টেলিভিশন নাটকের জনপ্রিয় নির্মাতা সকাল আহমেদ। তিনি প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে টেলিভিশন নাটক নির্মাণ করছেন। নাটাই, কারিগর, একজন রজব আলী, অপেক্ষা, প্রতীক্ষা, জোছনায় পড়েছে দাগ, আলো ও আধারসহ অসংখ্য এক ঘন্টার খন্ড নাটক নির্মাণ করেছেন। নির্মাণ করেছেন টার্মিনাল, মেঘবন্ধু, বাবুই পাখীর বাসা, ফুলমহল, শান্তিপুরীতে অশান্তি, ভদ্রপাড়া ও খান বাড়ী বাড়াবাড়িসহ অনেক মেগা ধারাবাহিক। টেলিভিশন নাট্যপরিচালকদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ডের সহ-সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯-এর কারণে গৃহবন্দী হয়ে পড়েছেন সময়ের এই ব্যস্ত নির্মাতা। এ সময়ে কালচারাল ইয়ার্ডের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। কথা বলেছেন বর্তমান সময়ে নাটক ও সংস্কৃতির নানা বিষয় নিয়ে।
কালচারাল ইয়ার্ড : করোনাকালীন সময়ে আপনার জীবনাচরণ ও জীবনবোধ সম্পর্কে জানতে চাই।
সকাল আহমেদ : করোনাকালীন সময়ে পুরো দেশবাসীর মতো গত তিন মাস গৃহবন্দী অবস্থায় ছিলাম। মার্চে আমরা শুটিং করছিলাম, এর মধ্যে বাংলাদেশে পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করেছে। ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী ধরা পড়ে বাংলাদেশে। সে সময় আমি পুবাইলে ছিলাম শুটিংয়ে। ১৮ মার্চ পর্যন্ত শুটিং করেছি। এরপর সব বন্ধ করে দিয়েছি। ১৯ মার্চ থেকে আমি বাসায় পুরোপুরি লকডাউনে আছি। সে সময় থেকে পরিবারের সাথে আছি, আমার আড়াই বছর বয়সী একটি ছেলে ও স্ত্রীর সাথে। বাবা-মা আছেন নারায়নগঞ্জে।
হোম কোয়ারেন্টিন সময়ে প্রথম থেকেই প্রতিদিন নিউজের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করেছি। প্রতিদিন টেলিভিশন ধরে বসে থাকতাম। কোথায় কি হচ্ছে, করোনার কি অবস্থা। সবকিছু নিয়ে আপডেট হওয়ার চেষ্টা করতাম। পরিবারকে সময় দিতাম, বাচ্চাকে সময় দিতাম। একটা পর্যায়ে গিয়ে টেলিভিশন দেখাটা আস্তে আস্তে বন্ধ করে দিলাম। কারণ নিউজ দেখতে দেখতে মনের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করতো, মনের মধ্যে প্রেসার তৈরি হতো। এরপর থেকে নিউজ দেখার চেয়ে বরং ছেলেকে বেশি সময় দিয়েছি। ছেলে খুবই ছোট, কিন্তু তাকে নানা কিছু শেখানোর চেষ্টা করেছি। স্ত্রীকে ঘরের কাজে হেল্প করেছি, মাঝে মাঝে খুব ভয়ে ভয়ে বাজারে যেতাম। এরকম জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে করোনাকালীন লকডাউনের সময় কেটেছে।
করোনাকালীন পরিস্থিতি নিয়ে নির্মাতাদের ভাবনা
⇒ এখনই শুটিং শুরু করছি না : মাবরুর রশীদ বান্নাহ
জীবনবোধের যে ব্যপারটা সেটা হচ্ছে, অন্যরকম একটা জীবন কেটেছে এবং কাটছে। এটা আসলে জীবনকে অনেক কিছু শেখাচ্ছে। আমরা যে প্রকৃতির কাছে তুচ্ছ, আমরা যে সব কিছু ভুলতে বসেছি। আমরা যে অরাজকতা, দুর্নীতি, মিথ্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম, সে জায়গা থেকে করোনা ভাইরাস আমাদের বিশেষ করে মনুষত্ব্যের জায়গায় একটা উপলব্ধি নিয়ে এসেছে। সেখান থেকে মনে হয়েছে যে, আমরা আসলে সুস্থ স্বাভাবিক ছিলাম না, আমরা একটা অসুস্থ জীবনযাপন করছিলাম। সেই সুস্থ জীবনে ফেরার জন্যই হয়তোবা সৃষ্টিকর্তা এই ভাইরাস পাঠিয়েছেন।
কালচারাল ইয়ার্ড : করোনা ভাইরাস মহামারি বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত। এই সময়ে চলচ্চিত্র বা নাটক কি ধরণের ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন?
