কালচারাল ইয়ার্ড ডেস্ক:
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ঘিরে জুলাই মাস জুড়ে সংঘর্ষ, আহত ও নিহতের মতো ঘটনা ঘটেছে। এ আন্দোলনে ঘিরে হয়েছে ধ্বংসজজ্ঞ। ঘটেছে গণগ্রেফতারের মতো ঘটনা। এতে বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজের সঙ্গে মাঠে নেমেছেন শিক্ষক-অভিভাবকরাও। এদিকে ছাত্র-ছাত্রীসহ সাধারণ মানুষ নিহতের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে মাঠে নেমেছে শোবিজের তারকারাও। মাঠে নেমে তিন দফা দাবি জানিয়েছে কবি-লেখক, সংস্কৃতিকর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত ‘গণহত্যা ও নিপীড়নিবিরোধী শিল্পীসমাজ’। তারা দেশব্যাপী নিহত ছাত্র ও সাধারণ মানুষদের নিহত হওয়ার ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচারের দাবি জানিয়েছেন। অবিলম্বে গণগ্রেফতার করা ছাত্র-ছাত্রীদের মুক্তির দাবিও জানিয়েছেন তারা।
বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার শোবিজ তারকা, শিল্পী, নির্মাতা, সঙ্গীতশিল্পী, কবি-লেখক, পারফর্মেন্স শিল্পী, নাট্যকার, অভিনয়শিল্পী থেকে শুরু করে সংস্কৃতিকর্মীরা মাঠে নেমে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ও আহতদের স্মরণ করে এর বিচার দাবি করেন। ঢাকার ফর্মগেটে ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ’র ব্যানারে বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন তারা।
বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিক্ষোভে তারকা শিল্পীরা
এদিন বেলা ১১টায় জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় সমাবেশটি হওয়ার কথা থাকলেও পুলিশের বাধায় তারা সেখানে যেতে পারেননি। পরে তারা ফার্মগেটে তেজগাঁ কলেজের উল্টোদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। বৃষ্টি চলা অবস্থায়ও তারা চালিয়ে যান সমাবেশ। চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা-অভিনেত্রী, থিয়েটারকর্মী, আলোকচিত্রশিল্পীসহ সকল শ্রেণির শিল্পীসমাজ এই বিক্ষোভে অংশ নেন। এ সময় তারা স্লোগান তুলেন- ‘দিনে নাটক রাতে আটক/ চলবে না চলবে না’, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক/স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক’।
এ সময় নাট্যকার ও অভিনেতা মামুনুর রশীদ বলেন, ‘জুলাই মাসব্যাপী যে ঘটনা ঘটেছে, সেখানে যে প্রাণ গেছে, তার মাঝে শিশুরাও রয়েছে। এই বেদনা প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই। আমরা এই ন্যক্কারজনক ঘটনার নিন্দা জানাই এবং বিচার দাবি করি।’
অভিনেত্রী রাফিয়াত রশিদ মিথিলা বলেন, ‘আমি সারাজীবন শিশুদের নিয়ে, শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করেছি। যেটি হয়েছে, তা খুবই দুঃখজনক। আমি চাই, যে ঘটনা হয়েছে- তার সুষ্ঠ বিচার হোক।’
এ সময় অভিনেতা আজাদ আবুল কালাম, মোশাররফ করিম, ইরেশ যাকের, অভিনেত্রী নিপুন, আজমেরী হক বাঁধন, নির্মাতা পিপলু আর খান, অমিতাভ রেজা চৌধুরী, নুরুল আলম আতিক, আলোকচিত্রশিল্পী মুনেম ইউসূফসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
বিটিভির ধ্বংসজজ্ঞ দেখে আবেগাপ্লুত কিছু শিল্পী
এদিকে শিল্পীসমাজের বিক্ষোভ সমাবেশ চলাকালীন রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনের সামনে সমাবেশ করেছে কিছু শিল্পী। তারা সকল প্রকার সহিংসতা প্রত্যাহার ও দোষীদের শাস্তি দাবি করেন। এ সময় তারা ঐতিহ্যবাহী টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভির ধ্বংসযজ্ঞের কথা তুলে ধরে এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবি করেন। তারা ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের প্রতি সমবেদনা জানান ও এ নিয়ে সৃষ্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনের সামনে সমাবেশে অংশ নিয়ে অভিনেতা ও ঢাকা ১০ আসনের সংসদ সদস্য, চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদ বলেন, ‘দেশটি হয়ত আবার আমরা কষ্ট করে ঠিক করে ফেলব, কিন্তু যে প্রাণগুলো ঝরে গেল সেগুলো আর আমরা আর কোনোদিন ফিরে পাব না।’
