বিশেষ প্রতিবেদক:
বলা হয় বিশে বিষ। কারণ এ বছর বিশ্বমারী করোনা ভাইরাস হানা দেয়। স্থবির করে দেয় জীবনচাকা। জীবনদর্শন ও সংস্কৃতিতেও আসে পরিবর্তন। প্রকৃতি পরিমার্জন, পরিবর্ধন করে সবকিছু। এরই মধ্যে বিশ্বের সংস্কৃতিতেও ঘটে গেছে পরিবর্তন। শিল্প মাধ্যম নিউ নরমাল পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে এগুতে শুরু করেছে। এতকিছুই মধ্যে বিশের বিষে আমরা হারিয়েছি অনেক তারকাদের।
আলী যাকের:
করোনাকালে ক্যানসার আক্রান্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকের চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। গত ২৭ নভেম্বর তিনি পরপারে পাড়ি জমান। বাংলার নাট্যাঙ্গনের মেধাবী নির্দেশক ও অভিনেতা আলী যাকের। মঞ্চে তিনি ছিলেন ‘গ্যালিলিও’, টেলিভিশনে বড় চাচা, চলচ্চিত্রেও অনবদ্য।
এই নিষিদ্ধ পল্লীতে আলী, দেওয়ান গাজীর কিস্সা, গ্যালিলিও, ম্যাকবেথ, টেমপেস্ট, নূরলদীনের সারাজীবন, সৎ মানুষের খোঁজে, অচলায়তন, বিদগ্ধ রমণী কুল, তৈল সংকট, কোপেনিকের ক্যাপ্টেনসহ বহু নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি।
টেলিভিশনের পর্দায় হুমায়ূন আহমেদের বহুব্রীহি ও আজ রবিবার নাটকে অভিনয় করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আসেন। তাঁর অভিনীত একক টেলিভিশন নাটক নীতু তোমাকে ভালোবাসি, অচিনবৃক্ষ, আইসক্রিম, একদিন হঠাৎ, পাথর সময়, গণি মিয়ার পাথর ইত্যাদি।
এছাড়া ‘আগামী’, ‘নদীর নাম মধুমতী’, ‘লালসালু’ ও ‘রাবেয়া’ চলচ্চিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন আলী যাকের।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি আলী যাকের, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হওয়া আলী যাকের সংস্কৃতির আকাশে উজ্জ্বল তারা হয়ে সবার মনে বিরাজ করবেন আজীবন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়:
দুই বাংলার কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মহাপ্রয়াণ ঘটেছে এ বছর। গত ১৫ নভেম্বর ৮৬ বছরে চলে গেলেন তিনি। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা ও মহাতারকা সৌমিত্র ছিলেন একাধারে নাট্যকার, বাচিকশিল্পী, কবি ও চিত্রকর।
বিশ্বখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের অপুর সংসার সিনেমায় অপু হয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। সে থেকে শুরু হয়ে সত্যজিতের ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ১৯৫৯ সাল থেকে অদ্যবদি অভিনয় করে গেছেন শেষ বয়স পর্যন্ত।
সিনেমায় অভিনয় ছাড়াও বহু মঞ্চ নাটক, যাত্রা, এবং টেলিভিশন ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন তিনি। লিখেছেন অনেক নাটক ও কবিতা। বেশ কিছু নাটক পরিচালনাও করেছেন তিনি। তাঁর মত বড় মাপের আবৃত্তিকার খুব কমই আছে।
আলাউদ্দীন আলী:
দেশের সঙ্গীতাঙ্গনে একটি হারানোর বেদনা ছিলো আলাউদ্দীন আলী। ক্যানসার আক্রান্ত আলাউদ্দীন আলী গেলো ৯ আগস্ট বিকেল ৫টায় মারা যান। বাংলা চলচ্চিত্রে অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান লিখে ও সুর করে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন। তিনি একাধারে ছিলেন গীতিকার, সুরকার, বেহালাবাদক ও সঙ্গীত পরিচালক।
যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়, একবার যদি কেউ ভালোবাসত, ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়, এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই, দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয়, সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি ও আমার বাংলাদেশ, হয় যদি বদনাম হোক আরও, প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশসহ বহু জনপ্রিয় গানের সুর করে গেছেন তিনি।
এন্ড্রু কিশোর:
দীর্ঘ ১০ মাস ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে গত ৬ জুলাই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। দেশের খ্যাতিমান সঙ্গীতজ্ঞ, প্লেব্যাক সম্রাট ও সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন তিনি। তিনি মরণব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন গেল বছর। এ জন্য তিনি সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তিও হন। দেশে ফিরে নিজ জন্মভূমি রাজশাহীতে অবস্থান করছিলেন তিনি।
চলচ্চিত্রের ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ বলা হয় এন্ড্রু কিশোরকে। ১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে ‘মেইল ট্রেন’ চলচ্চিত্রে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তাঁর কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক শুরু করেন।
জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প, হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, আমার বুকের মধ্যে খানে, আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান, ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানাসহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান গেয়েছেন তিনি। বাংলা চলচ্চিত্রের গানে অবদানের জন্য আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন।