সকাল আহমেদ : চলচ্চিত্র বা নাটক তো সবসময়ই ভূমিকা রাখে। আমরা নাটকের মাধ্যমে সমাজের নেগেটিভিটি দূর করে, পজিটিভিটি দেওয়ার চেষ্টা করি। এই কাজটা সমাজের দায়বদ্ধতা থেকে আমরা করি। এখন এই যে মহামারির সময়ে মানুষ ঘরে বসে তার প্রিয় চলচ্চিত্র দেখেছে বা নাটক দেখেছে। এটাও একটা বড় ভূমিকা চলচ্চিত্রের বা নাটকের। কারণ এ সময়ে নিজেকে তার প্রিয় চলচ্চিত্র বা নাটকের মাধ্যমে বিনোদিত রাখতে পারছে।
এছাড়া এ সময়ে আমাদের তারকারা বিভিন্নভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভ করছে, মানুষকে সচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করছে। সাধারণ মানুষ তার পছন্দের তারকাদের কথায় যদি উদ্বুদ্ধ হয়, সেখান থেকে মানুষ উপকৃত হতে পারে। সেটাও আমাদের চলচ্চিত্র ও নাটকের ইন্ডাস্ট্রির একটা বড় ভূমিকা বলে আমি মনে করি।
কালচারাল ইয়ার্ড : লকডাউন খুলে গেছে। এ পরিস্থিতিতে কি কোন কাজ করার পরিকল্পনা আছে। করোনা পরবর্তী কাজের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই।
সকাল আহমেদ : জুনের ১ তারিখে বেসিক্যালি আমাদের শুটিং হয়েছে। অনেকে শুটিং করছে, পুবাইলে শুটিং হচ্ছে, উত্তরায় শুটিং হচ্ছে। আমার দুটো সিরিয়াল রানিং ছিলো। একটা একুশে টেলিভিশনে খান বাড়ি বাড়াবাড়ি ও বাংলাভিশনে ভদ্রপাড়া। জুনের ১৫ তারিখ থেকে আমি খান বাড়ি বাড়াবাড়ি সিরিয়ালের শুটিং শুরু করবো। এ নিয়ে প্লানিং করছি, গোছাচ্ছি।
করোনাকালে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ভাবনা
⇒ ‘শুটিং না করে ঘরে থাকার নীতিতে অটল থাকার কোনো বিকল্প নেই’
আমরা সামাজিক ডিসটেন্স তথা সকল ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুটিং শুরু করবো। সবাইকে বলে দিচ্ছি যে, সবার যেন তাদের একান্ত ব্যবহারের জিনিসগুলো যেমন, খাবারের প্লেট, কফি খাওয়ার মগ; এগুলো নিজেরা বাসা থেকে নিয়ে আসে। নিজেরা এগুলো নিজেদের দায়িত্বে রাখে। খাবার পর নিজেদের প্লেট, মগ ধুঁয়ে রাখে। এছাড়া নিজেরা পরিচ্ছন্ন থাকবো। শুটিংয়ের পুরো বাড়িটাকে স্যানিটাইজ করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে শুটিং করলেও আমরা নিরাপত্তা বজায় রেখে কাজগুলো করবো আশা করি।
কালচারাল ইয়ার্ড : করোনা পরবর্তী পৃথিবী সাংস্কৃতিক মানুষের জন্য কেমন হবে বলে মনে করেন?
