সম্প্রতি কালচারাল ইয়ার্ডের মুখোমুখি হয়েছিলেন বাংলাদেশী-আমেরিকান চলচ্চিত্র নির্মাতা রাজেশ আল-রাশেদ । দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র শিক্ষার নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি ‘রোমান কবির’।
(প্রথম পর্বের পর)
আমাদের এখানে যারা ফিল্ম পড়ে সবাই ডিরেক্টর হতে চায়। তাহলে ডিরেক্টর কাজ করবে কাকে নিয়ে? কেউ তো একটর হতে চাচ্ছেনা, এডিটর হতে চাচ্ছেনা, সাউন্ডে কাজ করতে চাচ্ছেনা। আমাদের ওয়ার্কশপের আরেকটা ফোকাস ছিলো শিক্ষার্থীদের বোঝানো যে, তারা চলচ্চিত্রের কোন ডিপার্টমেন্টে কাজ করতে চান? যা করতে চান সেই রিলেটেড যে কোর্সগুলো হবে সেগুলো করেন। সব কোর্সের ভেতরে যদি তারা যায়, সব কথা যদি শুনে তাহলে তাদের একাডেমিক কনসেনট্রেশন থাকবেনা, স্পেশালাইজেশায়ন কোনো দিনও গ্রো করবেনা। ফিল্মের এডুকেশনে এখানকার ছাত্ররা লস্ট, তারা আসলে বুঝেনা তাদের কোনটা দরকার, কতটুকু দরকার। বিভিন্ন টিচারদের কথা শুনে তারা কনফিউসড। এ জন্য নিজেদেরকেই ঠিক করতে হবে যে সেই কোর্সগুলোই করবো যেগুলো তাদের ফিল্ডের সাথে রিলেটেড। পরবর্তী ধাপটা হলো সবই শুনবে, কিন্তু মোর ইম্পর্টেন্ট বিষয়গুলোই প্র্যাকটিস করতে হবে। অনেক স্টাডি করতে হবে।
কালচারাল ইয়ার্ড: হলিউড বেসড ফিল্মস আর ইনডিপেন্ডেন্ট ফিল্মস বিষয়গুলো আমেরিকার ফিল্ম স্কুলগুলো কিভাবে দেখে?
রাজেশ আল-রাশেদ: “টোটাল কনসেপ্ট”- যে আমেরিকার ক্ষেত্রে কতটুকু প্রযোজ্য সেটা আমি একটু বলতে চাই। এই প্রশ্নটাই যদি আমেরিকার কোন প্রফেসরকে করেন তিনি এই প্রশ্নটা বুঝার জন্য অনেক ভাববেন। আমি বুঝতে পেরেছি, তিনি বুঝবে না এই কারণে, যে ইনডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম মেকিং আর হলিউডের বা স্টুডিও বেসড ফিল্মমেকিংয়ের মধ্যে কারও ফিল্ম শেখার সম্পর্কটা কই? আপনার কাজটা কি আপনি স্টুডিওতে করবেন নাকি বাইরে করবেন এটা আপনার ব্যাপার। আপনি তো শিখবেন কিভাবে ডিরেকশন দিতে হয় এবং সিনেমাটা বানাতে হয়।
ওয়াইড ডিস্ট্রিবিউশন পেলে তখন ছবিটা মেইনস্ট্রিম সিনেমা আর না পেলে ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা, তবে লিমিটেড থিয়েট্রিক্যাল রিলিজ হলেও হলে বা ফেস্টিভ্যালে রিলিজ করতে হবে বা স্টিমিংয়ের জন্য থাকলে হবে, না হলে আর ফিল্ম বানিয়ে লাভ কি যদি দর্শকই না দেখতে পায়। দর্শকের চাহিদায়ই চলচ্চিত্রের সফলতা।
হলিউড ও ইনডিপেন্ডেন্ট ফিল্মের প্রটোকল একাডেমিক্যালি সেইম
বর্তমান সময়ে সিনেমাটা বানানোর পর আপনার সিনেমা কোন ধরণের সিনেমা হলো এটা বলা এখন ক্রিটিকের দায়িত্ব। এই ধারাগুলোকে আলাদা আলাদা ভাবে পড়ানো হয়। তবে এটা ফিল্ম মেকিংয়ের অংশ না। এটা স্টাডির অংশ। ক্রিটিক বলবে এটা কোন ধরণের ছবি, যদিও আমি ‘ফ্রিডম অব আর্টিস্টিক এক্সপ্রেশন’ এ বিলিভ করি, আমি কোনো ছবিকে লেভেল বা ট্যাগ করাতে বিশ্বাস করিনা। দর্শক কেন অন্য কারও মতামতের ভিত্তিতে ‘প্রিজুডিস’ হয়ে ছবি দেখতে যাবে বা যাবে না, এটা ফিল্মের জন্য ভালো না। ‘অডিয়েন্স শুড নট বি ফোর্সড টু ওয়াচ এ ফিল্ম থ্রো এ পেইন্টেড গ্লাস অব এ ক্রিটিক’- আর্ট মাস্ট বি ফ্রি ফর ইনডিভিজ্যুয়াল ইন্টারপ্রেটেশন। ভিঞ্চি যখন মোনালিসা আঁকছিলো তখন এটা কি ধরণের আর্ট, তা নিয়ে তার কোন মাথাব্যাথা ছিলনা। তার মেইন চিন্তা ছিলো সে মোনালিসাকে ঠিকমতো আঁকতে পারছে কিনা।
