চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক, সিনেমাটোগ্রাফার ও শিক্ষক মোহাম্মদ হোসেন জেমী সম্প্রতি কালচারাল ইয়ার্ড’র মুখোমুখি হয়েছিলেন। কথা বলেছেন তাঁর চলচ্চিত্র জীবন, চলচ্চিত্র নির্মাণ ও চলচ্চিত্র অঙ্গনের নানা বিষয় নিয়ে। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি ‘রোমান কবির’। ইতোমধ্যে মোহাম্মদ হোসেন জেমীর সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব কালচারাল ইয়ার্ডে প্রকাশিত হয়েছে। আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব।
কালচারাল ইয়ার্ড: বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতি বছর অনেক ছাত্র-ছাত্রী বের হচ্ছে। যারা অনেকে ইনডিপেন্ডেন্টলি কাজ করছে। কেউ কেউ ইন্ডাস্ট্রিতে আসছে। অনেকেই আবার অন্য পেশায়ও চলে যাচ্ছে। যারা আছে এ পেশায়, ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?
মোহাম্মদ হোসেন জেমী: বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রথম স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি শুরু করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র ডিপার্টমেন্ট শুরু করার আগে থেকে আমি জড়িত। আমরা দু’জন লোক আমি ও জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির ড. আফসার আহমেদ মিলে ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া ডিপার্টমেন্ট এর কাগজপত্র রেডি করি। কোর্স কারিকুলাম তৈরি করেছি। ইউজিসি গ্র্যান্ড কমিশনে জমা দিয়েছি ও অ্যাপ্রুভ করিয়েছি। এর প্রথম দিনের প্রথম ক্লাস আমি নিয়েছি। স্ট্যামফোর্ডে নিয়মিত ও অনিয়মিতভাবে আমি শিক্ষকতা করেছি। এরপর এলো বিসিটিআই। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট ২০১৩ সালে ওপেন হয়েছে। সেটিরও শুরু থেকে নীতি নির্ধারক কমিটি, সিলেবাস কমিটি, এই কমিটি, ওই কমিটিতে ছিলাম। বছরের পর বছর আমরা ফিল্ম আর্কাইভে বসে মিটিং করেছি। এগুলোর সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। এর যাত্রা শুরু হলো। কিন্তু স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি যেটা দেখলাম, বিসিটিআই একই কাজ করেছে। এটাকে আমি আর ফিল্ম ইনস্টিটিউট বলবো না।
বিসিটিআইতে হাতে গোনা ২-১ জন বাদে চলচ্চিত্রের কোন শিক্ষক নেই
বিসিটিআইতে হাতে গোনা ২-১ জন বাদে চলচ্চিত্রের কোন শিক্ষক নেই। যারা আছেন তাদের টেলিভিশন ব্যাকগ্রাউন্ড। চলচ্চিত্রের যারা অভিজ্ঞ ব্যাক্তি, যাদের এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আছে; তাদের সেখানে কোন জায়গা নেই। চলচ্চিত্র অধ্যয়নের চেয়ে সেখানে এত বেশি রাজনীতি চলে এবং যে যার ক্ষুদ্র চেয়ারটি চিরস্থায়ীভাবে দখল করে রাখার জন্য যত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। যদি এরা ছাত্রদেরকে পড়াশুনার ব্যাপারে আরও বেশি ধ্যান দিত, তাহলে আমার মনে হয় ছাত্রদের মঙ্গল হতো। কিন্তু এখন চিত্রটা এত ভয়াবহ! যার কারণে যারা পাশ করে বের হয়, যেখানে স্ট্যামফোর্ডে দেখেছি অনেকে ফাইনাল পরীক্ষা-ই দেয় না। কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে, হতাশ হয়ে যাচ্ছে। কেউ মূল ধারার ছবির সাথে সম্পৃক্ত হতে পারছে না। মূল ধারা বাদ দিলাম। তথাকথিত যে বিকল্পধারা সেখানেও যে কেউ কিছু করে দেখাতে পেরেছে, আমি এখন পর্যন্ত তার কোন প্রমাণ পাইনি।
