চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক, সিনেমাটোগ্রাফার ও শিক্ষক মোহাম্মদ হোসেন জেমী। কলম্বিয়া কলেজ হলিউড থেকে ‘ব্যাচেলর আর্টস অব সিনেমা’য় গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। ১৯৯৬ সালে কলম্বিয়া কলেজের ‘স্টুডেন্ট অব দ্যা ইয়ার’ নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৪ সালে ‘বৈষম্য’ সিনেমায় সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া তিনি স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও বিসিটিআইসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ‘ডিজিটাল সিনেমা নির্মাণ থেকে প্রক্ষেপণ’ বিষয়ে পাঠদান করেন। এ বিষয়ের উপর তিনি একটি বইও লিখেছেন।
সম্প্রতি তিনি ‘কালচারাল ইয়ার্ড’র মুখোমুখি হয়েছেন। কথা বলেছেন তাঁর চলচ্চিত্র জীবন, চলচ্চিত্র নির্মাণ ও চলচ্চিত্র অঙ্গনের নানা বিষয় নিয়ে। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি ‘রোমান কবির’।
কালচারাল ইয়ার্ড: আপনার চলচ্চিত্র যাত্রার শুরুটা জানতে চাই।
মোহাম্মদ হোসেন জেমী: আশির দশকে ১৯ বছর বয়সে আমি আমেরিকা যাই। সেখানে ক্যান্সাস অঙ্গ রাজ্যের উইচিটা স্ট্যাট ইউনিভার্সিটিতে অ্যাভিয়েশন ম্যানেজমেন্টে ভর্তি হই। সেখানে ২ বছর পড়ি। কিন্তু সেটা আমার মাথায় ঢুকতো না। আমি সব সময় চলচ্চিত্রের উপর পড়াশুনা করতে চাইতাম। পরে সেটা নিয়েই আমি এগিয়ে গেলাম। আমার আশা ছিলো, একদিন হলিউডে যাবো। হলিউড ছিলো আমার স্বপ্নের জায়গা। আমি ১৯৯২ সালে হলিউডের কলম্বিয়া কলেজে অ্যাপ্লাই করলাম। সেখানে আমি স্কলারশিপ পেয়ে ১৯৯৬ সালে কলম্বিয়া কলেজ হলিউড থেকে ব্যাচেলর আর্টস অব সিনেমায় গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করি।
সেখানে পড়াশুনা করার সময় আমি বিভিন্ন টেলিভিশন ও ফিল্ম প্রডাকশনে প্রচুর কাজ করেছি। সে সময় আমি প্রডাকশন অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে কাজ করেছি। বিভিন্ন সময়ে প্রডাকশন ডিজাইনিং টিমে কাজ করেছি। অ্যাসিসটেন্ট ক্যামেরাম্যান ছিলাম। সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবেও কাজ করেছি। সে সময় আমি তিনটি শর্টফিল্ম নির্মাণ করেছি। আমার গ্রাজেুয়েশনের ফাইনাল ফিল্ম ‘লেট নাইট বিজনেস’ শর্টফিল্ম ১৬ মিলিমিটারে নির্মাণ করি। এ ছবি তৈরি করে কলম্বিয়া কলেজে ওই বছরে আমি ‘স্টুডেন্ট অব দ্যা ইয়ার’ হয়েছিলাম। সেটাই ছিলো আমার চলচ্চিত্রজীবনের শুরু। বাংলাদেশে এসে ভাবলাম যে, এখানে চলচ্চিত্র বানাতে গেলে হয়তোবা কেউ লগ্নি করতে রাজি হবে না। কারণ আমি নতুন। এ জন্য আমি ‘কীর্তনখোলা প্রডাকশন’ নামে টেলিভিশন প্রডাকশন কোম্পানি খুললাম। যেটা আমার এখনও আছে।
চিত্রনায়ক মান্নাকে নিয়ে জেমীর প্রথম সিনেমা ‘রাজধানী’
মোহাম্মদ হোসেন জেমী প্রথমে টেলিভিশনের জন্য নাটক বানানো শুরু করেন। তিনি টেলিভিশনের জন্য প্রচুর নাটক বানিয়েছেন। তাঁর খুব জনপ্রিয় নাটক ছিলো লোহার চুড়ি, দমন, অনাসৃষ্টি, খান বাহাদুরের তিন ছেলে, ঝিনুক নীরবে সহোসহ আরও অসংখ্য। এ সময় তিনি প্রচুর বিজ্ঞাপনচিত্র, ডকুমেন্টারি, টকশো, মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করেন। ২০০৩ সালে চিত্রনায়ক মান্নাকে নিয়ে নির্মাণ করেন প্রথম চলচ্চিত্র ‘রাজধানী’। এটি ছিলো তাঁরই লেখা ও পরিচালনায়। এ ছবির ফটোগ্রাফিও করেন তিনি। কীর্তনখোলা প্রডাকশনস’র ব্যানারে ছবিটি প্রযোজনা করেন জেমীর স্ত্রী লায়লা হোসেন মনি।
এখন পর্যন্ত ৭টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন মোহাম্মদ হোসেন জেমী। এর মধ্যে ৪টি কীর্তনখোলা প্রডাকশন ও বাকি ৩টি টিওটি ফিল্মস’র প্রযোজনায়। তাঁর পরিচালিত সিনেমাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাজধানী (২০০৩), হৃদয় থেকে পাওয়া (২০০৯), বাজাও বিয়ের বাজনা (২০১০), কিং খান (২০১১), ভালোবাসার লাল গোলাপ (২০০৯)। বর্তমানে তিনি একটি নতুন চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
কালচারাল ইয়ার্ড: নতুন সিনেমার কাজ কবে নাগাদ শুরু করবেন?
