নিজস্ব প্রতিবেদক:
কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের রাজশাহীর পৈত্রিক ভিটা ভেঙ্গে ফেলে সেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে গাড়ির গ্যারেজ। রাজশাহী শহরের মিঞা পাড়ায় অবস্থিত এই বাড়িতেই কেটেছে ঋত্বিকের শৈশব ও কৈশোর। সেখানেই তিনি পড়েছেন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে। নাট্যচর্চা করেছেন। চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন। দেশবিভাগের মধ্য দিয়ে তাঁকে পাড়ি জমাতে হয় ওপারে। এপারে তাঁর একমাত্র স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি রাজশাহীর এই পৈতৃক ভিটা।
এই বাড়িতে ছিলেন ঋত্বিক কুমার ঘটকের পরিবার, বাবা-মা ও অন্যান্য ভাই বোনেরা। থেকেছেন তাঁর ভাইঝি বরেণ্য কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী। বহু স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িটির রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব।
রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ এই বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ এই বাড়ির ৩৪ শতাংশ জমি ১৯৮৯ সালে এরশাদ সরকার রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজকে ইজারা দেয় এনিমি সম্পত্তি হিসেবে। কলেজ কর্তৃপক্ষ বাড়ির একটি অংশ পুরোটা ভেঙে ইট, সিমেন্ট ও সুরকি সরিয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যে।
রাজশাহীতে ক্রিয়াশীল ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র সংসদ, রাজশাহী চলচ্চিত্র সংসদ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ এই বাড়িটিকে উদ্ধার ও সংরক্ষণের দাবিতে ৩ বছর আগেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিলো। কিন্তু কার্যত এ বিষয়ে কোনো প্রতিকার হয় নি।
এদিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে রাজশাহীসহ সারাদেশে প্রতিবাদে সরব হয়েছে চলচ্চিত্রকার ও চলচ্চিত্র আন্দোলনের কর্মীরা। সম্মলিত ব্যানারে রাজশাহীতে মানবন্ধনের ডাক দিয়েছে ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটি, রাজশাহী ফিল্ম সোসাইটি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ এবং বরেন্দ্র ফিল্ম সোসাইটি।
কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের পৈত্রিক বাড়িকে হেরিটেজ ঘোষণা করার দাবিতে ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির উদ্যোগে মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে মানববন্ধন কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ‘ঋত্বিক চলচ্চিত্র উৎসব’-এর চেয়ারম্যান আহসান কবীর লিটন।
এদিকে ঋত্বিক ঘটকের পিতৃভিটা ভেঙে ফেলার প্রতিবাদে বারোজন চলচ্চিত্র নির্মাতার স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতি পাঠানো হয়েছে গণমাধ্যমে।
বিবৃতিতে বলা হয়, বিশ্ববরেণ্য বাঙালি চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের পৈত্রিক বাড়ী রাজশাহীর মিঞা পাড়ার ভবনটি ভেঙে ফেলার ঘৃণ্য উদ্যোগকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করি। পরিত্যক্ত ঐ বাড়ীতে একটি ‘ঋত্বিক চলচ্চিত্র কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা দেশের চলচ্চিত্র কর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবী। কিন্তু সেনা শাসন ও স্বৈর শাসনকালে সে স্থানে একটি হোমিওপ্যাথ কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। রাজশাহীর ‘ঋত্বিক চলচ্চিত্র সংসদ’ কর্মীরা সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান নূরের কাছে ঐতিহ্যবাহী বাড়ীতে একটি চলচ্চিত্র কেন্দ্র করার জন্য দাবীপত্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। কিন্তু বিগত ৩ বছরে কোন সারাশব্দ পাওয়া যায়নি। গত শনিবার ২১ ডিসেম্বর কলেজ কর্তৃপক্ষ সাইকেল স্ট্যান্ড করার অজুহাতে ভবনের একটি অংশ গুড়িয়ে দেয়। আমরা এ হীন কাজের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। বিষয়টি আজ সংস্কৃতি মন্ত্রীর গোচরে এলে তিনি দ্রুত জেলা প্রশাসককে ভাঙার কাজ স্থগিত করতে আশু পদক্ষেপ গ্রহণে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান। নির্দেশ মত ভাঙার কাজ স্থগিত হয়েছে। কিন্তু এটিতো সাময়িক ব্যবস্থা। বাংলা চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষা নির্মাণের জনক আমাদের এই বাংলাদেশে জন্মেছিলেন এতো আমাদের শ্লাঘার বিষয়।