শুধু একটা কথা শোনা যায়, এফডিসি একটি সিন্ডিকেট, এফডিসিতে ঢোকা যায় না। এখানে কাজ করা যাবে না। আমরা পারবো না। কেন পারবা না? কবে কে এফডিসিতে এসে কাজ করতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কেউ তো বাধাগ্রস্থ হয় নাই। মূল কথা হচ্ছে যে, একজন লোক নিজ যোগ্যতায় প্রডিউসার যোগাড় করে যে ছবি শুরু করবে, এখনও তো এরকম কাউকে দেখি না। এর জন্য দায়ী মূল সিলেবাসের জায়গাটিতে। যে সব সিলেবাস স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও বিসিটিআইতে আছে, তার অর্ধেকেরও বেশি আছে; যার কোন কিছুরই বাস্তব জীবনে কোন কাজে লাগে না।
এতো তথ্যগত জিনিস পড়ানোর কোন কিছু নাই। এতো ইতিহাস, আকাশ-বাতাস পড়ানোর কিছু নাই। এখন ডিজিটাল তথ্য প্রযুক্তির যুগ। এখন ছাত্রদেরকে মূল শেখাতে হবে। মূল নির্মাণ ও কারিগরি জায়গায় মন দিতে হবে। অবশ্যই এর এসথেটিক জায়গায়ও এদের তৈরি করতে হবে। কিন্তু এই দুই জায়গায় তৈরি করতে গিয়ে এতো অহেতুক জিনিস পড়ানো হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে যারা ওখানে পড়ায় এতো সীমিত গন্ডির ভেতরে তাদের জ্ঞান যে, তার বিষয়টি সব সময় এম্পোজ করে। কারণ সেই সাবজেক্টটাই সে বেশি জানে। এই করে করে ছেলেপেলেদের প্রচুর সময় নষ্ট করা হচ্ছে।
আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করা হচ্ছে
এ সব সিলেবাসগুলি যুগোপযোগী না। এই সিলেবাস কোন কাজে লাগে না। এর সাথে বহির্বিশ্বের সঙ্গে কোন মিল নাই। এই দুই প্রতিষ্ঠান পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউট দ্বারা খুব বেশি প্রভাবিত। পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউট অত্যন্ত পুরনো ধ্যান ধারণার একটা জায়গা। খোদ ভারতেই পুনা ফিল্মের কোন মূল্যায়ন নেই। পুরানো সনাতন পদ্ধতিতে ওখানে পড়ানো হয়। সেই পদ্ধতির সিলেবাস আবার এখানে বিভিন্ন প্রভাব খাটিয়ে ঢুকানো হচ্ছে। আমি মনে করি এভাবে ছাত্রদের পেশাগত জীবনের ভবিষ্যত নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। অন্ধকারে নিমজ্জিত করা হচ্ছে এদেরকে।
কালচারাল ইয়ার্ড: তত্ত্ব শেখার প্রয়োজনীয়তা নেই?
মোহাম্মদ হোসেন জেমী: এই পড়ে তাত্ত্বিক সমালোচক হতে পারবে। কিন্তু সমালোচক তখনই হয়, যখন ইন্ড্রাস্ট্রি ফুল ফ্রেসে রার্নিং অবস্থায় থাকে। যেখানে ইন্ডাস্ট্রির ক্রান্তিলগ্নে নতুন নির্মাতা দরকার। নতুন নতুন ইনোভেটিভ আইডিয়া দরকার। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জিং কন্টেন্ট দরকার। সেগুলোই যখন নাই তত্ত্ব দিয়ে কি হবে?
