বিশেষ প্রতিনিধি :
‘ন্যায়ের জন্য বিপ্লব’র ধারণা থেকে থার্ড সিনেমার জন্ম। ল্যাতিন আমেরিকার বিপ্লবকে উপজীব্য করে যে সিনেমা রীতির উদ্ভব ঘটেছিলো তা-ই থার্ড সিনেমা। সেই রীতি অনুসরণ করে পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ দেশে দেশে বিপ্লবের হাতিয়ার হিসেবে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। সেই রীতিকে ধারণ করে স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে সিনেমা নির্মাণ করেছেন বিপ্লবী মন্ত্রে উজ্জীবিত চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান। এমনকি স্বাধীনতা যুদ্ধেও অস্ত্র হিসেবে তাঁর ক্যামেরা ছিলো সচল। একাত্তরে তিনি নির্মাণ করেছেন থার্ড সিনেমা ‘স্টপ জেনোসাইড’। স্বাধীনতার পরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি তাঁর কাছে ছিলো যেগুলো দিয়ে তিনি সিনেমা নির্মাণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীরা তাকে স্বাধীন দেশে এ সিনেমা বানাতে দিতে চাননি। তাই তাকে সরিয়ে দেবার মিশন শুরু হয়। সে পর্যন্ত তারা সফলও হয়।
বিপ্লবী চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের জন্মদিন আজ ১৯ আগস্ট। ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনীর মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর জন্মদিনে কালচারাল ইয়ার্ড পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।
একাত্তরের ভয়াবহ চিত্র ক্যামেরায় তুলে এনে তিনি নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’। যার মাধ্যমে পাকিস্তানীদের বর্বরতার চিত্র তিনি বিশ্বব্যাপী প্রদর্শন করেছেন। তিনি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন নিয়ে নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’। সে সময় তাঁর ছবি দেখে বিশ্বখ্যাত নির্মাতা সত্যজিত রায়, মৃণাল রায় ও ঋত্ত্বিক ঘটক উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন।
থার্ড সিনেমার নির্মাতারা শোসক শ্রেণীর রোষানলে পড়েন সবসময়। ইতিহাস বলে তাঁদের অনেককেই সিনেমা বানানোর জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে। বাংলার থার্ড সিনেমার নির্মাতা জহির রায়হানকে হারাতে হয়েছে আমাদের।
১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকত্তোর ডিগ্রি লাভ করেন জহির রায়হান। সাংবাদিক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৫০ সালে তিনি ‘যুগের আলো’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি ‘খাপছাড়া’,যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন।
১৯৫৭ সালে পাকিস্তানী সিনেমা জাগো হুয়া সাবেরা’য় সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আসেন। তিনি সালাউদ্দীনের ছবি যে নদী মরুপথেতেও সহকারী হিসেবে কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম এর এ দেশ তোমার আমার ছবিতে কাজ করেন। তিনি এ ছবির নামসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ১৯৬০ সালে কখনো আসেনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিচালনায় আসেন। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’নির্মাণ করেন (উর্দু ভাষার ছবি) এবং পরের বছর তাঁর প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র বাহানা মুক্তি দেন। জহির রায়হান ‘ভাষা আন্দোলনে’ সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ২১শে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তাঁর ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’তে।
তিনি ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন।
জহির রায়হান তাঁর ‘স্টপ জেনোসাইড’ প্রামাণ্যচিত্রের জন্য অনেক বেশি আলোচিত। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন’,‘এ স্টেইট ইজ বর্ন’,‘লিবারেশন ফাইটার্স’।
সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রেও ছিল জহির রায়হানের অবাধ বিচরণ । তাঁর প্রথম প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ, তৃষ্ণা। একুশে ফেব্রুয়ারি, কয়েকটি মৃত্যু, শেষ বিকেলের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আরেক ফাল্গুন, বরফ গলা নদী, আর কত দিন।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর পরই জহির রায়হান তাঁর ভাই প্রখ্যাত সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে বের হন। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আলবদর বাহিনীর ক’জন সদস্য তাঁকে তাঁর বাসা ২৯ বি কে গাঙ্গুলী লেন থেকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তিনি আর ফেরেন নি। ভাইকে খুঁজতে জহির রায়হান মিরপুর এলাকাতে যান। বিভিন্ন তথ্যের উপর ভিত্তি করে ধারণা করা হয়, নিজের মতাদর্শের কারণে আগে থেকেই স্বাধীনতাবিরোধীদের চক্ষুশূল ছিলেন জহির রায়হান। তারাই তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি। জহির রায়হান তাঁর একটি কাজ শেষ করে যেতে পারেন নি। ১৯৭০ সালে তিনি ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ নির্মাণ শুরু করেছিলেন।