
লেখক, গবেষক, সাংবাদিক ও শিক্ষক অনুপম হায়াৎ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন। চলচ্চিত্র বিষয়েও ডিগ্রি নিয়েছেন। ছিলেন টিসিবির সাবেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্য ও চলচ্চিত্রের জুরি বোর্ডের সদস্যও হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে চলচ্চিত্র বিষয়ে শিক্ষকতা করেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রীন বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, ঢাকা ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে। তিনি বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের ফেলো। তাঁর লেখা ‘ঈদ উৎসবের ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থে প্রকাশিত ‘বাঙালি সংস্কৃতিতে ঈদ’ শিরোনামের এই লেখাটি ‘কালচারাল ইয়ার্ড’ এর পাঠকদের জন্য হুবাহু দেয়া হলো।
সংস্কৃতি শব্দটি ইংরেজি কালচার এর অনুসঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ভাষায় ‘সংস্কৃতি’ অর্থ কোন বিশেষ জনগোষ্ঠীর স্বীকৃত ও সুবিন্যস্ত আচরণ রীতি: বস্তুগত অর্জন, বুদ্ধিবৃত্তিগত বিকাশও আধ্যাত্নিক ধ্যান-ধারণা তার অন্তর্গত। ঘর-বাড়ি, পোশাক-পরিচ্ছদ, শিল্প-সাহিত্য এবং ধর্ম ও দর্শনচিন্তা- এসবই সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ।
আরব দেশে সপ্তম শতকে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে এক নতুন ধরণের সংস্কৃতি চালু হয় বিশ্বাস-স্রস্টা-ইহকাল-পরকাল-পাপ-পূণ্য-বেহেশত-দোজখ এবং ধর্মীয় বিধি বিধান পালন, মানবিক সম্পর্ক এবং ভাব ও প্রকাশের ক্ষেত্রে। বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে এই ধর্মের বিস্তারের সাথে সাথে ‘ইসলামী সংস্কৃতি’ও চালু হয়। সেই সঙ্গে যোগ হয় স্থানীয় সংস্কৃতিও। বাঙালি সংষ্কৃতিতেও ইসলামের বিভিন্ন মূল উপাদান, রীতিনীতি, ঈদ উৎসবের প্রভাব পড়েছে। বর্তমান প্রবন্ধে শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-নাটকে ঈদের প্রভা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হয়েছে।
‘ঈদ-উল ফিতর’ ও ‘ঈদ-উল আযহা’ মুসলমানদের প্রধান দু’টি ধর্মীয় উৎসব। বাঙালি মুসলমানদের কাছে এ দু’টি পর্ব এখন জাতীয় উৎসবে রুপান্তরিত হয়েছে। এ দু’টি উৎসব নিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনেক কবিতা, গান ও প্রবন্ধ নিবন্ধ রচিত হয়েছে। ঈদ উপলক্ষে এখন প্রতিটি সংবাদপত্র-সাময়িকীই বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করে থাকে। এছাড়াও এ উপলক্ষে অনেক সঙ্কলন-স্মরণিকা প্রকাশিত হয়ে থাকে। সাম্প্রতিককালে ঈদ উপলক্ষে গানের ক্যাসেটও বের হচ্ছে। কিন্তু ঈদ নিয়ে কোন নাটক-নাটিকা রচিত হয়েছে কি? এ ব্যাপারে আলোচনার আগে দেখা যাক ঈদ নিয়ে কবিতা ও গান রচনার প্রাথমিক পর্ব কি ছিলো।
