রোমান কবির :
সেদিন ছিলো শুক্রবার। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বিকালে পরিবারের সবাই মিলে বিটিভিতে বাংলা সিনেমা দেখছি। তখন ৬-৭ বছরের বালক ছিলাম। তবে স্পষ্ট মনে আছে সিনেমার মাঝে হঠাৎ বিকাল ৪টার সংবাদে উপস্থিত এক উপস্থাপিকা, তার মুখ গোমড়া হয়ে আছে, কাঁদো কাঁদো। বজ্রপাত হওয়ার মতোই একটি খবর বললেন তিনি। চিত্রনায়ক সালমান শাহ আর নেই। সকালে তিনি ইস্কাটনের নিজ বাসায় মারা গেছেন। তিনি আত্নহত্যা করেছেন বলে ধারণা করছে পুলিশ। খবরে দেখানো হলো সালমান শাহ’র কাফনে মোড়ানো মুখ বের করা একটি লাশের ছবি। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল এটা সালমান শাহ। কোথায় সিনেমার সেই সুদর্শন গ্লামারস মহানায়ক। সেই সময় কাফনে মোড়ানো মুখটি স্মৃতি থেকে সরাতে পারিনি অনেকদিন। ঘুমের মধ্যেও স্বপ্নে দেখা দিত কাফনে মোড়া সেই বিগ ক্লোজ আপ ছবিটি।
শহরের এক ঘিঞ্জি গলিতে নব্বই দশকে সবাই মিলে থাকা, আনন্দ, দু:খ ভালোবাসার একটি সময় ছিলো আমাদের। তখন সবাই মিলে একদিনের জন্য একটি ভিডিও প্লেয়ার ভাড়া আনা হতো, আনা হতো বাংলা, ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি সিনেমার ক্যাসেট। বিশাল সাইজের ফিতাওয়ালা ক্যাসেটগুলোই তখন ছিলো বিনোদনের একটি বড় মাধ্যম সেই সময়। ক্যাসেটগুলোর বেশিরভাগই ছিলো পাইরেটেড। ছিলো হল থেকে ভিডিও করা। শো শো আওয়াজ, ঘ্যার ঘ্যার আওয়াজসহ নানারকমের বিদঘুটে শব্দের মাঝখানে ঝাপসা ভিজ্যুয়ালে চলতো ছবিগুলো। এরপরও সবাই একসাথে বসে কি আগ্রহ নিয়ে সেগুলো দেখতাম। বিশেষ করে হলিউডের দুই একটা ক্যাসেট নিয়ে আসা হতো। সেগুলোই শুধুমাত্র ঝকঝকে ছবি ছিলো।
সালমান শাহকে নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের ভাবনা
⇒ প্রজন্মান্তরের তরুণদের আইকন সালমান শাহ
সালমান শাহ’র মৃত্যুর পর সালমান ঝড় বয়ে গেলা যেন চারদিকে। তখন বলিউড, হলিউডের সিনেমা আনা কমে গেলো। শুক্রবার হলেই ভিডিও প্লেয়ার এনে সালমান শাহের মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলো দেখা। চাওয়া থেকে পাওয়া, কেয়ামত থেকে কেয়ামত, অন্তরে অন্তরেসহ বেশিরভাগ সিনেমাই দেখা হচ্ছিল তখন। সালমানের মৃত্যুর পরে প্রথমেই সিনেমা হলে মুক্তি পেল সত্যের মৃত্যু নেই। তখন তো বয়স হয়নি, আবার তখন সিনেমা হলে যাওয়াও ছিলো বারণ। অপেক্ষা করলাম কবে এই ছবির ক্যাসেট বের হবে। ছবিটি মুক্তি পেল।
পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের খবরে এর নিউজ হচ্ছে, রেডিওতে বাজছে সিনেমার গান, এর মধ্যে মুখে মুখেই প্রচার হয়ে গেলো সিনেমাটির গল্প। সিনেমার গল্প শুনছি, বিভিন্ন দৃশ্য শুনছি, আর নিজেই নিজেই ভিজ্যুয়ালাইজ করছি। বিশেষ করে সালমান শাহ’র নাকি শেষ দৃশ্যে ফাঁসি হয়। মা ও ছেলের দ্বন্ধ। ছেলের ফাঁসি জেনেও মা সত্য উচ্চারণ করেছে।
শাবানা ও সালমানের বিভিন্ন সংলাপ রেডিওতে শুনছি আর ভিজ্যুয়ালাইজ করছি। সংলাপ শুনতে শুনতেই চোখ ভিজে যাচ্ছে। বিশেষ করে চিঠি এলো জেলখানাতে অনেক দিনের পর, গানটি রেডিওতে শুনে অশ্রুপাত রোখা যাচ্ছিলনা। এরপর বিটিভিতে একদিন ছায়াছন্দতে সেই গান প্রচার করা হলো। প্রথমবারের মতো ভিজ্যুয়াল দেখলাম এই গানটির। রেডিওতে কাহিনী শুনে, গান দেখে, গল্প শুনে মনের মধ্যে পুরো ছবিটা দেখে ফেললাম। সেই সময় যত সিনেমা মুক্তি পেত এর বেশিরভাগই আগে শুনতাম রেডিওতে। রেডিওতে তখন সিনেমার অনুষ্ঠান ও গানে সালমান থাকতোই। বিশেষ করে সালমানের মৃত্যু নিয়ে তখন থেকেই নানা রহস্য ঘণীভূত হয়।
সালমান শাহ সম্পর্কিত আরও খবর
⇒ স্বপ্নের নায়ক সালমান শাহ
সালমানের বাবা কমরউদ্দিন চৌধুরী একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। সেখানে আসামি ছিলেন সামিরা হক, ডনসহ ৮জন। মা নীলা চৌধুরীর আবেগী বর্ণনা নিয়ে আবেগী ক্যাসেট বের হয়। সালমানকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে এর নানা বর্ণনা প্রচার হয়। গলায় রশি লাগিয়ে হত্যা করা হয় সালমানকে-এমন নানা মুখরোচক খবর শুনি। এই বর্ণনার সঙ্গে সত্যের মৃত্যু নেই সিনেমায় মিথ্যে মামলায় সালমানের ফাঁসি হচ্ছে-ওর মা কি পারবে শেষ পর্যন্ত ওকে বাঁচোতে।
ফাঁসি কার্যকরের আগে সালমানের মা শাবানা জেলে তার সঙ্গে দেখা করতে যায়। সেখানের আবেগী সংলাপ সবারই চোখ ভিজিয়ে দেয়। ছবির শেষ দৃশ্যের আগে সবার মধ্যেই উৎকন্ঠা নায়কের কি ফাঁসি হবে, তাকে কি তার মা বাঁচাতে পারবে। শেষ পর্যন্ত সালমানের ফাঁসি হয়না। সে খালাস পায়। আমরাও স্বস্তি পাই, আমাদের চোখে তখন আনন্দের অশ্রু। কিন্তু পরক্ষণেই মনটা চুপসে যায়। ছবিতে বেঁচে গেলেও বাস্তবে তো বাঁচতে পারেনি, উফফ!! যদি বাস্তবে সালমানের মা সালমানকে বাঁচাতে পারতো হত্যা কিংবা আত্নহত্যা থেকে। নানা চিন্তা ভর করছিলো সেই ছোট্টমনে। ভালো থাকুক সালমান………
লেখক : সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।