
কালচারাল ইয়ার্ড ডেস্ক:
দম বন্ধ করা রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশ। রাজধানী শহরও ছিলো থমথমে। এর মধ্যে শীতের ভাপ উঠা দিনে ঢাকায় শুরু হয়েছে চলচ্চিত্র উৎসব। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ৭৫টি দেশের মোট ২২০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে। এসব চলচ্চিত্রের ভেতর বাংলাদেশের মোট ৪৪টি চলচ্চিত্র দেখানো হবে। শনিবার ১১ জানুয়ারি দেশের সবচেয়ে বড় চলচ্চিত্র উৎসবের ২৩তম আসরের উদ্বোধন করেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদের আয়োজনে ‘নান্দনিক চলচ্চিত্র, মননশীল দর্শক, আলোকিত সমাজ’ শ্লোগান নিয়ে আয়োজিত এ আয়োজন শুরু হয় জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে। বাংলাদেশ ও চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে চীনা চলচ্চিত্রের পোস্টার প্রদর্শনী কর্নার উদ্বোধন করা হয় এই মিলনায়তনে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এবং চীনা চলচ্চিত্র প্রশাসনের আন্তর্জাতিক বিভাগের পরিচালক শু ইয়াংসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে এই উৎসব।
উদ্বোধনী ছবি হিসেবে দেখানো হয় চীনা ছবি ‘মুন ম্যান। আর ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশি ছবি ‘বলী’ নিয়ে শেষ হবে এ উৎসব। সমাপনী দিনে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
যা থাকছে এ উৎসবে
এর আগে ৯ জানুয়ারি দুপুরে ঢাকা ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে উৎসবের বিস্তারিত তুলে ধরেন উৎসব পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামাল। সংবাদ সম্মেলনে এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন উৎসব কমিটির চেয়ারপার্সন কিশওয়ার কামাল, এশিয়ান কম্পিটিশন সেকশনের জুরি বোর্ডের সদস্য অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন, উৎসব কমিটির নির্বাহী সদস্য জালাল আহমেদ, উৎসব কমিটির সদস্য সাংবাদিক রফিকুজ্জামান, মাস্টারক্লাস কো-অর্ডিনেটর, ফেস্টিভ্যাল মিডিয়া ইনচার্জ বিধান রিবেরু এবং উইমেন ইন সিনেমা কনফারেন্সের কনফারেন্স ডিরেক্টর সাদিয়া খালিদ রিতি।
মাস্টারক্লাস কো-অর্ডিনেটর, ফেস্টিভ্যাল মিডিয়া ইনচার্জ বিধান রিবেরু বলেন, কোনো কিছুই রাজনীতির উর্ধ্বে নয়। তবে এসবের বাইরে গিয়ে আমরা বলতে চাই, এই উৎসবে এবার ভারতের ৬টি সিনেমা দেখানো হবে। এরমধ্যে ‘পদাতিক’-এর মতো সিনেমাও কিন্তু আছে।
এসময় বিদেশি ডেলিগেশন নিয়ে তিনি বলেন, এবারের আয়োজনের শুরু থেকেই আপনারা শুনছেন যে, উৎসবে অর্থের যোগান বা বাজেট খুবই কম ছিলো। সে কারণে এবার ডেলিগেশন কমিয়ে আনা হয়েছে। প্রতিবার শতাধিক বিদেশি ডেলিগেশন থাকে, কিন্তু এবার বড়জোর ৪০ থেকে ৫০টি ডেলিগেশন থাকছে।
এশিয়ান সিনেমা কম্পিটিশন
এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে ১৭টি চলচ্চিত্র নিয়ে গঠিত প্রতিযোগিতা বিভাগ থেকে সেরা চলচ্চিত্র নির্ধারণে থাকবে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক জুরি বোর্ড। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জন্য পুরস্কার হিসেবে থাকছে একটি ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট এবং নগদ এক লক্ষ টাকা। এছাড়া শ্রেষ্ঠ পরিচালক, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা-অভিনেত্রী, শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক এবং শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের জন্য পুরস্কার হিসেবে থাকছে একটি সার্টিফিকেট ও ক্রেস্ট। এশিয়ান ফিল্ম কম্পিটিশিন বিভাগে আছে ভারতীয় ছবি ‘বেলাইন’।