সাদেক বাচ্চু :
এ বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়ে শারীরিক জটিলতায় অভিনেতা সাদেক বাচ্চু পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। পাঁচ দশকের ক্যারিয়ারে তিনি মঞ্চ, বেতার, টেলিভিশন ও সিনেমায় অভিনয় করেছেন। নব্বইয়ের দশকে পরিচালক এহতেশামের ‘চাঁদনী’ সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে পরিচিতি পান তিনি। রেডিও বা টেলিভিশনের আগে মঞ্চে অভিনয় শুরু করেন। মতিঝিল থিয়েটার নামের থিয়েটারের তিনি সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি নাটক লেখেন ও নির্দেশনা দেন। গেল বইমেলার মুক্তমঞ্চে তিনি নাটক নিয়ে ওঠেন তাঁর দল নিয়ে।
এছাড়া তিনি ‘জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার’, ‘জীবন নদীর তীরে’, ‘তোমার মাঝে আমি’, ‘ঢাকা টু বোম্বে’, ‘এক জবান’, ‘আমার স্বপ্ন আমার সংসার’, ‘মন বসে না পড়ার টেবিলে’, ‘বধূবরণ’, ‘আমার প্রাণের স্বামী’, ‘প্রিয়জন’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘সুজন সখী’সহ অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করেছেন।
ইরফান খান:
মায়ের মৃত্যুর চারদিন পর ইহলোক ত্যাগ করে পরপারে চলে যান বলিউডের শক্তিমান অভিনেতা ইরফান খান। গেলো ২৯ এপ্রিল সকালে মুম্বাইয়ের কোকিলাবেন ধীরুভাই আম্বানি হাসপাতালে মারা যান তিনি। কলোন ইনফেকশনে তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।
বলিউড অভিনেতা ইরফান খান ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে অভিনয়ে স্নাতকোত্তর করেন। আশির দশকে মুম্বাইয়ে অভিনয় ক্যারিয়ার শুরু হয়। ১৯৮৮ সালে মীরা নায়ারের ‘সালাম বোম্বে’ সিনেমার মাধ্যমে বড়পর্দায় অভিষেক হয়। এরপর তিনি বলিউডের অনেক ব্লকবাস্টার ছবিতে অভিনয় করেন। তিনি বাংলাদেশের মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নির্মিত ‘ডুব’ সিনেমায় অভিনয় করেন।
কিম কি দুক:
করোনায় মারা গেলেন কোরিয়ার চলচ্চিত্র পরিচালক কিম কি দুক। ১১ ডিসেম্বর তিনি প্রয়াত হয়েছেন। ক্রোকোডাইল, স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার…অ্যান্ড স্প্রিং, সামারিতান গার্ল, রাফ কাট, আরিরাংসহ বহু ছবির নির্মাতা কিম কি দুক। গত বছর তিনি তাঁর শেষ ছবি ডিজলভ নির্মাণ করেছিলেন।
গত ২০ নভেম্বর লাটভিয়া গিয়েছিলেন নিরিবিলি থাকার জন্য। ওখানে বসে লেখালেখি ও সিনেমার কাজ এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেই অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন তিনি।
আবদুল কাদের :
বছর শেষে ২৬ ডিসেম্বর অভিনেতা আবদুল কাদের প্রয়াত হন। তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। শেষ সময়ে তিনি করোনায় আক্রান্তও হন। হুমায়ূন আহমেদের কোথাও কেউ নেই টেলিভিশন নাটকে বদি চরিত্রে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পান।
মঞ্চে অভিনয় করেছেন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, স্পর্ধা, মেরাজ ফকিরের মা নাটকগুলোতে অভিনয় করে তিনি পেয়েছেন জনপ্রিয়তা। মতিন রহমান পরিচালিত রং নাম্বারসহ চলচ্চিত্রেও অভিনয় করে তিনি জনপ্রিয় হয়েছিলেন।
মান্নান হীরা ও সেলিম আহমেদ:
বাংলাদেশের মিডিয়ার দু’জন গুনী নাট্যকার মান্নান হীরা ও সেলিম আহমেদ চলে গেছেন একই দিনে। ২৩ ডিসেম্বর চলচ্চিত্র নির্মাতা ও নাট্যকার মান্নান হীরা রাত আটটার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এদিকে সেদিনই সকালে মারা গেছেন সেলিম আহমেদ।
আগে থেকেই হৃদরোগে ভুগছিলেন মান্নান হীরা। মান্নান হীরা ছিলেন পথনাটক পরিষদের সভাপতি। তিনি আরণ্যক নাট্যদলের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মান্নান হীরা ‘ক্ষুদিরামের দেশে’, ‘লাল জমিন’, ‘ভাগের মানুষ’, ‘ময়ূর সিংহাসন’, ‘জননী বীরাঙ্গনা’, ‘সাদা-কালো’ প্রভৃতি নাটক রচনা ও নির্দেশনা দেন।
অভিনেতা, নির্দেশক, ভাস্কর, চিত্রকর ও কবি সেলিম আহমেদ গত ১৭ ডিসেম্বর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তাঁকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। পরে তিনি মারা যান।
সেলিম আহমেদ ‘জয়িতা’, ‘লোটাকম্বল’সহ বেশ কিছু একক ও ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করেছেন। এছাড়া তিনি বেশ কিছু মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছেন। নাটক নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। তিনি বহু বিজ্ঞাপনেও কাজ করেছেন। এছাড়া ‘চিরঞ্জীব মুজিব’ নামে একটি সিনেমার শিল্পনির্দেশক ছিলেন তিনি।
এদিকে দেশে বিদেশে সংস্কৃতির অঙ্গনের যারা এ বছর প্রয়াত হয়েছেন। তারা হলেন- ভারতের চলচ্চিত্র পরিচালক বাসু চ্যাটার্জী, বলিউড স্টার সুশান্ত সিং রাজপুত, ঋষি কাপুর।
এছাড়া আরও প্রয়াত হয়েছেন এসপি বালাসুব্রামানিয়াম, চ্যাডউইক বোজম্যান, সারোজ খান, নিম্মি, ওয়াজিদ খান, শন কনারি।এডি ভ্যান হ্যালেন, অলিভিয়া ডি হ্যাভিল্যান্ড, নায়া রিভেরা, কার্ক ডগলাসের মতো তারকারা রয়েছেন মৃত্যুর মিছিলে।