রোমান কবির :
ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম চলচ্চিত্রকার বলা হয় দাদা সাহেব ফালকে-কে। কিন্তু তারও আগে এ উপমহাদেশে সর্বপ্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শন করেন বাঙালি চলচ্চিত্রকার হীরালাল সেন। তিনি উপমহাদেশ শুধু নয় বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শন করেন বলে বিশ্লেষকরা বলছেন। প্রথম বাঙালি চলচ্চিত্রকার হীরালাল সেন একাধারে ছিলেন প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রদর্শক, ছিলেন। এছাড়া তিনিই প্রথম এই উপমহাদেশে নির্মাণ করেছেন বিজ্ঞাপনচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র, তথ্যচিত্র ও রাজনৈতিক চলচ্চিত্র। তিনি ছিলেন প্রথম চলচ্চিত্র প্রযোজক ও শিক্ষক। এই গুনী চলচ্চিত্রকারের জন্মবার্ষিকী ২ আগস্ট।
কালচারাল ইয়ার্ড পরিবারের পক্ষ থেকে এই গুনী চলচ্চিত্রকারের প্রতি শ্রদ্ধা।
হীরালাল সেন ১৮৬৮ সালের ২ আগস্ট মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা চন্দ্রমোহন সেন ঢাকার জিন্দাবাহার লেনের বাসিন্দা ও ব্রাম্ম সমাজের নেতা, পত্রিকা সম্পাদক ও আইনজীবি ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম বিধুমুখী। তাঁর দাদা গোকুল কৃঞ্জ সেন মুন্সী ছিলেন ধনাঢ্য জমিদার ও আইনজীবি।
হীরালাল সেন কলকাতায় কলেজে পড়ার সময় ফটোগ্রাফি করতেন। তিনি ফটোগ্রাফিতে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ফটোগ্রাফার হিসেবে স্বর্ণপদক অর্জন করেছিলেন। তিনি কলকাতায় এইচ এল সেন এন্ড ব্রাদার্স নামে স্টুডিও স্থাপন করেছিলেন। এ সময় তিনি কলকাতায় বিভিন্ন নাট্য থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে যান।
চলচ্চিত্র নির্মাতা হীরালাল সেন সম্পর্কিত আরও খবর :
⇒ উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে হীরালাল ফালকে রাজনীতি
১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে লুই লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় চলচ্চিত্রের বিপ্লব করে ফেলেছেন। এই দুই ভাই বিশ্বব্যাপী তখন চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে বেড়ান। এ সময় ১৮৯৬ সালে বিদেশী স্টিফেন্স বা স্টিভেন্স কলকাতা হাইকোর্টের কাছে খোলা মাঠে এবং পরে স্টার থিয়েটারের বায়োস্কোপ বা চলচ্চিত্র দেখান। এই চলচ্চিত্র দেখে হীরালাল সেন আকৃষ্ট হন ও এ সম্পর্কে জানতে চান। কিন্তু স্টিভেন্স তাঁকে কোন কিছু শেখাতে চাননি। পরে তিনি নিজেই প্রায় ৫ হাজার টাকা খরচ করে বিলেত থেকে সিনেমাটোগ্রাফ ও এ সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি নিয়ে আসেন।
১৮৯৮ সালে হীরালাল সেনই প্রথম গঠন করেন ‘দি রয়াল বায়োস্কোপ’ কোম্পানী’ নামের প্রযোজনা সংস্থা। এ সময় তাঁর প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে আমদানিকৃত চলচ্চিত্র প্রদর্শণ করেন।
১৯০০ সালের দিকে ফ্রান্সের প্যাথে কোম্পানী বিভিন্ন দৃশ্য গ্রহণের জন্য কলকাতায় মুভি ক্যামেরা পাঠায়। এই ফিল্ম ইউনিটে সহকারী হিসেবে যুক্ত হয়ে হীরালাল সেন চলচ্চিত্র নির্মাণের কলা-কৌশর শিখে নেন। এ সময় তিনি চিত্রধারণ, শট বিভাজন, বিষয়বস্তু নির্ধারণ ইত্যাদি কৌশল রপ্ত করেন। এ সময় তিনি নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন চিত্রধারণ করেন। এ সব চিত্রের মধ্যে ছিলো গঙ্গার স্নান দৃশ্য, মোরগের লড়াই, রাস্তার খন্ড খন্ড দৃশ্য ইত্যাদি। এছাড়া তিনি ধারণ করেন মঞ্চ নাটক, বিভিন্ন অনুষ্ঠান, চলমান জনজীবন, প্রাকৃতিক জীবন, রাজনৈতিক আন্দোলন ও বিবিধ রাজনৈতিক ঘটনা ইত্যাদি।
