জাস্টিফাই করার চেষ্টা হবে। সেটা সামগ্রিকভাবে চলচ্চিত্রের জন্য আরও ক্ষতিকর ব্যাপার হবে।
কালচারাল ইয়ার্ড : চলচ্চিত্র বিষয়ক জাতীয় পরামর্শ কমিটিতে চলচ্চিত্র সংসদের কোন প্রতিনিধিত্ব থাকবে কিনা?
বেলায়াত হোসেন মামুন: পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে দেখলাম বলা হয়েছে কমিটির সদস্যদের তালিকায় চলচ্চিত্র সংসদের একজন প্রতিনিধি থাকবেন। কিন্তু এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কেউ যোগাযোগ করেন নি। কোন চিঠিও দেয়া হয় নি। আমরা জানি না, আমাদের প্রতিনিধিত্ব তারা কীভাবে চাইছেন। তারা যদি মনে করেন আমাদের থাকা দরকার, তারা আমাদের ডাকবেন। ডাকলে আমরা যাবো।
সাক্ষাতকারের দ্বিতীয় পর্ব :
পেশার সুরক্ষায় প্রত্যেক চলচ্চিত্রকর্মীকেই লড়তে হবে: বেলায়াত হোসেন মামুন