তরুণ নির্মাতা নানজীবা খান। তিনি একাধারে সাংবাদিক, উপস্থাপিকা, ট্রেইনি পাইলট, ইউনিসেফের তরুণ প্রতিনিধি, বিতার্কিক ও মডেল। অল্প বয়সেই নিজের সৃজনশীলতার মাধ্যমে দেশে বিদেশে বেশ পরিচিতি লাভ করেছেন। তার প্রথম প্রামাণ্যচিত্র ‘সাদা কালো’ পরিচালনার জন্য ‘ইউনিসেফের মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড’সহ নানা পুরস্কার অর্জন করেছেন। সর্বশেষ নির্মাণ করেছেন পুর্ণদৈর্ঘ্য ডকুফিল্ম ‘দি আনওয়ান্টেড টুইন’। করোনাকালীন সময় ব্যাক্তিজীবন ও শিল্প-সংস্কৃতির নানা বিষয় নিয়ে কালচারাল ইয়ার্ডের মুখোমুখী হন তিনি।
কালচারাল ইয়ার্ড : এই গৃহবন্দি সময় কীভাবে কাটছে? এ সময়ে আপনার পরিবর্তিত জীবনাচরণ ও জীবনবোধ সম্পর্কে জানতে চাই।
নানজীবা খান : আমরা আসলে নিজেদের কাজ নিয়ে এতো ব্যস্ত থকি যে, নিজেদের নিয়ে ভাবার সময় পাই না। এ সময়ে আসলে নিজেকে নিয়ে ভাবার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখনকার যে জীবনবোধ তৈরি হয়েছে, সেটা হচ্ছে নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারছি। নিজের ভবিষ্যত পরিকল্পনা, নিজেকে আসলে কোথায় নিয়ে যেতে চাই, নিজেকে কোথায় দেখতে চাই, এ সব নিয়ে ভাবতে পারি। সব মিলিয়ে করোনার এই সময়ে নিজেদের জন্য সময় বের করতে পেরেছি।
কালচারাল ইয়ার্ড : এই করোনা ভাইরাসের সময়ে চলচ্চিত্র অঙ্গন কি ধরণের ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন?
নানজীবা খান : গণমাধ্যম সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেটা কোন মাধ্যম এটা কোন ব্যাপার না। এই ভূমিকা যে কোন সময়ে, যেমন যে কোন দুর্যোগে, যে কোন হতাশাজনক অবস্থানে কিংবা দেশের যে কোন খারাপ সময়ে হোক; গণমাধ্যম গুরুত্ব রাখেই। তবে আমার কাছে যেটা মনে হয় যে, সবচেয়ে বড় যে জিনিস বোরিং, সেগুলো মানুষের খুব বেশি আগ্রহ তৈরি করতে পারে না। সেক্ষেত্রে মানুষকে বিনোদন দেওয়ার জন্য আমাদের বেশি বেশি বিনোদনমূলক কনটেন্ট নির্মাণ করতে হবে। আমরা যারা কনটেন্ট বানাবো, তখন যেনো-তেনোভাবে ছবি বসিয়ে কনটেন্ট বানালে মানুষের প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে না। মানুষ এতে সচেতনও হবে না। এখন কীভাবে মানুষকে সচেতন করতে হয়, এ জন্য আমাদের একটা ভালো ইনফরমেশনের উপর ভিত্তি করে ভালো কনটেন্ট বানাতে হবে।
নির্মাতা নানজীবা খানের আরও খবর :
⇒ নানজীবার প্রামাণ্যচিত্র ‘দি আনওয়ান্টেড টুইন’
আমার মনে হচ্ছে, বস্তুনিষ্ঠ বা বাস্তবিক ধারণা থেকে কনটেন্ট নির্মাণ করলে, সেটা মানুষের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করবে। সেক্ষেত্রে অ্যানিমেশন টাইপের কিছু হতে পারে। অ্যানিমেশন মানুষের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করে। সব মিলিয়ে ইনফরমেটিভ, বস্তুনিষ্ট কনটেন্ট বানাতে হবে।
কালচারাল ইয়ার্ড : এ সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি মানুষের সৃজনশীল কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেউ ছবি আঁকছে, কেউ গান গাইছে, কেউ আবৃত্তিও করছে। সিনেমাও হচ্ছে। এ সময় মানুষের মানবিকতা আর সাংস্কৃতিকবোধের বিকাশ ঘটবে বলে মনে করেন কিনা?
নানজীবা খান : আমার মনে হচ্ছে, এ সময় আমাদের যার যেটা করতে খুব ভালো লাগে সেটা করা। যেমন, আমার কথা বলতে খুব ভালো লাগে। অনেকের গান শুনতে ভালো লাগে, অনেকের গাইতে ভালো লাগে। সিনেমা দেখতে ভালো লাগে, কারও সিনেমা বানাতে ভালো লাগে। তো এই সময়ে যার যেটা ভালো লাগে, সেটা নিয়ে গভীরতর কিছু করার সুযোগ আছে। যেহেতু আমরা সময় পাই না। এখন একটা সময় পেয়েছি। এ সময় নিজের মধ্যে গিয়ে নতুন কিছু করার সুযোগ আছে।
আমার কাছে মনে হয় যে, যারা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে খুবই হালকাভাবে নিতো, এ সময়ে তারা সংস্কৃতির গুরুত্বটা বুঝতে পারবে। যারা আধুনিকতার এ চর্চাকে নেগলেক্ট করতো, তাদের মধ্যে এ সময় একটা উপলব্ধি আসছে বলে আমি মনে করি।
কালচারাল ইয়ার্ড : করোনা পরবর্তী পৃথিবী সাংস্কৃতিক মানুষের জন্য কেমন হবে বলে মনে করেন?