রেট্রোস্পেকটিভ বিভাগ:
এবারের রেট্রোস্পেকটিভ বিভাগে থাকছে রাশিয়ার স্বনামধন্য নির্মাতা এলেক্সি ফেডরচেনকোর চলচ্চিত্র। তিনি ইতিহাস, লোককাহিনি ও মানবিক গল্পের মিশেলে চলচ্চিত্রে জাদু নির্মাণ করেন। এবারের আয়োজনে তার ৬টি চলচ্চিত্র দেখানো হবে। ছবিগুলো হলো: এঞ্জেলস অব রেভুল্যুশন, আতাভিজম, বিগ স্নেক অব উলি-কালি, ফার্স্ট অন দ্য মুন, আনা’স ওয়ার ও দ্য রেইলওয়ে।
বাংলাদেশ প্যানোরামা:
বাংলাদেশের ১০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে উৎসবের এ বিভাগে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচক ফেডারেশন- ফিপ্রেসি বাংলাদেশ প্যানোরামার পূর্ণদৈর্ঘ্য বিভাগে একটি চলচ্চিত্র সমালোচক পুরস্কার দেবেন। এই বিভাগে বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতাদের নির্মিত বাছাইকৃত সর্বোচ্চ ১৫ মিনিটের ১৫ টি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি দেখানো হবে।
ওয়াইড অ্যাঙ্গেল:
বরাবরের মতো চীন উৎসবের ফোকাস কান্ট্রি। এই বিভাগে চীনের ১৫টি সিনেমা দেখানো হবে। সিনেমা অব দ্য ওর্য়াল্ড বিভাগে এই বিভাগে ৪৩টি দেশের বাছাইকৃত সমকালীন ৩৯ টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে। চিলড্রেন্স বিভাগে ১০টি শিশুতোষ চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে এই বিভাগে। শিশুদের জন্য এই প্রদর্শনী উন্মুক্ত থাকবে। এই বিভাগ থেকে একটি চলচ্চিত্র ‘বেস্ট জুভেনাইল অডিয়েন্স বাদল রহমান অ্যাওর্য়াডে’র জন্য মনোনীত হবে। পুরস্কার হিসেবে সনদ ও ক্রেস্ট প্রদান করা হবে।
‘সিনেমা অব দ্য ওর্য়াল্ড বিভাগ’ বিভাগে থাকছে ৩৯টি সিনেমা। স্পিরিচুয়াল ফিল্মসে প্রায় ১৭ টি ছবি দেখানো হবে। মূলত ধর্মীয় বিশ্বাস, অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং মানবতাবাদী চলচ্চিত্রগুলো এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি এ বিভাগটির ছবিগুলো আন্তঃধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন তৈরিতে সহায়তা করবে। ভাববাদী চলচ্চিত্রের এই বিভাগের জন্য ইন্টারফেইথ্ জুরি একটি শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্র ও একটি শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্র নির্ধারণ করবে। পুরস্কার হিসেবে একটি সার্টিফিকেট ও ক্রেস্ট প্রদান করা হবে।
উইমেন ফিল্ম মেকারস্ সেশন
দেশ ও বিদেশের নারী নির্মাতাদের চলচ্চিত্র নিয়ে এই বিভাগটি সাজানো হয়েছে। এতে দেশি-বিদেশি ২৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্র অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। ৪ সদস্য বিশিষ্ট জুরি বোর্ড এই বিভাগের একটি শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্র ও একটি শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্রকে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করবেন। এছাড়া এই বিভাগ থেকে একজন শ্রেষ্ঠ নারী নির্মাতাকেও পুরস্কৃত করা হবে। পুরস্কার হিসেবে থাকছে সনদ ও ক্রেস্ট। শর্ট অ্যান্ড ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্মস্ বিভাগে নবীন ও স্বাধীন চলচ্চিত্র নিমার্তাদের তথ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্রসমূহ প্রদর্শিত হবে। এতে প্রদর্শিত হবে দেশি-বিদেশি ৫২ টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র।
জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তন ও কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তন, শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা, অলিয়ঁস ফ্রঁয়েজ মিলনায়তন, নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি অডিটোরিয়াম ও গ্রীন ইউনিভার্সিটি অডিটোরিয়ামে এসব মিলনায়তনের সব প্রদর্শনী সবাই বিনামূল্যে উপভোগ করতে পারবেন। তবে আসন সংখ্যার ভিত্তিতে।
সেমিনার ও মাস্টার ক্লাস
উৎসবের অংশ হিসেবে চলচ্চিত্রে নারীর ভূমিকা বিষয়ক ‘একাদশ আন্তর্জাতিক উইমেন ফিল্ম মেকারস্ কনফারেন্স’ ১২ থেকে ১৩ জানুয়ারি ঢাকা ক্লাবের স্যামসন লাউঞ্জের ৩য় তলায় অনুষ্ঠিত হবে। উক্ত কনফারেন্সে দেশি বিদেশি নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা ও ব্যক্তিত্বদের সাথে মত বিনিময়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের নারী নির্মাতাগণ অভিজ্ঞতা অর্জনের একটি সুবর্ণ সুযোগ পাবেন। এখানে নারী নির্মাতারা তাদের কাজ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাসমূহ এবং উত্তরণের উপায় নিয়ে বিশ্বের খ্যাতিমান নারী নির্মাতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। বিশ্ব পরিবর্তনে নারীর নেতিবাচক ও ইতিবাচক ভূমিকা এবং প্রতিবন্ধকতা থেকে সমাধানের উপায়সমূহ উঠে আসবে এই কনফারেন্সে।
১২ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৯টায় ‘একাদশ আন্তর্জাতিক উইমেন ফিল্ম মেকারস্ কনফারেন্সের’ উদ্বোধনী দিনে উৎসবের চেয়ারপারসন কিশওয়ার কামালের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সেন্ট্রাল উইমেনস ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর পারভীন হাসান। বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকবেন একশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির এবং চীনের চলচ্চিত্র পরিচালক ও লেখক ঝ্যাং ইয়ুদি।
জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে কয়েকটি বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। ১২, ১৫, ১৬ ও ১৭ জানুয়ারি তারিখে ৭টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি দেখানো হবে যথাক্রমে জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তন, গ্রিন ইউনিভার্সিটির অডিটোরিয়াম, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালা মিলনায়তন এবং নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির অডিটোরিয়ামে। এছাড়া উৎসবের অংশ হিসেবে আগামী ৯-১৭ জানুয়ারি অলিয়ঁস ফ্রঁসেজের ল্যা গ্যালেরি মিলনায়তনে আয়োজন করা হয়েছে চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর। এখানে নবীন ও প্রবীণ শিল্পীদের শিল্পকর্ম অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
১৭-১৮ জানুয়ারি তৃতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মাস্টারক্লাস। জাতীয় জাদুঘরের সিনেপ্লেক্স মিলনায়তনে অনুষ্ঠিতব্য এই মাস্টাক্লাসে কথা বলবেন চীনের লেখক ও চলচ্চিত্র পরিচালক ঝাং ইউদি, সার্বিয়ার চলচ্চিত্র পণ্ডিত অধ্যাপক ড্রেগেন মিলিনকোভিচ, নরওয়ের চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক অগি হোফার্ট এবং বাংলাদেশের চিত্রত্রগ্রাহক রাশেদ জামান। এই দু দিনব্যাপী মাস্টারক্লাসটি আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে নিবন্ধিত অতিথিরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন। নিবন্ধনের জন্য উৎসবের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ লক্ষ্য রাখতে বলা হয়েছে।
আরও পড়ুন: দোজার গবেষণাকর্ম ‘চলচ্চিত্রের সৈয়দ শামসুল হক’ উপস্থাপন