আমরা অনতিবিলম্বে ‘ঋত্বিক ফিল্ম সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করে আমাদের চলচ্চিত্রের ঐতিহ্য রক্ষার জন্য ভবনটিকে ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা করে স্থায়ী সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছি। দেশ বিদেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শন, গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও উৎসব আয়োজনের মধ্যদিয়ে উত্তরবঙ্গে একটি ভিন্নমাত্রার চলচ্চিত্র আন্দোলন এই প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে। আর এই ধরণের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে আমাদের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিকাশ সাধিত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমাদের জোর দাবি হোমিওপ্যাথ কলেজটি ভিন্ন একটি স্থানে স্থানান্তর করে ‘ঋত্বিক চলচিত্র কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করা হোক।
বিবৃতিদাতা নির্মাতারা হলেন: নাসির উদ্দীন ইউসুফ, তানভীর মোকাম্মেল, মানজারে হাসীন মুরাদ, মোরশেদুল ইসলাম, এনায়েত করিম বাবুল, অঞ্জন জাহিদুর রহমান, আকরাম খান, রাকিবুল হাসান, শামীম আখতার, নূরুল আলম আতিক, সি এন রাশেদ চৌধুরী, ফৌজিয়া খান।
এদিকে সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও ঐতিহাসিক স্মৃতিস্থাপনা সংরক্ষণের দাবিতে দুটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ (এফএফএসবি)। রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজকে অন্যত্র স্থানান্তর করে ঋত্বিক কুমার ঘটকের পৈতৃক বাড়িটিকে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার মর্যাদা করার দাবি করা হয় এই সংগঠনের পক্ষ থেকে।
এ কর্মসূচির ব্যপারে নিশ্চিত করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুন। তিনি বলেন, উপমহাদেশের বরেণ্য চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের পৈত্রিক ভিটা অবিলম্বে উদ্ধার ও সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছে। আমরা জানি, বাংলাদেশের যে কোনো সংস্কৃতিমনা মানুষেরও এই একই দাবি। বাংলাভাষার অসামান্য চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের জন্ম ঢাকায় এবং তাঁর শৈশব-কৈশোর ও তারুণ্যের কাল রাজশাহীতে কেটেছিলো। এ আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। ঋত্বিক কুমার ঘটক আপন কীর্তিতে উজ্জ্বল প্রাণ। তাঁর স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনার সংরক্ষণ আমাদের ইতিহাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই আমাদের দাবি অবিলম্বে ঋত্বিক কুমার ঘটকের পৈত্রিক বাড়ি থেকে রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজকে অন্যত্র স্থানান্তর করা হোক এবং বাড়িটিকে একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার মর্যাদা প্রদান করে সেখানে ঋত্বিক ঘটক জাদুঘর ও চলচ্চিত্র কেন্দ্র গড়ে তোলা হোক।
সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও ঐতিহাসিক স্মৃতিস্থাপনা সংরক্ষণের দাবিতে আমরা দুটি কর্মসূচি ঘোষণা করছি।
১। উপমহাদেশের বরেণ্য চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের পৈত্রিক ভিটা উদ্ধার ও সংরক্ষণের দাবিতে আগামী ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯, শনিবার, বিকাল ৪টায় জাতীয় জাদুঘর সামনে চলচ্চিত্র সংসদকর্মী, চলচ্চিত্রকর্মী ও সংস্কৃতিকর্মীদের মানববন্ধনের মানববন্ধন করা হবে।
২। আগামী ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯, রবিবার, সকাল ১১টায় উপমহাদেশের কিংবদন্তী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি থানার মসূয়া গ্রামে অবস্থিত পৈত্রিক বাড়ী, ঋত্বিক কুমার ঘটকের রাজশাহী শহরের মিঞাপাড়ায় অবস্থিত পৈত্রিক বাড়ি এবং ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলিতে অবস্থিত মৃণাল সেনের পৈত্রিক ভিটা ও স্মৃতি স্থাপনা উদ্ধার এবং সংরক্ষণের দাবিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি প্রদান।
আমরা আশা করি, আমাদের এই কর্মসূচিতে আপনার অংশগ্রহণ আমাদের ইতিহাস সংরক্ষণে ভূমিকা রাখবে।