বিশেষ প্রতিবেদক:
শিল্পমানসমৃদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও সাহিত্যভিত্তিক চলচ্চিত্রের জন্য প্রতিবছর অনুদান দিয়ে থাকে বাংলাদেশ সরকার। কয়েক বছর ধরে প্রতিবারই এ অনুদান প্রক্রিয়া জন্ম দিচ্ছে নানা বিতর্কের। এবার সর্বোচ্চ সংখ্যক চলচ্চিত্রকে অনুদান দিয়েছে সরকার। করোনাকালে ২০১৯-২০ অর্থ বছরের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। আর এবারের অনুদান দেওয়ার পর থেকে আবারও তর্ক-বিতর্ক চলছে। এ নিয়ে অনেকদিন ধরে বয়ে চলা বাণিজ্যধারা ও বিকল্পধারা বিভক্তি স্পষ্ট হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (২৫ জুন) জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে ১৬টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও ৯টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকে অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।
অনুদান ঘোষণার পরপরই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সংশ্লিষ্টরা। এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেছে বিকল্প চলচ্চিত্রের প্লাটফর্ম বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম, বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটি, বাংলাদেশ প্রামাণ্যচিত্র পর্ষদ, বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও ফিল্ম উইদাউট ফিল্ম।
বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল হাসান স্বাক্ষরিত এ বিবৃতিতে সংগঠনের নেতারা বলেছেন, চলচ্চিত্রে অনুদান দেওয়া হয় শিল্পসম্মত চলচ্চিত্রকে। যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করবে শিল্পসম্মত নির্মাতারা। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের স্থুল এবং বিকৃত বিনোদনের জন্য নয়। আর এবারের চলচ্চিত্রে বানিজ্য নির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাতারা অনুদান পেয়েছে। এ অনুদান প্রজ্ঞাপনে কোনো পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্র রাখা হয়নি।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, তথ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে ২০১৯-২০ অর্থ বছরের সরকারি অনুদান ঘোষণা করেছে। কিন্তু আমরা হতাশা এবং ক্ষোভের সাথে লক্ষ্য করছি, অনুদানের জন্য যে চলচ্চিত্র এবং পরিচালকদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে তাদের বেশির ভাগই বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং অনেকেরই চলচ্চিত্র পরিচালনার ন্যূনতম অভিজ্ঞতা আছে বলে আমাদের জানা নেই। সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ এবং শৈল্পিক চলচ্চিত্র নির্মাণের যে অঙ্গীকার অনুদান নীতিমালায় সন্নিবেশিত রয়েছে এই ঘোষণা তার ব্যত্যয় বলেই আমরা মনে করি।
তথ্যমন্ত্রীকে বাণিজ্যধারার চলচ্চিত্র সংগঠনের অভিনন্দন
এদিকে এবারের চলচ্চিত্রে অনুদান প্রক্রিয়ায় অধিকসংখ্যক নির্মাতাদের অনুদান দেওয়ায় তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে অভিননন্দন জানিয়েছে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, পরিচালক সমিতি ও প্রযোজক পরিবেশক সমিতি। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত চলচ্চিত্র শিল্পকে সহায়তার লক্ষ্যে আগের তুলনায় বেশিসংখ্যক চলচ্চিত্রকে অনুদান দেওয়ায় তথ্যমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক অভিনন্দনপত্র দেওয়া হয়। ফোনেও তথ্যমন্ত্রীকে অনেকে ধন্যবাদ জানিয়েছে।