ঈদ নিয়ে প্রথম কবিতা রচনার নিদর্শন পাওয়া যায় ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার মাসিক ‘প্রচারক’ পত্রিকায়। এই পত্রিকায় চতুর্থ বর্ষ ৯-১০ সংখ্যায় মুন্সী মোহাম্মদ আসাদ আলী রচিত ঈদুল-আজহা নামে একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। ড. আনিসুজ্জামান সম্পাদিত মুসলিম বাংলার সাময়িক পত্র (১৯৬৯) থেকে এ তথ্য জানা যায়। অন্যদিকে সৈয়দ এমদাদ আলী দাবি করেছেন যে, ১৯০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে মাসিক ‘নবনূর’ পত্রিকায় ‘ঈদ’ নামে যে কবিতাটি প্রকাশিত হয় সেটিই মুসলিম বাংলার ঈদ বিষয়ক প্রথম কবিতা। সৈয়দ এমদাদ আলী ১৯০৪ সালেও ঈদ নিয়ে আরেকটি কবিতা লেখেন। পরবর্তীতে কায়কোবাদ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ ঈদ নিয়ে কবিতা রচনা করেন। নজরুলের ‘কোরবানী’, ‘ঈদ মোবারক’, ‘শহীদী ঈদ’, ‘কৃষকের ঈদ’ বাংলা কাব্য সাহিত্যের মূল্যবান সংযোজন।
বাংলা ইসলামী সঙ্গীতও নজরুলের দানে হয়েছে সমৃদ্ধ। রমজান বা রোজার মাস শেষে ঈদ-উল ফিতর উপলক্ষে নজরুল রচনা করেন ‘ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। ঈদ উপলক্ষে এটিই রচিত প্রথম গান যা গ্রামোফোন রেকর্ডে মরমী শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে ধারণ করা হয়। বিশ শতকের তিরিশ দশকে রচিত এই গানটি আজও জনপ্রিয়তার অম্লান।
ঈদ নিয়ে প্রথম নাটক রচনার কৃতিত্বও কাজী নজরুল ইসলামের। তাঁর রচিত নাটকটির নাম ‘ঈদুল ফেতর’। মূলত ‘ঈদুল ফেতর’ একটি রেকর্ড নাট্য। এটি ছিল মাস্টারস ভয়েজ গ্রামোফোন কোম্পানি হতে ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় ( রেকর্ড নম্বর এন ৯৮২৩-৯৮২৪)। আঙ্গিকগত দিক দিয়ে এটি একটি নাটিকা এবং প্রচার মাধ্যমগত বৈশিষ্ট্যে ‘শ্রুতি নাটক’ হিসেবে গণ্য।
‘ঈদুল ফেতর’ এর আখ্যান ভাগ গড়ে উঠেছে একজন হাড়কঞ্জুস জমিদারের তথাকথিত ঈর্ষাপরায়নতা, গরীব-দু:খী ফকিরের প্রতি দুর্ব্যবহার, ঈদ-উল ফিতরের দিন পুত্রের নিখোঁজ হওয়া এবং পরে ফকিরের কেরামতিতে পুত্রের গৃহে প্রত্যাবর্তন নিয়ে। নাটকটির কুশীলব হচ্ছে জমিদার, ফকির, চাকর ইমতাজ, বালক, বদনার মা ও পথচারী। এতে রয়েছে তিনটি গান (১) ‘ফুরিয়ে এলো রমজানেরই মোবারক মাস’ (ফকির), (২) ঈদের খুশির তুফানে আজ (সমবেত) ও (৩) প্রাণের প্রিয়তম (ফকির)।
নাটিকার শুরুতেই রয়েছে ফকিরের কণ্ঠে গান ‘ফুরিয়ে এলো রমজানেরই মোবারক মাস’। ফকিরের গানের গলা শুনে রোজাদার কঞ্জুস জমিদার বিরক্ত হয়ে চাকর ইমতাজকে ডাকে। ইমতাজ জানায় যে, ফকির ফেতরা চায়। জমিদার জানায় যে, সে নামাজ পড়ে রোজা রাখে কিন্তু ফেতরা দেয় না। বলে খোদা আর নবীর সব হুকুম পালন করতে হলে আমাকে আর জমিদারি চালাতে হতো না। তোমাদের সাথে ভিখ মাঙ্গা ফকির হয়ে ভিক্ষা মেগে বেড়াতে হতো….। ফকিরের সঙ্গে বিতণ্ডা চরমে পৌঁছলে জমিদার তাকে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেয়। যাওয়ার সময় ফকির বলে যায়: আমি ভাগছি। কিন্তু দ্বীণ দরিদ্রকে তোমার দৌলতের ভাগ দিতেই হবে-এযে খোদার হুকুম। ফকির চলে গেলে জমিদার শেষ রোজারে সূর্যকে তাড়াতাড়ি ডোবাবার জন্য চাকর ইমতিয়াজ ও কাজের মেয়ে বদনার মাকে বাঁশ এনে খোঁচাতে বলে।
