কালচারাল ইয়ার্ড ডেস্ক :
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের পৈত্রিক ভিটার একটি অংশ ভেঙে সেখানে সাইকেল গ্যারেজ করার প্রতিবাদে ইতোমধ্যে ফুঁসে উঠেছিলো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকর্মীরা। চলচ্চিত্রকর্মীদের আন্দোলনের মুখে ঋত্বিক ঘটকের বাড়ির এই অংশ ভাঙার কাজ স্থগিত করে রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এবার এ চলচ্চিত্র পরিচালকের বসতভিটা রক্ষা এবং ঋত্বিক চলচ্চিত্র কেন্দ্র ও জাদুঘর নির্মাণের দাবিতে বিবৃতি দিয়েছেন বাংলাদেশ ও ভারতের চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বরা।
বিবৃতি দেওয়া বাংলাদেশের ১৬ জন চলচ্চিত্র ব্যাক্তিত্ব হলেন: লেখক-গবেষক অনুপম হায়াৎ, লেখক-অনুবাদক মাহমুদুল হোসেন, শিক্ষক-লেখক মঈনুদ্দীন খালেদ, শিক্ষক-গবেষক জাকির হোসেন রাজু, সংগ্রাহক-গবেষক মীর শামছুল আলম বাবু, লেখক-বিশ্লেষক বিধান রিবেরু, শিক্ষক-গবেষক ফাতিমা আমিন, লেখক-শিক্ষক-গবেষক আ-আল মামুন, লেখক-সংগঠক শৈবাল চৌধুরী, সম্পাদক-প্রকাশক কাজী মামুন হায়দার, শিক্ষক-গবেষক হাবিবা রহমান, শিক্ষক-গবেষক গোপা বিশ্বাস সিজার, লেখক-সংগঠক বেলায়াত হোসেন মামুন, শিক্ষক-গবেষক তাজিন আহমেদ, প্রকাশক-সম্পাদক এ কে এম আতিকুজ্জামান এবং লেখক-গবেষক-শিক্ষক ফাহমিদুল হক।
আর খবর :
⇒ সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের বাড়ি সংরক্ষণের দাবিতে মানববন্ধন
⇒ আন্দোলনের মুখে ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি ভাঙা বন্ধ
⇒ ভাঙা হচ্ছে ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি: প্রতিবাদে সরব চলচ্চিত্রকর্মীরা
ভারত থেকে বিবৃতি দেওয়া ৮ জন হলেন: সর্বভারতীয় সংগঠক প্রেমেন্দ্র মজুমদার, শিক্ষক-পরিচালক শ্যামল কর্মকার, পরিচালক ইন্দ্রনীল রায় চৌধুরী, শব্দ প্রকৌশলী শান্তনু মুখার্জি, পরিচালক মনীষ কে দাস, পরিচালক অভিষেক ভট্টাচার্য্য, পরিচালক এম আর রাজন ও চিত্রগ্রাহক সত্য রায় নাগপাল।
বিবৃতিতে হোমিওপ্যাথি কলেজটি ভিন্ন একটি স্থানে স্থানান্তর করে অনতিবিলম্বে বাড়িটিতে ‘ঋত্বিক চলচ্চিত্র কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবি জানান তারা। এছাড়া ভবনটিকে ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা করে ক্রমশ একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করারও দাবি করে চলচ্চিত্রের এ সব ব্যক্তিরা বলেন, দেশ–বিদেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শন, গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে উত্তরবঙ্গে একটি ভিন্ন মাত্রার চলচ্চিত্র আন্দোলন এই প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠুক।
তারা বলেন, ঋত্বিক, সত্যজিৎ, মৃণাল সেনের মতো যারা একসময় এদেশে জন্মেছেন বা যাদের বসতভিটা এখানে ছিল, তারা দেশভাগ বা অন্য কারণে চলে গেছেন, কিন্তু সেগুলোকে রক্ষা করা, সেগুলোকে জাদুঘরের মতো গড়ে তোলা আমাদের সরকারের দায়িত্ব। পাশাপাশি বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য অপরিহার্য কৃতী সন্তানদের বসতভিটাও রক্ষা ও পরিচর্যার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারকে নিতে হবে। অসাধারণ প্রতিভাধর এই চলচ্চিত্রকার, থিয়েটারকর্মী ও গল্পকার-লেখক দেশবিভাগের শিকার হয়ে সারাজীবন খুব কষ্ট পেয়েছেন। আমরা তাকে আর অসম্মান করতে পারি না।বরং বাংলাদেশ সরকারের কর্তব্য তার বসত ভিটা উদ্ধার করে একটি স্থায়ী কেন্দ্র গঠন করার মধ্য দিয়ে তাকে সম্মানিত করা।
বিবৃতিতে বলা হয়, ঋত্বিক ঘটক শুধু বাংলা চলচ্চিত্র নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রেই এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের কারণে তাকে দেশত্যাগ করতে হয়েছে। কিন্তু দেশভাগকে তিনি কখনোই মেনে নেননি, উন্মূল হয়ে যাবার যন্ত্রণায় তিনি ভুগেছেন সারাজীবন। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে তিনি নির্মাণ করেছেন অনন্য সব চলচ্চিত্র – ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবর্ণরেখা ও ‘কোমল গান্ধার’। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে মাতৃভূমিতে ফিরে এসে তিনি ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। সেই অর্থে তিনি বাংলাদেশেরও চলচ্চিত্রকার।
ঋত্বিক ঘটক জীবনের শুরুর সময়টা কাটিয়েছেন পৈত্রিক বাড়ি রাজশাহীতে। এই বাড়িতে থাকার সময় তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়েছেন। রাজশাহী কলেজ এবং মিঞাপাড়ার সাধারণ গ্রন্থাগার মাঠে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে নাট্যচর্চা করেছেন। ওই সময় ‘অভিধারা’ নামে সাহিত্যের কাগজ সম্পাদনা করেছেন ঋত্বিক। তাঁকে ঘিরেই তখন রাজশাহীতে সাহিত্য ও নাট্য আন্দোলন বেগবান হয়। এই বাড়িতে থেকেছেন ঋত্বিক ঘটকের ভাইঝি বরেণ্য কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী। এই বাড়ির ৩৪ শতাংশ জমি ১৯৮৯ সালে এরশাদ সরকার রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজকে ইজারা দেয়। বহু স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়ি। তাই স্বাভাবিকভাবেই এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।
বাড়িটিকে সংরক্ষণের দাবি নতুন নয়। রাজশাহীতে ক্রিয়াশীল ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র সংসদ, রাজশাহী চলচ্চিত্র সংসদ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ এই বাড়িটিকে উদ্ধার ও সংরক্ষণের দাবিতে তিন বছর আগেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায়নি।