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর ও সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান টেলিফোনে তথ্যমন্ত্রীকে শিল্পীদের পক্ষে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। এদিকে পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার স্বাক্ষরিত একটি অভিনন্দনপত্র পাঠানো হয় তথ্যমন্ত্রী বরাবর। চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু স্বাক্ষরিত একটি অভিনন্দন পত্রও তথ্যমন্ত্রী বরাবর পাঠানো হয়।
‘প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে নেই অনুদান, পেলেন অনভিজ্ঞরা’
তবে এবারের অনুদান প্রক্রিয়ায় অধিকসংখ্যক চলচ্চিত্রকে অনুদান দেওয়া হলেও কোনো প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে অনুদান দেওয়া হয়নি। এছাড়া অনেক নতুন স্বাধীন ধারার নির্মাতা থাকলেও বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের প্রবীণ নির্মাতাদের অনুদান দিয়ে অনুদান ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে বলে অভিযোগ দিচ্ছেন স্বাধীন ধারার নির্মাতারা। এছাড়া চলচ্চিত্রে অনভিজ্ঞ ব্যাক্তিরাও পেয়েছেন এ অনুদান-এমনও বলছেন তারা।
প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে অনুদান না দেওয়ায় ক্ষুদ্ধ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা মানজারে হাসিন মুরাদ এর প্রতিবাদ করে বলেন, এবারের চলচ্চিত্রে অনুদান প্রক্রিয়ায় পূর্ণদৈর্ঘ্য কোনো প্রামাণ্য চলচ্চিত্রকে অনুদান না দেওয়ায় এর প্রতিবাদ করছি। সবার পক্ষ থেকে প্রতিবাদ হওয়া দরকার।
ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিস অব বাংলাদেশ এর সাধারণ সম্পাদক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা বেলায়াত হোসেন মামুন এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন, স্বল্পদৈর্ঘ্য ক্যাটাগরিতে চলচ্চিত্র অনুদান খুব খারাপ হয়নি; তবে পূর্ণদৈর্ঘ্য ক্যাটাগরিতে ‘এফডিসি’ বাঁচাও কর্মসূচি দেখতে পাচ্ছি। যেহেতু এফডিসি একটি রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠান তাই এর সাথে তেলেঝোলে ঝুলে থাকা লোকজনকে বাঁচানোর দায় তথ্য মন্ত্রণালয় নিতেই পারে, মন্দ কী!
তিনি বলেন, কিন্তু কথা হলো চলচ্চিত্র অনুদান ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছিল শিল্পমানসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণের অভিপ্রায় থেকে, সে অভিপ্রায়ের কথা বিবেচনায় নিলে ‘এফডিসি’ বাঁচাও তৎপরতাটা অন্যভাবে করলেই ভালো হত। এফডিসিকে পৃথকভাবে ১০ কোটি টাকা দিয়ে বাণিজ্যপ্রবণ চলচ্চিত্র নির্মাণের একটা প্রকল্প নেয়া কঠিন ব্যাপার ছিল না।
এদিকে একাধিক স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা নাম না প্রকাশ করে কালচারাল ইয়ার্ডকে জানিয়েছে, এবারের চলচ্চিত্র অনুদান প্রক্রিয়া ভাগ-বাটোয়ারার মধ্যে হয়েছে। শর্টফিল্মে কিছুটা তরুণ ও স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অধিকসংখ্যক চলচ্চিত্রে বাণিজ্যনির্ভর স্থুল বিনোদনের লক্ষে অনুদান দেওয়া হয়েছে। যাতে যে লক্ষ্য নিয়ে এ চলচ্চিত্র অনুদান প্রথা চালু করা হয়েছে, সেটি ব্যাহত হয়েছে।
তারা আরও অভিযোগ করে বলেন, এবারের অনুদান কমিটিতে স্বাধীন ধারার অঁতর চলচ্চিত্র নির্মাতা ও শিক্ষক মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, আবু সায়ীদ, মানজারে হাসীন মুরাদের মতো লোকেদের রাখা হয়নি। বিষয়টি অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ ও অনভিপ্রেত।
এছাড়া পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে বেশ কিছু নাম না জানা এমনকি অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত নির্মাণে অনভিজ্ঞ ব্যাক্তিদের অনুদান দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করছেন তারা।