মোহাম্মদ হোসেন জেমী: আগামী এপ্রিলের মধ্যে নতুন সিনেমার কাজ শুরু করে দেবো আশা করি। এখন যেহেতু চলচ্চিত্রে মন্দা অবস্থা চলছে তাই খুব বুঝে শুনে পা দিচ্ছি। হুট করে পা দিলে তো হবে না। তবে আমি যেটা করছি, গতানুগতিক বাণিজ্যিক ছবি করবো না। আমি প্রথম থেকে যে ধারাটায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলাম, সেটি হচ্ছে বিকল্পধারার বাণিজ্যিক ছবি। আমি বিশ্বাস করি, সব ছবিই বাণিজ্যিক ছবি। কিন্তু আমার কন্টেন্টের উপস্থাপনাটা বিকল্পধারায়। এখানে কনভেনশনাল ওয়েতে যে বাণিজ্যিক ছবি হয়, আমি সেটা কখনোই করি না, কখনোই করবো না। যেটা করতে যাচ্ছি এটা আরও বিকল্পধারা, তবে আমার টার্গেট ম্যাস পিপল। এই তথাকথিত পুতুলের জন্য আমি ছবি বানাবো না।
জেমী সম্পর্কিত আরও খবর
⇒ মান্না অত্যন্ত ত্যাগী শিল্পী ছিলেন: মোহাম্মদ হোসেন জেমী
কালচারাল ইয়ার্ড: আমাদের দেশে বাণিজ্যিক ধারা আর বিকল্পধারা যে বিভাজন এর মধ্যকার দ্বন্ধটা কোথায় বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ হোসেন জেমী: আমাদের দেশে এই বাণিজ্যিক ধারা, বিকল্পধারা বিভাজনটা তৈরি করে ফেলেছে মানুষজন। প্রথমত এখানে যেটাকে আর্ট ফিল্ম বা বিকল্পধারা বলা হয়, এটা মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের বানানো একটা শব্দ। আসলে প্রতিটি ছবির মধ্যেই আর্ট বা শিল্প আছে। প্রতিটি নির্মাতাই নিজের মতো করে শিল্পের সমাহার সেখানে ঘটান। হলিউডে একটা কথা আছে- সিনেমা ইজ অ্যা কমপ্লেক্স মিক্সড অব আর্ট অ্যান্ড বিজনেস। অর্থাৎ এটা আর্ট ও বাণিজ্যের একটা জটিল মিশ্রণ। শুধু বাণিজ্য বলে চিৎকার করলেও শিল্প হবে না, আর শুধু এটাকে শিল্প শিল্প বললেও ছবি হবে না। এখন পর্যন্ত পৃথিবীখ্যাত যত ছবি আছে, সেগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সেখানে শিল্পেরও সমাহার আছে, সেখানেও বাণিজ্যিক উপকরণ আছে। প্রত্যেকটা ছবিই বাণিজ্যিক ছবি। কেননা যে ছবিটা বানিয়ে কোন সিনেমা হলে না দেখিয়েও যদি পাবলিক লাইব্রেরিতে হল ভাড়া করে ২০ টাকা ৩০ টাকা টিকেটের বিনিময়ে দেখানো হয়, সেখানেও তো বাণিজ্য জড়িত। আর যে ছবিটা ৮০-৯০টা হলে মুক্তি পায় সেখানেও বাণিজ্য জড়িত।
মেকিংয়ের কারণে বিকল্পধারা, মুক্তির কারণে বাণিজ্যিক
মোহাম্মদ হোসেন জেমী মনে করেন, কলকাতাভিত্তিক বুদ্ধিজীবিদের কথায় লাফিয়ে এক শ্রেণির মানুষ বলেছে আমরা বিকল্পধারা। তিনি বলেন, এই বিকল্পধারা বলে এখন পর্যন্ত তারা কোন ধারাকে প্রতিষ্ঠা করেছে আমি জানি না। তবে আমি যেটা মনে করি, মূল যে কন্টেন্ট তার উপস্থাপনা যদি আলাদা হয়, তাহলে সে বলতে পারে তার মেকিং ধারাটা আলাদা। যেমন আমি বলি, আমার সিনেমা বিকল্পধারার বাণিজ্যিক ছবি। বিকল্পধারা বলি আমার মেকিংয়ের কারণে, আর বাণিজ্যিক ধারা বলি আমার মুক্তির কারণে, আমার পরিবেশনার কারণে। আমি চাই আমার ছবিটা প্রচুর হলে চলুক। আমি বিভিন্ন অডিটোরিয়াম ও পাবলিক লাইব্রেরিতে আমার ছবিটা দেখাবো এই নীতিতে বিশ্বাসী না। এটা আমার ব্যাক্তিগত অভিমত।
