কালচারাল ইয়ার্ড ডেস্ক:
ঢাকাই চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেত্রী, গীতিকার ও নির্মাতা জাহানারা ভূঁইয়া প্রয়াত হয়েছেন ২৫ আগস্ট সোমবার। এদিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। ৬৮ বছরর এই অভিনেত্রী দীর্ঘদিন ধরে নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। ডায়াবেটিসের জটিলতায় তাঁর দুটি কিডনিই অচল হয়ে যায়। গত ১৬ মাস ধরে তিনি মিনেসোটার লেক রিজ কেয়ার সেন্টারে চিকিৎসাধীন ছিলেন। নিয়মিত ডায়ালাইসিস চললেও শেষ পর্যন্ত আর সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি।
ষাট ও সত্তরের দশকে মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল নাম। নাটক, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনে সমান দক্ষতায় অভিনয় করে দর্শকদের মুগ্ধ করেছিলেন এই গুণী শিল্পী। তাঁর অভিনীত নাটক ও চলচ্চিত্রগুলো সমাজ বাস্তবতাকে তুলে ধরায় বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে তিনি পেয়েছেন দর্শক-সমালোচকদের প্রশংসা এবং দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে রেখেছেন অমলিন অবদান।
বাংলাদেশের নাট্য ও চলচ্চিত্র জগতে অভিনেত্রী জাহানারা ভূঁইয়া ছিলেন এক অনন্য নাম। তাঁর প্রয়াণ শুধু একটি প্রজন্মকে নয়, বরং গোটা সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে শূন্য করে দিল। অভিনয়কে তিনি জীবনসাধনা হিসেবে নিয়েছিলেন, আর সেই সাধনাতেই দর্শকের কাছে রেখে গেছেন স্মরণীয় সব চরিত্র, অগণিত আবেগ ও শিল্পের অমর দৃষ্টান্ত।
চলচ্চিত্রে অভিষেক
আশির দশকে ‘সৎমা’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পান। এরপর শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। পাশাপাশি পরিচালনা করেছেন কয়েকটি ছবি, যার মধ্যে ‘সিঁদুর নিও না মুছে’ উল্লেখযোগ্য।
প্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক আজীজ আহমেদ বাবুলের বোন জাহানারা ভূঁইয়া দেশীয় চলচ্চিত্রে নারী পরিচালকদের অগ্রদূতদের একজন। স্বাধীনতার আগে ১৯৭০ সালে মানজান আরা বেগম (রেবেকা) প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে ‘বিন্দু থেকে বৃত্ত’ নির্মাণ করলেও স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্র পরিচালনায় এগিয়ে আসা নারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জাহানারা ভূঁইয়া। তাঁর পরিচালিত‘সিঁদুর নিও না মুছে’ ছবিটি সেন্সর ছাড়পত্র পেলেও আজ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি।
জাহানারা ভূঁইয়ার জন্ম ঢাকায়। ছোটবেলা থেকেই নাটক ও শিল্পচর্চার পরিবেশে বেড়ে ওঠেন তিনি। স্কুলজীবনেই মঞ্চে প্রথম অভিনয় করেন। সত্তর দশকের শুরুতে মঞ্চনাটকের মাধ্যমে তাঁর অভিনয়জীবনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। মঞ্চই তাঁকে তৈরি করে, আর সেখান থেকেই তিনি পরবর্তীতে চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনে জায়গা করে নেন।
জাহানারা ভূঁইয়া ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভাধর শিল্পী। নাট্যদলগুলোর নিয়মিত মুখ ছিলেন তিনি। সামাজিক, ঐতিহাসিক কিংবা মানবিক যে কোনো চরিত্রে তিনি অনন্যতা দেখিয়েছেন। টেলিভিশন নাটকেও ছিলেন এক বিশ্বস্ত নাম— পারিবারিক কাহিনি থেকে শুরু করে সামাজিক দ্বন্দ্ব বা নারীর সংগ্রাম— সব চরিত্রেই তিনি দর্শকের মনে রেখাপাত করতে সক্ষম হয়েছেন। চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় ছিল সীমিত, তবে যে ক’টি কাজ করেছেন তা আজও প্রশংসিত। প্রথাগত অভিনয়ের বাইরে গিয়ে তিনি চরিত্রে আনতেন বাস্তবতার ছাপ, যা তাঁকে করে তুলেছিল ব্যতিক্রমী।
অভিনয়ে তাঁর দীর্ঘ যাত্রায় অসংখ্য তরুণ শিল্পী অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তিনি ছিলেন সহকর্মীদের কাছে একনিষ্ঠ ও আত্মপ্রত্যয়ী সহযাত্রী। তাঁর মৃত্যুর পর সহকর্মী ও ভক্তরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন— তিনি ছিলেন বাংলা নাট্যজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যাঁর অবদান ভোলা যাবে না। তাঁর অভিনয় ও শিল্পদর্শন নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। বাংলা নাটক ও অভিনয় জগতে তিনি অমর হয়ে থাকবেন— তাঁর চরিত্র, তাঁর শিল্পসাধনা এবং তাঁর একান্ত আত্মনিবেদিত জীবনের মাধ্যমে। কালচারাল ইয়ার্ড এই শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।