দৃশ্যান্তর ঘটে। চারদিকে ঈদের আনন্দ। পথচারীরা সমবেত কণ্ঠে গায় `ঈদের খুশির তুফানে আজ ডাক কোটাল বান’। কিন্তু ঈদের এই খুশির দিনে জমিদারের কিশোর পুত্র শাহজাদাকে খুঁজে পওয়া যাচ্ছেনা। ইমতিয়াজ তাকে পুকুরে গোসল করাতে নিয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে সে নিখোঁজ। ঈদের দিন একমাত্র পুত্রের নিখোঁজ হওয়ার কারণে জমিদারের প্রাণ কেঁদে উঠে। এমন সময় শোনা যায় ফকিরের গান-প্রাণের প্রিয়তম যাহা….। জমিদার ফকিরের কাছে ছুটে যায়, হারানো ছেলেকে ফিরিয়ে এনে দেয়ার অনুরোধ জানায়।
জমিদার চরিত্রটির মাধ্যমে নাট্যকার নজরুল, ধর্মীয় ও সামাজিক দিকটি শিক্ষণীয়ভাবে তুলে ধরেছেন। ফকির চরিত্রটি রুপকধর্মী সে জমিদারের কাছে ফেতরা নেয়ার ছলে এলেও পরবর্তীতে জমিদারের পুত্র হারানো ও পুত্র ফিরে পাওয়া এবং তাকে ইসলাম ধর্মের সারমর্ম শিক্ষাদানের মাধ্যমে তা স্পষ্ট হয়। তবে নাটিকাটির কাহিনীসূত্রে বোঝা যায়, ফকির যেন নিজেই জমিদারের পুত্রকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছিল। কাহিনী যা-ই হোক, কাঠমোল্লা হাতকঞ্জুস ধরণের লোক দেখানো ধার্মিকদের সুপথে আনাই হচ্ছে ‘ঈদুল ফেতর’ নাটিকাটির উদ্দেশ্য। এদিক দিয়ে নাট্যকার নজরুল সার্থক। ‘ঈদুল ফেতর’ রেকর্ড নাট্যে কণ্ঠ দিয়েছেন ধীরেন দাস ও আশ্চর্য্যময়ী।
কাজী নজরুল ইসলাম ঈদ নিয়ে আরও একটি নাটিকা লিখেছেন। এই নাটিকাটির নাম ‘ঈদ’। এটিও শ্রুতি নাটক। ঈদ প্রথম প্রচারিত হয় কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে ১৯৪১ সালের ২৩ অক্টোবর ঈদ-উল ফিতরের দিন ভোরবেলায়। নাটিকায় অংশ নিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, চিত্তরঞ্জন রায়, মুহম্মদ হোসেন খসরু, কামাল চৌধুরী, রেহানা বেগম ও আফরোজা আক্তার।
‘ঈদ’ নাটিকাটিও আবর্তিত হয়েছে ঈদ-উল ফিতরকে নিয়ে। এর কুশিলব হচ্ছে মহবুব, শমসের, মাহতাব, গুলশান ও বেদৌরা। এতে গান রয়েছে তিনটি। বিদায় বেলায় সালাম লহ মাহে রমজানে রোজা (মাহতাব), নাই হলো মা বসন ভূষন এই ঈদে আমার (গুলশান) ও এলো ঈদুল ফেতর ( বেদৌরা)।
ঈদ নিয়ে পরবর্তীকালে আরও অনেকে হয়তো নাটক নাটিকা রচনা করেছেন। মোহাম্মদ কাশেমও (১৯০৫-১৯৫৭) ‘ঈদুল ফিতর’ ও ‘ঈদুল আজহা’ নামে দুটি ‘শ্রুতি নাটক’ লিখেছেন। দুটি নাটিকাই চল্লিশের দশকে ঢাকা বেতার কেন্দ্র হতে প্রচারিত হয়েছে। ঈদ বিষয়ক যে সব নাটিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে নান্দনিক বিবেচনায় তা এখানে বাদ দেয়া হয়েছে। শুধুমাত্র তথ্যভিত্তিব বিবরণই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। বাঙালি মুসলমানদের পশ্চাৎপদতার সময়ে সেই তিরিশ ও চল্লিশের দশকের ক্রান্তিকালে ঈদ নিয়ে নাটক রচনা অবশ্যই গুরত্বপূর্ণ ব্যাপার। এগুলো আমাদের শিল্প চেতনা, ধর্মীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সমন্বিত নিদর্শন।
ঈদ নিয়ে সংবাদপত্র, বেতার, টেলিভিশন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন অনুষ্ঠান নির্মাণ করে থাকে। পোশাক, ফ্যাশন, অলঙ্কার, মুদ্রিত কার্ডেও ঈদ সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটে থাকে।