হলিউড স্টাইল আমেরিকার সব জায়গায় শেখানো হয়। তবে আমেরিকায় হলিউডের ইন্ড্রাস্ট্রির বাইরে ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম হচ্ছে। কিন্তু যারা বাইরে কাজ করছে তাদের প্রটোকল কিন্তু একাডেমিক্যালি সেইম। হলিউডকে বেসড করে যে ধারা তৈরি হয়েছে যাকে আমরা বলছি হলিউড ওয়েজ। এই ধারাকে ফলো করে ফিল্ম হচ্ছে, রিসার্চ হচ্ছে সারা বিশ্বে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বের হয়ে আপনি কি হলিউডের ছবি বানাবেন নাকি ঢালিউডের ছবি বানাবেন এটা আপনার ব্যপার। ছবি বানানো টা বড় কথা, ধারা একটা ক্রিটিকরা দিয়েই দিবেন।
কালচারাল ইয়ার্ড: আমাদের এখানে মেইনস্ট্রিম ও বিকল্পধারার সিনেমার যে পার্থক্য করা হয়েছে সে ব্যাপারে কি বলবেন?
রাজেশ আল-রাশেদ: এ ব্যাপারটা আমেরিকাতেও আছে। সেখানে ইনডিপেন্ডেন্ট ফিল্মগুলো কম বাজেটে তৈরি হয়। তবে ওরা আমাদের মত এভাবে চিন্তা করেনা। ওরা চিন্তা করে যে আমার এ ছবি যেহেতু লো বাজেটে করা। এখানে আমার ডিস্ট্রিবিউশনও কম হবে। কম লোকে দেখবে। এমন লো বাজেট ছবিও আছে, যে ছবিটি থিয়েটারে রিলিজই হয়নি। ডিভিডিতে রিলিজ হয়েছে। এগুলো ১০০ মিলিয়নের উপরে আয় করেছে।
কালচারাল ইয়ার্ড: আমাদের দেশের সিনেমা এখন কি অবস্থায় আছে বলে মনে করেন?
রাজেশ আল-রাশেদ: আমি এখন পর্যন্ত যা দেখেছি আগের থেকে আমাদের ছবির কন্টেন্ট আরও গভীর হয়েছে, থটফুল হয়েছে। যেমন আগে এফডিসিতে যে ছবিগুলো তৈরি হয়েছে সেগুলো হলো একটি বিদেশী ছবির গল্প, যা মানুষের ভালো লাগে। এর একটা এন্টারটেইনমেন্ট ভ্যালু ছিলো। এখনও সেরকমই আছে। হতে পারে সেটার দর্শক আমরা না। কিন্তু এরপরও কিন্তু এই সব ছবির দর্শক আছে।
নব্বইয়ের দশকে প্যারালাল সিনেমার যে আন্দোলন বাংলাদেশে শুরু হয়েছিলো, সেটার সঙ্গে একসময় আমিও দর্শক হিসেবে জড়িয়ে পড়েছিলাম। সে সময় ‘চাকা’ বা ‘একাত্তরের যিশু’সহ আরও অনেক ছবি আর্টহাউজ ফিল্ম হিসেবে রিলিজ হয়েছিলো। তখন আমরা সে ধরণের সিনেমা দেখতে যেতাম। ওগুলো দেখার একটা ব্যাপার ছিলো। ওই ধরণের ছবিগুলোর আগের চেয়ে এখন দর্শক বেশি। সেগুলো শহরকেন্দ্রিক দর্শক হয়তো। তবে এগুলোর আগের তুলনায় দর্শক বেড়েছে। এখান থেকে প্রডিউসার টাকা পাচ্ছে। দুই একটা ছবি হিটও হয়ে যাচ্ছে। এগুলো আমাদের ফিল্মকে রিচ করেছে।
আরও পড়ুন : আমার ছবি বিকল্পধারার বাণিজ্যিক ছবি : মোহাম্মদ হোসেন জেমী