সত্তর ও আশির দশকে যখন রমরমা চলচ্চিত্র ব্যবসা ছিলো। তখন তাত্ত্বিকতার দরকার ছিলো, তাত্বিকদের দরকার ছিলো। যারা গঠনমূলক সমালোচনা করে তাদের দরকার ছিলো। এখন আরও তাত্ত্বিক বা সমালোচনা বানিয়ে তা দিয়ে কি হবে? এ দিয়ে চলচ্চিত্রের ভবিষ্যত কি হবে? এ সব অহেতুক বিষয়গুলো যে জায়গায় আছে, সব কাটডাউন করা উচিত। মূল চলচ্চিত্র শিক্ষা দেওয়া উচিত। এখানে যে রাজনীতি ও নিজের আসন পাকাপোক্ত করতে যে কূটকৌশল করা হচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিতাড়িত করা উচিত।
এরা ছাত্রদের ভবিষ্যত নষ্ট করছে। যার কারণে এখন বিসিটিআইতে ছাত্র পাওয়া যায় না। আমি যখন স্ট্যামফোর্ডে শিক্ষকতা শুরু করেছি, তখন ৩০০ প্লাস ছাত্র ছিলো। এখন ছাত্র পাওয়া যায় না। কারণ কেউ পড়তে আসে না। কয়দিন পর কান্নাকাটি করতে হবে। ডিপার্টমেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ মানুষ দেখে ফেলেছে, এখান থেকে পাশ করে কিছু্ই করতে পারছে না। কারণ তাদের যে শিক্ষা দেয়া হয়, তারা বাস্তব জীবনে এসে তা কাজে লাগাতে পারছে না। আমি এমনও জানি বিসিটিআই বা স্ট্যামফোর্ড থেকে গ্রাজুয়েট, (আমি নাম উল্লেখ করবো না) যারা এফডিসিতে কাজ করতে এসে ক্যামেরার ফোর্থ ফিফথ অ্যাসিসটেন্টদের কাছে টেকনিক্যাল কথা বলে বিব্রত হচ্ছে।
কালচারাল ইয়ার্ড: দেশে ডিজিটাল সিনেমার ভবিষ্যৎ কি ?
মোহাম্মদ হোসেন জেমী: বাংলাদেশে যে প্রক্রিয়ায় সিনেমা প্রদর্শন করা হয়, সেটা ইলেকট্রনিক সিনেমা। সেটা ডিজিটাল সিনেমা না। এটা অগণিতবার আমি বলেছি। এর সাথে সংশ্লিষ্টরা ভালো করেই বিষয়টি জানে। প্রকৃত অর্থে ডিজিটাল সিনেমা বা ডি সিনেমা পুরো পৃথিবীতে পুরান হয়ে গেছে। নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসে এটা ২০০২-০৩ সালে একটা আকার ধারণ করেছে। যখন ডিসিআই বা ডিজিটাল সিনেমা ইনিশিয়েটিভ তাদের টেকিনক্যাল স্পেসিফিকেশনে পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, জেপিইজি, জেটুআই ফরম্যাট ব্যবহার করতে হবে। টুকে ফরম্যাটে নির্মাণ ও প্রক্ষেপণ হতে হবে। এখন এটা সারা পৃথিবীতে একটা স্ট্যান্ডার্ড দাঁড়িয়ে গেছে।
এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যাতিক্রম বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখনও এই স্ট্যান্ডার্ন্ড মিট করতে পারেনি। এখনও এখানে নিন্মমানের প্রজেক্টর, এমনকি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ৬০-৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা দামের, এগুলো দিয়েও সিনেমা প্রদর্শন করা হয়। যেহেতু এর কোন মান নিয়ন্ত্রণ নেই। কোন প্রতিষ্ঠান নেই, যারা মান নিয়ন্ত্রণ করবে। এটার কোন বাপ-মা নেই! যে যার মতো করে করছে, কোন বাধা নেই। এই ধরণের ডিজিটাল কোয়ালিটি দেখতে গিয়ে দর্শক বিরক্ত হয়ে গেছে। ছবি ঝাপসা, শব্দ ভালো না, পিক্সেল ফেটে যাচ্ছে। এর যে অরজিনাল কালার, সেই কালারটাকে রিপ্রডাকশন করা যাচ্ছে না। এর পিছনে মূল কারণ প্রক্ষেপণ। যেহেতু এর কোন মান নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