তিনি বলেন, ‘ছাত্ররা যে কোটার আন্দোলনে নেমেছিল তার পক্ষে আমরা সকলেই ছিলাম। কিন্তু আন্দোলনে এই ছাত্রদেরকে ঢাল করে একদল মানুষরূপী পশু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ছারখার করে দিয়েছে আমাদের এ দেশটিকে।’
বিটিভিতে আগুন কেন– সেই প্রশ্নও তুলেন ফেরদৌস আহমেদ। তিনি বলেন, আজকে আমরা বিটিভিতে এসেছি। আমাদের সংস্কৃতির অস্তিত্বের একটি জায়গা এটি। সে বিটিভিতে আগুন কেন? এ অগ্নিসন্ত্রাসী কারা? তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে, চিহ্নিত করতে হবে। যতগুলো প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, আপনারা যদি দেখেন, বাচ্চারা যদি দেখে, বুঝতে পারবে- সুপরিকল্পিতভাবে এসব করা হয়েছে। তাদের বিচার চাই। আজ আমরা সকল অঙ্গনের শিল্পীরা এখানে একত্রিত হয়েছি, আমাদের সংহতি প্রকাশ করার জন্য। সকল সহিংসতার বিরুদ্ধে আমরা।
বিটিভির ধব্ংসাত্নক চেহারা দেখে আবেগাপ্লুত অভিনেত্রী শমী কায়সার বলেন, ‘যে মাসে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে স্বাধীনতার ইতিহাসকে হত্যা করা হয়েছে। সেরকম একটি মাসে আমরা এই প্রতিবাদ সমাবেশে দাঁড়াব, এই বাংলাদেশ টেলিভিশন চত্বরে- সেটা আমাদের জীবদ্দশাতে কখনো ভাবিনি।’
তিনি বলেন, ‘আজকে আমরা ব্যথিত, ক্ষুব্ধ, মর্মাহত। কারণ যে বাংলাদেশ টেলিভিশন বাঙালির সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেছে- সেই বাংলাদেশ টেলিভিশনে এসে এই ধ্বংসযজ্ঞ দেখে মর্মাহত হয়েছি।’
এ সময় তিনি এই ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবিও জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে এরকম নৃশংসতা, এমন ধ্বংসযজ্ঞ, এতো প্রাণহাণি আমরা আর চাই না।’
এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন অভিনেতা রিয়াজ, আজিজুল হাকিম, সাজু খাদেম, অভিনেত্রী সুজাতা, অরুণা বিশ্বাস, নিপুণ, রোকেয়া প্রাচী, তানভীন সুইটি, হৃদি হক, জ্যোতিকা জ্যোতি, সোহানা সাবা, চন্দন রেজা, সংগীতশিল্পী শুভ্র দেব, পরিচালক মুশফিকুর রহমান গুলজার, এস এ হক অলিক, খোরশেদ আলম খসরুসহ নাটক ও চলচ্চিত্র অঙ্গনের তারকারা।
নিপীড়ন-মামলা-গ্রেপ্তার বন্ধে শিল্পীসমাজের তিন দাবি
এদিকে শুক্রবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপরে নিপীড়ন এবং মামলা-গ্রেপ্তার বন্ধে তিনটি দাবি উত্থাপন করেছে ‘গণহত্যা ও নিপীড়নবিরোধী শিল্পীসমাজ’।
১ আগস্ট শুক্রবার ঢাকার সাত মসজিদ রোডে (ধানমণ্ডির আবাহনী মাঠের পাশে) ‘গণহত্যা ও নিপীড়নবিরোধী শিল্পীসমাজ’র ব্যানারে আয়োজনে কবি, লেখক, গবেষক, স্থপতি, আলোকচিত্রশিল্পী, পারফরমেন্স শিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, শিল্পসংগঠকরা উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন। বেলা ১১টায় সমাবেশ শুরু হলে ঝুম বৃষ্টি উপেক্ষা করে তারা স্লোগান তুলেন-‘জনতায় আস্থা/ স্বৈরতন্ত্রে অনাস্থা’ স্লোগান দেন সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা।
এ সময় তারা পারফরমেন্স আর্ট, গান-কবিতায়, ছবি এঁকে প্রতিবাদ করেন। সেখানে হত্যা, গুমসহ নানা অনাচারের চিত্র তুলে ধরা হয়। এরপরে তারা মিছিল বের করে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরের সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করেন।
সমাবেশ থেকে তারা তিনটি দাবি তুলে ধরেছেন-
১. আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতার বিরুদ্ধে গণগ্রেপ্তার ও গণমামলা বন্ধ করে অবিলম্বে আটককৃত ছাত্র-জনতাকে মুক্তি দেওয়া।
২. কারফিউ তুলে নিয়ে জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা এবং সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকার দলীয় গুণ্ডাবাহিনী মুক্ত করা।”
৩. কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনের নামে সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য তদন্ত ও বিচার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে অবিলম্বে সরকারের পদত্যাগ।