কালচারাল ইয়ার্ড: সিনেমাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
মোহাম্মদ হোসেন জেমী: আমার মতে গল্পের ধারাটা দুইভাবে বিভক্ত। একটা হচ্ছে রিয়েলিজম, আর একটা হচ্ছে ফরমালিজম। যদি ফরমালিজম বলি সারাবিশ্বে যেটা হচ্ছে মূলধারার ছবি। অর্থাৎ সেখানে একটা ফরমুলা থাকে, অ্যাকশন থাকে, কমেডি থাকে, ড্রামা থাকে। যে জনরায় ছবি করি না কেন এর একটা ফরমুলা থাকে। ছবির শুরু থাকে, মিডল থাকে, শেষ থাকে। ক্লাইমেক্স থাকে, এরপর বিগিনিং ক্লাইমেক্স থাকে। এভাবে একটা ফরমুলার মধ্যে ছবিটা তৈরি হয়। আর আমি যদি বলি রিয়েলিজম। এটি হচ্ছে অত্যন্ত বাস্তবতার কাছাকাছি। অর্থাৎ জীবনমূখী যেগুলো। রিয়েলিজমকে আরও শিল্পসম্মত ও আবেগমন্ডিত জায়গায় যখন নিয়ে যাওয়া যায়, সেটি হচ্ছে সুররিয়ালিজম। সুররিয়ালিজম প্রভাবিত হয় ডাডাইজম দ্বারা। ডাডাইজম সেই ৩০ এর দশক, ৪০ এর দশকে শিল্পের উপর একটা দারুণ প্রভাব ফেলেছিলো, যেটা কিনা প্যারিসকেন্দ্রিক আর্টিস্টদের একটা মুভমেন্ট ছিলো। যেটা পরবর্তীতে চলচ্চিত্রে এসে প্রভাব ফেলেছে।
সুররিয়ালিজম, ডাডাইজমের প্রতি আমার খুব দুর্বলতা ছিলো সবসময়ই। এই ধারাকে আমি সবসময় বাণিজ্যিক ধারার সঙ্গে মিশ্রণ করার চেষ্টা করেছি। এর শিল্পসম্মত উপস্থাপন থাকবে আমার ছবিতে। কিন্তু এর উপস্থাপনটা হবে বাণিজ্যিক ধারায়। আমি এমন কিছু করবো না যেটা, দর্শকদের মাথার উপর দিয়ে যায়। আবার এমন কিছুও করবো না যেটা দর্শক দেখে না। শিল্পের যদি প্রচার না হয়, তবে সেই শিল্পীর শিল্প কতটুকু মূল্যায়ন হয়- আমি এ ব্যাপারে সন্দিহান।
দর্শকদের হলে ফেরাতে রুচিসম্মত গল্প দিতে হবে
কালচারাল ইয়ার্ড: চলচ্চিত্রের যে মন্দা অবস্থা চলছে এখন এতে বিকল্পধারার বাণিজ্যিক ছবি নির্মাণের মধ্য দিয়ে এ সংকট কাটবে কিনা?
মোহাম্মদ হোসেন জেমী: বাংলাদেশের দর্শকদের চলচ্চিত্রের উপর একটি বিতৃষ্ণা চলে এসেছে। তারা হলে যায় না। ভালো ছবিও দেখে না। খারাপ ছবিও দেখে না। ভালো ছবির কথা শুনে, কিন্তু দেখে না। চলচ্চিত্রের মন্দা অবস্থা একদিনে হয় নি, দীর্ঘদিন একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটা ক্রান্তিকালের মধ্যে এসে পড়েছে। একটা দুইটা স্টাইলে আসলে ভালো করা যাবে না। দর্শকদের ফিরিয়ে আনতে হলে তাদের রুচিসম্মত গল্প দিতে হবে। এদেশে তামিল, তেলেগু, মালয়ালাম, কান্নাড়ার নির্লজ্জ নকল বন্ধ করতে হবে। এ সব ছবি মানুষ দেখতে চায় না। নকল ছবি বন্ধ করে অতি শীঘ্রই আমাদের মাটির গল্প, আমাদের নিজস্ব মৌলিক গল্প এগুলো দিয়ে ছবি তৈরি করতে হবে। তাহলে যদি দর্শক ফিরিয়ে আনা যায়।
(চলবে…..)