হীরালাল সেন প্রথম তাঁর গ্রামের পুকুরের স্নান দৃশ্য ও কোটের খেলা মুভি ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন। গবেষক প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের লেখায় পাওয়া যায়: হীরালাল সেন প্রথম ক্যামেরা হাতে পাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গেই চলে যান বগজুরী গ্রামে। তিনি তাঁর বাড়ির পেছনে পুকুরধারে পুকুরের আট মিনিটের স্নানদৃশ্য ধারণ করেন। এই স্নানে অংশ নিয়েছিলেন ছোটভাই দেবাকীলাল, মামাতো ও পিসতুতো ভাই জগদীস সেন, গিরীস সেন ও দীনেশ সেন।
চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ এর গবেষণা থেকে পাওয়া যায় ছবিটির বিষয়বন্তু সম্পর্কে। বিষয়টি ছিলো এরকম: প্রথম ছবিটি আরম্ভ পুকুর পারে। ওরা চারজন দাঁড়িয়ে আছেন আর হাতের ইশারা পাওয়া মাত্র সবাই একসঙ্গে জলে ঝাঁপ দিয়ে মহা উৎসাহে সবাই সাঁতার কাটলেন। তারপরেই দেখা গেল সেই চারজনই দাঁড়িয়ে আছেন সেই পুকুরের ধারে, গায়ের কাপড় শুকনো এবং আবার ঝাঁপ দিলেন পুকুরে ঠিক সেই আগের মতন। তারপরই দেখা গেল ওরা সবাই বসে আছেন পাশের বাগানে আর পোশাক একবারে আলাদা।
ছবিটি প্রথম দেখানো হয় ওদের বাড়ির প্রকান্ড উঠানে আর গ্রাম থেকে লোক এসেছিল ‘ভুতুড়ে ব্যাপার দেখতে’। ছবি চলাকালীন বহুলোক ভয়ে চিৎকার করে ছুটে পালিয়ে যায় এবং রাতারাতি প্রচারিত হয়ে যায় যে জমিদারবাবুর বড় ছেলে ‘ভুতসিদ্ধ’ হয়েছে।
‘কোটের খেলা’ ছবিতে দেখা যায়, একজন কোটপরা লোক এসে একটা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে তার কোটটা খুলে টেবিলের উপর রেখে চলে গেল। ঠিক তারপরই আবার সেই লোকই সেই কোটটা পরে অন্য একদিক থেকে এসে আবার কোট খুলে রেখে চলে গেল। এইভাবে পাঁচবার বিভিন্ন দিক থেকে এসে কোট খুলে রেখে চলে যাওয়ার পর দেখা যায় যে টেবিলের ওপর কোটটা পড়ে আছে আর ওদিকে একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে লোকটা নিজের গায়ে হাত বুলিয়ে দেখছে যে গায়ে তার কোট নেই। তারপরই দেখা যায় যে টেবিলে কোট নেই আর ওদিকে কোটটা পরে লোকটা আনন্দে হাঁটছে।
সিনেমা দুটি সে সময় কলকাতা ও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনী করা হয়েছিলো। এ সময় হীরালাল সেন মুভি ক্যামেরায় ধারণ করেন ক্লাসিক থিয়েটারে প্রদর্শিত নাটক সীতারাম, আলীবাবা, কুসুম কুমারী, ভ্রমর নাটকগুলোর খন্ডচিত্র।
এছাড়া এ সময় তিনি ধারণ করেন হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীর বিভিন্ন দৃশ্য, দৈনন্দিন জীবনের শান্তিময় এবং আনন্দের দৃশ্যাবলী, জনপ্রিয় নাটকের দৃশ্যাবলী, চাক্যচিক্যময় নৃত্যদৃশ্য ইত্যাদি।
১৯০৩ সালে হীরালাল সেন দিল্লীর দরবার নামে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। এ সময় তিনি তিনটি পণ্যের বিজ্ঞাপনচিত্রও নির্মাণ করেন। এগুলোর মধ্যে ছিল: বটকৃষ্ন পাল কোম্পানীর ‘এডওয়ার্ডস এ্যান্টি ম্যালেরিয়ার স্পেসিফিক’, সি কে সেন কোম্পানীর ‘জবাকুসুম তৈল’ ও ও আর ডব্লিউ মেজর কোম্পানীর ‘সালসা পিলার’ বিজ্ঞাপন চিত্র।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী সমাবেশ ও স্বদেশী আন্দোলনের উপর তিনি একটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এই চলচ্চিত্রকে তিনি মহান দেশপ্রেমের চলচ্চিত্র বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।
হীরালাল সেনের চলচ্চিত্রজীবনের প্রতি পদে পদে ছিলো বাধা। তিনি তাঁর ভাই মতিলাল সেনের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন ‘দি রয়াল বায়োস্কোপ’ কোম্পানি। কিন্তু ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে তার মতবিরোধ তৈরি হয়। তাঁর নির্মিত কোন চিত্রই আজ আর পাওয়া যায়না। তাঁর সব সৃষ্টিই আগুনে ভস্মীভূত হয়ে নষ্ট হয়ে যায় চিরতরে। এখন তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে জানা যায় চলচ্চিত্র ইতহাসবিদ ও গবেষকদের লেখা গ্রন্থে। তাঁকে বলা হয় চলচ্চিত্র ইতিহাসের একজন ট্রাজিক হিরো হিসেবে।
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হীরালাল সেন ১৯১৭ সালের ২৯ অক্টোবর মারা যান।
তথ্যসূত্র: চলচ্চিত্র গবেষক ও লেখক অনুপম হায়াৎ এর গবেষণা