নানজীবা খান : করোনা আসার পরে এটা নিয়ে ভাবার কোন মানে হয় না। শুধু করোনা না, আমাদের সেভিংস করার মানসিকতা আগে থেকেই থাকা উচিত ছিলো। যারা আসলে সেভিংস করেছে, তারাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে। আর যারা সেভিংস করে নি, তারা খারাপ সময় আসলে ডিজার্ভ করে। এখনও সময় আছে আমাদের উচিত হবে, যার যা আছে, তা খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া খরচ না করা। আর আমরা যেহেতু উন্নয়নশীল দেশ, করোনা পরবর্তী আমাদের অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে। এক্ষেত্রে এখন থেকেই আমাদের আরও সচেতন হতে হবে পরবর্তী অবস্থার জন্য।
কোভিড-১৯ নিয়ে নির্মাতাদের ভাবনা
♣ ‘এই সময়ে মানবিক গল্পপ্রধান চলচ্চিত্র মানুষের মনে স্বস্তি দিতে সক্ষম’
এছাড়া সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য করোনা পরবর্তী সময়টা খুবই কঠিন একটা সময়। কারণ আমাদের যারা আছে তারা বেশিরভাগই ফ্রিল্যান্সিং করে। তাদের জন্য এটা কঠিন। এছাড়া অনুদানের পক্ষে আমি না। কারণ সরকার এ খাতে অনেক অনুদান দেয়। এখন এ সব অনুদান ঠিকভাবে ডিস্ট্রিবিউট হচ্ছে কিনা সেটা খেয়াল রাখতে হবে। প্রোপার ডিস্ট্রিবিউট না হলে যেটা হবে, সেটা হচ্ছে যাদের দরকার নেই, তারা এটাতে ভাগ বসাচ্ছে, যাদের দরকার তারা পাচ্ছে না।
কালচারাল ইয়ার্ড : অবসর সময় আপনার অতীত স্মৃতিতে কি কি ভেসে আসে। কোন সময়টা ধরা দেয় স্মৃতিতে?
নানজীবা খান : অতীত স্মৃতির কথা বললে যেটা আগে মনে পড়ে, তা হচ্ছে ছোটবেলার কথা। বিশেষ করে ছোটবেলায় শিশু সাংবাদিক হিসেবে যখন কাজ করতাম। সে সময়ের কথা আমার খুব বেশি মরে পড়ে। ওই সময় অনেক স্ট্রাগল করতে হতো, অনেক ফিল্ড ওয়ার্ক করতে হতো। কিন্তু সেভাবে আমরা ক্যামেরা সাপোর্ট পেতাম না, সেভাবে এডিটিং সাপোর্ট পেতাম না। এরপরও আমরা কাজ করে গেছি।
আমার কাছে মনে হয়, আমি নিজেকে এমনভাবে তৈরি করতে পেরেছি যে, যখন আমি ডিপ্রেশনে চলে যাই, তখন আমার অন্য কোন মটিভেশনাল স্পিচ শুনতে হয় না। আমি যদি আমার নিজের বায়োগ্রাফি দেখি, তখন এটা আমাকে অনেক বেশি ইন্সপায়ার করে। এই মুহুর্তে সবচেয়ে বেশি যেটা আমি মিস করি আমার শুটিং, ফটোশুট বা ক্যামেরার পেছনের ডিরেকশনের কাজ মিস করি। এই কাজ তো এখন করা যাচ্ছে না। কবে স্বাভাবিক হবে সব কিছু এটা চিন্তার ব্যাপার।
করোনা নিয়ে তারকাদের কথা
⇒ করোনাকালীন সময়ে সচেতনতার শিক্ষাই আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন : অমিত হাসান
তবে আমার মনে হয়, গণমাধ্যমের যে কোন সেক্টরে কাজ পুরোপুরি শুরু করা উচিত। অনেক উন্নত দেশে প্রটেকশন নিয়ে কাজ শুরু হয়ে গেছে। আমাদের অনেকের পেটে খাবার আছে, তাই অনেকে বড় বড় কথা বলতে পারছি, কিন্তু জীবিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ জীবনের জন্য। জীবিকা ছাড়া জীবন চালানো যায় না। বিকল্প পদ্ধতিতে কাজ শুরু করা উচিত।
কালচারাল ইয়ার্ড : সবশেষ সবার উদ্দেশ্য যদি কিছু বলতে চান-
নানজীবা খান : সবশেষে সবাইকে বলবো সচেতন থাকতে, বিশেষ করে সবার মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি এ সময় খেয়াল রাখা উচিত। কারণ মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লে আমরা আসলে কোন কাজ করতে পারবো না। দিনশেষে সে আসলে সাকসেস হয়, যে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকে। এই মুহুর্তে যেন আমরা ডিপ্রেশনে না থাকি, এ সময় আমরা যারা যা পছন্দ করি সে কাজগুলো করি, এছাড়া প্রফেশনাল জায়গা থেকেও আমরা ঘরে বসে কাজ করতে পারি।
কালচারাল ইয়ার্ড : আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
নানজীবা খান : আপনাকেও ধন্যবাদ।