কিন্তু ক্রাফটের দিক থেকে উন্নতির অনেকখানি যাওয়া বাকি আছে। আপনি ভালো স্ট্যাটমেন্ট দিতে পারবেন। কিন্তু ভালো স্ট্যাটমেন্টকে ভালোভাবে রিপ্রেজেন্ট করার দুটি উপায় আছে। একটা হলো আপনি বললেন সেটাই বড়। সেটা নিয়ে যদি আপনি সন্তুষ্ট হতে চান হতে পারেন। আর আপনি যদি বলেন আমার এই স্ট্যাটমেন্ট নিয়ে আমি আরও বেশি দর্শকের কাছে যাবো, আরও বেশি রিপ্রেজেন্টেবল করবো, আরও বেশি ওয়ার্ল্ড সিনেমার কোয়ালিটির কাছাকাছি পর্যায়ে যাবো, তাহলে আপনাকে আরও বেশি কোয়ালিটির দিকে যেতে হবে। কোয়ালিটি আনার জন্য স্কিল লাগবে। এবং টেকনোলজির প্রপার ইউজটা লাগবে। টেকনোলজি মানে সিজিআই না বা ভিজুয়্যাল এফেক্ট না। টেকনোলজি মানে আমার লাইটিংটা যাতে প্রোপার হয়। যেন প্রোপার ফিল্টারটা ইউজ করি, ক্যামেরাটা যেন ডিএসএলআর বা এমেচার ক্যামেরা না হয়। এটা যেন একটি প্রফেসনাল ফিল্মের ডিজিটাল ক্যামেরা হয়। কোয়ালিটির দিকে তাকাতে হবে। এই কোয়ালিটি অর্জন করাটা কিন্তু খুবই কঠিন। সেই জায়গায়টা শিক্ষার দরকার আছে।
আমাদের দেশে ফিল্মের ক্রু তৈরি করতে হবে
একজন ফিল্ম মেকারকে ফুল ক্রু সাপোর্ট দিতে হবে। এ জন্য আমাদের দেশে ক্রু তৈরি করতে হবে। কে এডিটিং সাপোর্ট দিবে, কে প্রডাকশন ডিজাইন করবে, কে সিনেমাটোগ্রাফি করবে, পুরো ক্রু সাপোর্ট তৈরি করতে হবে। এমনভাবে ছবিটা তৈরি হবে যেটা পলিশড হয়। যেটা বাইরে বিক্রি হবে। যা বিদেশীরা দেখতে চাইবে।
কালচারাল ইয়ার্ড: আমাদের দেশে চলচ্চিত্রকে এখনও ফুল প্রফেশন হিসেবে নেওয়া যাচ্ছেনা। আপনার মূল্যায়ন?
রাজেশ আল-রাশেদ: আমরা কেন জানি ফিল্ম নিয়ে খুব বেশি ফিলোসফি চাই। তবে এর আর্ট ভ্যালুর সাথে সাথে এর যে একটা বাণিজ্যিক ভ্যালু থাকা উচিত এটার দিকে আমরা খুব বেশি নজর দেই না। যদি আপনার ফিল্ম আপনাকে টাকা দেয়। কিংবা আপনার ফিল্মের যদি রিটার্ন আসে তাহলেই কিন্তু আপনি আপনার সিনেমাটা বানাবেন। আর না হলে বাড়ি ঘর বিক্রি করে একটা ফিল্ম বানাবেন। আপনার দুরাবস্থা দেখে আপনার দশজন বন্ধু আর সিনেমাতে আসতে সাহস পাবেনা। তাই আমাদের চিন্তা করতে হবে সিনেমা থেকে আমাদের রিটার্ন আসার জন্য কি করার দরকার। সে জন্য চিপ এন্টারটেইনমেন্টের দরকার নেই। এ জন্য দর্শককে অ্যট্রাক্ট করতে হবে। অ্যট্রাক্ট করার জন্য চিপ হওয়ার দরকার নেই। এরকম অনেক ছবি বাংলাদেশে আছে, যেমন ‘দেবী’ সিনেমাটা দেশে অনেক চলেছে। এ ছবিতে তো কোন চিপ এন্টারটেইনমেন্ট নেই। দর্শক তো ছবি দেখেছে, পয়সাও তো ফেরত এসেছে।
ভালো ছবি তৈরির জন্য স্কিল এর সাথে টাকাও লাগে। আর এটাকে প্রফেশনালি ধরে রাখার জন্যও লাগে টাকা। টাকা আনার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি অনুদানের টাকা দিয়ে পৃথিবীর কোথাও কোনো ইন্ড্রাস্ট্রি টিকেনি। এটা আমার কথা না, ইতিহাস বলছে। প্রতি বছর সরকার যদি ২০টা ছবির টাকাও দেয় তাহলে ২০টা ছবিই হবে। এটা ইন্ডাস্ট্রি হবে না। ইন্ডাস্ট্রিকে দাঁড়াতেই হবে। তাহলেই এটি একদিন বড় হবে, শ্বাস-প্রশ্বাস নিবে। যতদিন একে ইনকিউবেটরের ভেতরে রাখবেন ততদিন এ ভূমিষ্টই হবে না।
প্রথম পর্ব : ফিল্ম স্টাডিজ ও ফিল্ম মেকিং দুটি ভিন্ন জিনিস : রাজেশ আল রাশেদ