ইতোমধ্যে পৃথিবীর সব চলে যাচ্ছে লেজার টেকনোলজির দিকে। আর কয়দিন পরে এই ডিজিটালও পুরনো হয়ে যাবে। সেটাই এখন পর্যন্ত আমরা চালু করতে পারি নি। চালু করতে না পারার পেছনে বড় কারণ হচ্ছে অশিক্ষা। বড় কারণ হচ্ছে, যে সে বিষয়ে যোগ্য না, তাকে সেই আসনে বসিয়ে দিয়ে, সেই কর্ম পালন করা হচ্ছে। যে লোকটা ডিজিটাল সম্পর্কে কিছুই জানে না, তাকে সেখানে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্ট্যামফোর্ড, বিসিটিআই এর মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও তাদেরকে সেই জায়গাগুলোতে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাতে করে মান নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তাই আমি এ জায়গায় অন্ধকার ভবিষ্যত দেখছি।
আরও পড়ুন : মান্না অত্যন্ত ত্যাগী শিল্পী ছিলেন: মোহাম্মদ হোসেন জেমী
প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিলেই চলচ্চিত্রে পরিবর্তন আসবে
যদি আমাদের চলচ্চিত্রবান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর যোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা এ বিষয়ে নিজ হাতে উদ্যোগ নেয়। তিনি যদি চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সবাইকে ডেকে অর্থ বরাদ্দ করে। প্রত্যেক হলে শতভাগ ডিজিটাল প্রক্ষেপণের ব্যবস্থা করে। আপতত মূল ধারার ছবিগুলোকে অনুদান দিয়ে নতুন নতুন কন্টেন্টকে অনুপ্রেরণা দেয়। যে সব ছাত্র-ছাত্রীরা চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশুনা করে বের হয়, তাদের অনুদান দিয়ে কিংবা প্রণোদনার ব্যবস্থা করে। এ সব ছেলেমেয়েরা শুরুতে প্রডিউসার পায় না। এদেরকে অনুদান দিয়ে বছরে ৬-৭ টা ছবি নির্মাণ করা হোক। এখানে এ জন্য কমিটি থাকবে। এরা শুধু এই নতুনদের জন্য কাজ করবে। আর ইন্ড্রাস্ট্রির জন্য ভিন্ন অনুদান দেবে। দুই বছর যদি এভাবে আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া যায়, তবে চলচ্চিত্রে একটা পরিবর্তন আসবে।
কালচারাল ইয়ার্ড: সম্প্রতি প্রডিউসার বা ডিরেক্টর কাউন্সিলের নির্বাচন হলো। এই দুই সমিতি মিলে এ জন্য কি কোন উদ্যোগ নিচ্ছে কিনা?
মোহাম্মদ হোসেন জেমী: সমিতিগুলো এ নিয়ে কাজ করছে। প্রযোজক ও পরিচালক সমিতি একাধিকবার এ নিয়ে বৈঠক করেছে। বেশকিছু পরিকল্পনা তারা করেছে। এগুলো বাস্তবায়ন হতে হয়তো সময় লাগবে। তবে চোখে পড়ার মতো কিছু নেই এখনও। কিছুদিন আগে এ দুটি সমিতির যৌথ উদ্যোগে নির্মাতাদের নিয়ে একটা ওয়ার্কশপ হলো। এটা একটা ভাল লক্ষণ। আগামীতে আরেকটি ওয়ার্কশপ করার পরিকল্পনা চলছে। আমি এ নিয়ে একটি জোর দাবি জানিয়েছি।
কালচারাল ইয়ার্ড: আপনাকে ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ হোসেন জেমী: আপনাকে ও কালচারাল ইয়ার্ডকে ধন্যবাদ।
প্রথম পর্ব: আমার ছবি বিকল্পধারার বাণিজ্যিক ছবি : মোহাম্মদ হোসেন জেমী