সকাল আহমেদ : আসলে এক একজন মানুষ তো এক এক রকম। যে যে-ই বিষয়গুলো যেভাবে উপলব্ধি করে। আর আমার কাছে মনে হয়েছে, এই করোনা আরও ৩-৪ মাস বা আরও ৬ মাস ১ বছর থাকবে। করোনা নির্মুল না হওয়া পর্যন্ত আসলে আমাদের এর সাথেই জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হবে। সে জায়গা থেকে সুস্থভাবে চলাফেরা করাটাই বাঞ্চনীয়। এ সময় কোন রকম দুর্নীতি ও খারাপ কাজ না করাটাই শ্রেয়। সব সময় পজিটিভ থাকা ও পজিটিভ কাজ করাটাই উচিত বলে আমি মনে করি। এতে করে জীবনের অন্য ধরণের টেস্ট মানুষ হয়তো ফিল করবে।
আর এমন কিছু হতে পারে যে, এই করোনাকে নিয়েই কালচারাল কাজ ডেভেলপ করবে। কালচারালি অনেক কিছু তৈরি হবে। এটা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য খুবই দরকার। কারণ পৃথিবীতে এমন ধরণের বড় একটা মহামারী হয়ে গেছে। এটা ৫০ বছর বা ১০০ বছর পরে সেলুলয়েডে থাকবে, কিংবা পাঠ্য বইয়ে থাকবে বা আলোচনার জায়গায় থাকবে। এ পরিস্থিতিকে নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র ও নাটক তৈরি হবে।
কোভিড-১৯ নিয়ে তারকাদের কথা
⇒ আগামীতে একটা ইতিবাচক সাংস্কৃতিক বিশ্ব আমরা দেখতে পাবো: নিরব
কালচারাল ইয়ার্ড : অবসর সময় আপনার অতীত স্মৃতিতে কি কি ভেসে আসে। কোন সময়টা ধরা দেয় স্মৃতিতে?
সকাল আহমেদ : নষ্টালজিক হওয়ার তো একটা মোমেন্ট দরকার হয় আসলে। এখন ধরুন, আমি টেলিভিশনে একটা মুভি দেখছি, সেই মুভি দেখে হয়তো আমি নষ্টালজিক হয়ে যাচ্ছি, মনে মনে একটা জায়গায় চলে যাচ্ছি। হয়তোবা কোন কোন মুহর্ত মনে পড়ে যায়। এটা শুধু যে করোনাকালীন সময়ে, তা না। যখন একা থাকি বা কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করি, তখন এটা ঘটে। এছাড়া যেটা হয়, সেটা হচ্ছে আমার স্কুল লাইফের কথা খুব বেশি মনে পড়ে। ওই সময়টাকে মিস করি, ওই সময়ের বন্ধুদের মিস করি। যদিও ম্যাসেঞ্জারের থ্রুতে অনেকের সঙ্গেই এখন যোগাযোগ আছে। হায় হ্যালো হয়।
এছাড়া আমাকে যে জিনিসটা খুব ভাবায়, সেটা হচ্ছে নাটকের সেট। আমি শুটিং করতে পারছি না। শুটিং খুব মিস করি। 5, 4, 3, 2, 1, 0 অ্যাকশন- এটা বলতে পারছি না, এটা আমাকে ভাবায়। যাদের সঙ্গে কাজ করি, আর্টিস্ট, কলা-কুশলী; তাদের কথা মনে পড়ে। যখন যার কথা মনে পড়ে, তখন তার সঙ্গে ফোন দিয়ে কথা বলি।
কালচারাল ইয়ার্ড : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ
সকাল আহমেদ : কালচারাল ইয়ার্ডকেও ধন্যবাদ।